ছেলেমেয়েদের 'অড জব'

অডজব করছেন সাশা। পাশে বাবা সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে সাশা
অডজব করছেন সাশা। পাশে বাবা সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সাথে সাশা

আমাদের বাঙালি কমিউনিটিতে একটা শব্দ পরিচিত, ‘অড জব’। আমেরিকানদের কাছেও একটা শব্দ কমন, ‘লো ইনকাম জব’। কিন্তু ‘অড জব’ মনে হয় বাঙালিরাই ব্যবহার করে। নাক উঁচু বাঙালিরা উপোস করবে, পাবলিক মানির ওপর বোঝা হবে, তারপরও ‘অড জব’ করবে না। আর এই অড জব না করা না করা নিয়ে কত ত্যাগ, কত তিতিক্ষা, কত অশান্তি ঘরে-বাইরে! 

আউটরিচে কাজ করার কারণে এখন নানা রকম মানুষের সঙ্গে পরিচয়। একজন আছেন ডাক্তার। আমেরিকান ডাক্তার। জানতে চাইলাম, ‘কেমন আছেন? ছেলে মেয়েরা কেমন আছে?’ খুব উচ্ছ্বাসের সঙ্গে জবাব দিলেন, খুব ভালো আছেন। ছেলে একটা কাজ নিয়েছে। মেয়েরা কানাডায় ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ছেলে কী করে জানতে চাইলে বললেন, ছেলে একটা কফি শপে ক্যাশিয়ারের কাজ নিয়েছে। প্রথমে ভিরমি খাওয়ার অবস্থা। বাঙালি মন বলে কথা! ভাবছি এতে এত খুশি হওয়ার কী আছে? বাঙালি হলেতো এই কথা মুখ দিয়ে বের করতই না বরং কীভাবে জনসমক্ষে এই কথা প্রকাশ না পায় সেই চেষ্টায় সর্বক্ষণ ব্যয় হতো। কিন্তু সব শুনে আমার নিজেরই ভালো লাগল। কত সুখে তারা। কোনো দীনতা নেই কারও কাজের ধরন নিয়ে। কাজ করছে সেটাই বড় কথা।
ডাক্তারের স্বামী এক কোম্পানির ড্রাইভার। ২৭ বছর বয়সী নার্সের বিশ বছরের স্বামী। পুলিশ অফিসারের স্ত্রী কাজ করে গ্রোসারিতে। হোয়াইট কলার জবে থাকা স্ত্রীর স্বামী বুলু কলার জব করে—এমন নজির ঘরে ঘরে। তারা সুখে আছে। বলতে এক ফোঁটাও দ্বিধা নেই। কেউ কাউকে ছোট মনে করছে না। সবকিছুর মধ্যে অর্থ খুঁজে পাচ্ছে, প্রাণ খুঁজে পাচ্ছে। সুখে আছে বলেই মনে হয়। এখানে কেউ কারও পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করে না। আমি হাসপাতালের এক নার্সকে চিনি, তার ভাই সেখানে ক্লিনারের কাজ করে, বাঙালি হলে এমন ভাইয়ের হয়তো পরিচয় দিত না, কিন্তু ওরা দিব্যি ভাই-বোন মিলে এক সঙ্গে লাঞ্চ করে। আসলেই তো ওর ভাই তো ক্লিনারের কাজ করে! চুরি-ডাকাতি তো করে না। তবে কেন লজ্জা পাবে?
আমার মেয়েও এবার স্কুল থেকে কাজের চিঠি নিয়ে আসছে। তার বয়স চৌদ্দ হতেই কাজের অনুমতি পত্র ধরিয়ে দিয়েছে স্কুল। এখানে ছেলেমেয়েরা হাইস্কুলে উঠলেই স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের কাজ করতে বলে। উদ্দেশ্য তাদের স্বাবলম্বী করে তোলা। যাতে তাঁর আত্মবিশ্বাস বাড়ে। জীবন ও বাইরের জগৎ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পায়।
মেয়ে চিঠি পাওয়াতে আমি খুব খুশি। স্কুল, হোমওয়ার্ক করেও অফুরন্ত সময়। খালি ফোন নিয়ে পড়ে থাকে। আমিও চাচ্ছিলাম সে কাজ করুক। জীবনের প্রশিক্ষণ নিক। কিন্তু কাজটা করবে কোথায়? বলি, ‘মা কোথায় কাজ করতে চাও?’ সে মুখ টিপে হাসে। আমতা-আমতা করে বলে, ‘স্টার বাকস এ।’ আমিতো তাজ্জব! ভাবছিলাম বলবে লাইব্রেরিতে, বলে স্টার বাকসে। আর কোথায় অ্যাপ্লাই করতে চাও? বলে, মলে। আর কোথাও? বলে, ফার্মাসিতে। বলা বাহুল্য এসবের কোনোটাই তার ভবিষ্যতের কর্ম পরিকল্পনার সঙ্গে মিল নেই।
ছোটবেলায় যখন জানতে চাইতাম কী হবে ভবিষ্যতে, একসময় বলত এসট্রোনাট হবে আর পরক্ষণে বলত হবে ‘মেইলম্যান’। আমার এক প্রফেসর তার এই জবাব শুনে যা বলেছিল তার সহজ বাংলায় হয়, ‘তুমি দেখছি আগরতলা থেকে জুতারতলা কোনোটাই বাদ রাখলে না!’ আরেকটু বুঝ হওয়ার পর থেকে একটাই হতে চাওয়া, আইসক্রিম কার্টের ড্রাইভার কাম সেলসপার্সন হওয়া। মতলব? অবশ্যই আইসক্রিম খাওয়া। কাস্টমার না থাকলেই নাকি বসে বসে আইসক্রিম খাবে। যাই হোক এবার বয়স পাল্টেছে কিন্তু অভ্যাস পাল্টেছে বলে মনে হচ্ছে না। মলে কাজ করার উদ্দেশ্য কাজ শেষে মেকআপ কেনা। স্টারবাক্স থেকে কফি খাওয়া আর ফার্মেসিও সেই একই কারণে। সেখান থেকেও টুকি টাকি মেক আপ কেনা যাবে কাজের পরে!
যাই হোক, আমার এক সহকর্মী আমাকে বুদ্ধি দিয়েছে ওর কাজটা কোনো গ্রোসারি বা ডানকিন ডোনাটের মতো জায়গায় দিতে। তার কথা হলো, এসব ছেলে মেয়ের বড় হওয়ার আগেই জীবন সম্পর্কে ধারণা দেওয়া ভালো। আর যে কাজ সে ভবিষ্যতে করবে তা তার ভবিষ্যতের জন্য চমক হিসাবে থাক। বর্তমানে তাকে এমন একটা অভিজ্ঞতা পেতে দাও যা পাওয়ার সম্ভাবনা তার ভবিষ্যতে কম।
কথাটা আমার মনে ধরেছে। আজ ভাবছি তার জবের অনুমতিতে স্বাক্ষর করে দেব। দেখি জীবনের প্রথম জব কোথায় হয় তার! তবে কাজটি আমাদের ভাষায় ‘অড জব’ হলেই ভালো। জীবনকে ভালো বাসতে হলে ‘অড জব’ দিয়ে শুরু করাই ভালো। এতে করে যারা এই লো ইনকাম কাজ করে তাদের প্রতি তার মনে সম্মান এবং সহানুভূতি জন্মাবে। আর ভবিষ্যতে যে কোনো কাজই তার কাছে কঠিন মনে হবে না।
আমার আরেক বন্ধু ওর ছেলে প্রথম অড জব করেছিল মডেলসে। এখানকার একটা চেইনশপ। ছেলে যেদিন প্রথম চেক পায়, সেদিনের কথা নাকি ওর চিরদিন মনে থাকবে। ১৪ বছর বয়সী ছেলের প্রথম আয়, কী যে ভালো লেগেছিল চার সদস্যের সেই পরিবারটির। পরে ছেলে তার বেতনের ডলার জমিয়ে মাকে একটা মাইকেল কোরের ব্যাগ কিনে দিয়েছিল। আমার বন্ধু বলে, আমি নিজে কখনই এত দামি ব্যাগ কিনতাম না। কিন্তু ছেলে যখন কিনে দিল না করতে পারলাম না।