একজন লড়াকু মানুষ: কবি আলেয়া চৌধুরী

চতুর্থ শ্রেণিতে অধ্যয়নকালীন একটি লেখা লিখে আলোড়ন তুলেছিলেন এক অন্তর্নিহিত কবি। আজকের আলেয়া চৌধুরী, যিনি জীবনসংগ্রামে কখনো হার মানেননি। ১৯৬৯-এ গ্রাম্য পঞ্চায়েতের অমানবিক বিচারে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আসেন। তাঁর মা তাঁকে স্বাধীনতার পথ দেখিয়ে গ্রাম ত্যাগ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
ঢাকায় এসে আলেয়া চৌধুরী হকারের কাজ নেন। খবরের কাগজ বিলি করে জীবিকা নির্বাহ শুরু করে চাঞ্চল্যকর খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন তিনি। মাত্র ১৩ বছর বয়সে পেশাগত গাড়িচালক হওয়ার প্রচেষ্টা আবারও দৈনিক বাংলার লোক-লোকালয় পাতায় সাংবাদিক হেদায়েত হোসাইনের কলামে তাঁকে খ্যাতি এনে দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে সেলাই মেশিন দিয়ে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন, আলেয়া চৌধুরী তা গ্রহণ করেননি এবং নারীদের গাড়িচালক পেশায় স্বীকৃতি দিয়ে আইন পাস করার প্রস্তাব রেখেছিলেন। বাংলাদেশের সাহিত্য, স্বাধীনতার ইতিহাসকে কবি আলেয়া চৌধুরী সগর্বে ধারণ করেন। প্রখ্যাত লেখকদের সাহচর্যে বেড়ে উঠেছিলেন আজকের কবি আলেয়া চৌধুরী।
আলেয়া চৌধুরীর জন্ম ১৯৬১ সালে কুমিল্লার উত্তর চর্থা গ্রামে। মায়ের নাম আম্বিয়া খাতুন, পিতা সুলতান আলম চৌধুরী। দারিদ্র্যের কারণে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেননি। একজন স্বশিক্ষিত নারী তাঁর মেধা, মনোবল ও প্রতিভাকে সঙ্গী করে জীবনের কণ্টকময় পথ পাড়ি দিয়েছেন। ঢাকার আজিমপুর এতিমখানার পাশে অবস্থিত দৈনিক আজাদ পত্রিকা অফিসের খেলাঘরে তিনি প্রথম স্বরচিত কবিতা পড়েন। এরপর ১৯৭০ সালে বেগম পত্রিকায় তাঁর লেখা কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৭৩ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই জীবনের স্টেশনে পদ্মা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। এ বইটিতে অগ্নি বলয় কবিতায় কবি লিখেছেন:
‘জন্মেই শুনেছি শৈশবের মানুষেরা পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালাত
অথচ আমি আজ দাঁতে দাঁত ঘষে জ্বালাই প্রদীপ
এবং জীবনের মুহূর্ত ঘষে বানাই বিবেক।’
পরবর্তীকালে ১৯৭৮-এ দুঃখের সমান সরলরেখা এবং ১৯৮৪-তে যুদ্ধহীন নিরাময় পৃথিবী চাই নামে আরও দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়।
বাড়ি থেকে চলে আসার পর কিছুদিন মুন্সিগঞ্জে থাকেন। ১৯৭১-এর পরে তিনি নিজ গ্রামে ফিরে যান। পরিবার ও গ্রামবাসী তাঁকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালে তিনি পুনরায় ঢাকায় ফিরে এসে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে আশ্রয় নেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীপ্ত বাংলা নামে একটি পত্রিকার সঙ্গে জড়িত হন। কয়েক বছর দৈনিক ইত্তেফাক অফিস ও রেডিও বাংলাদেশে কাজ করার পর মাত্র ১৮ বছর বয়সে ইরান ও জার্মানি ভ্রমণ করেন। অবশেষে ২০ বছর বয়সে মাছ ধরার নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মার্কিন মুল্লুকে থিতু হন। পর্যটক জীবনে তিনি হতোদ্যম হননি কখনো।
স্বদেশের ধূলিকণা পায়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বিভিন্ন দেশে কর্মক্ষম থেকে নানা দেশের, বর্ণের-ধর্মের মানুষের সান্নিধ্যে অভিজ্ঞতার আলোকে তাঁর কবিতার বাঁকবদল ঘটে এবং তাঁর কবিতা পরিণত হয়ে ওঠে। অভিবাসী জীবনে আন্তর্জাতিক বলয়ের প্রভাবে সাম্রাজ্যবাদ, জঙ্গিবাদ এবং শান্তির সপক্ষে ঘৃণা প্রকাশ করে সাম্রাজ্যবাদকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁর কবিতাকে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরেন। তাঁর কবিতা সমষ্টির মঙ্গলসাধনায় যেমন অঙ্গীকারবদ্ধ, তেমনি ব্যক্তিক প্রেমানুভূতির বিষয়টি কবিতার মৌলিক দ্যোতনা হিসেবে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে মানবজীবন, প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতিও দায়বদ্ধ।
১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত নিউইয়র্কে সমস্যাজর্জরিত শিশুদের সাহায্য করবার উদ্দেশ্যে Problem Child নামের একটি প্রতিষ্ঠানে তিনি উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অস্তিত্বের সংগ্রামকে স্বীকৃতিস্বরূপ নিউইয়র্কের স্টার ম্যাগাজিন ‘Woman Of The Year’ শীর্ষক প্রচ্ছদকাহিনি প্রকাশ করে। ১৯৯৪ সালে দিনা হোসেন Aleya: A Bangladeshi Poet in America নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেন। এই ছবিতে মজদুর শ্রেণি থেকে আসা একজন নারীবাদী কবির সংগ্রামী জীবনের গল্প চিত্রায়িত হয়। দিনা হোসেন এই ফিল্ম তৈরি করে কলকাতা থেকে ‘কলাকৃতি’ পুরস্কার পান। এ ফিল্মটি পরিচালক তারেক মাসুদ কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি, জাভেথ সেন্টার, ম্যানহাটান, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ক্যালিফোর্নিয়া ও বিভিন্ন স্থানে প্রদর্শন করেন। চীন ও বাংলাদেশে এটি প্রদর্শিত হয়। ২০১৬ সালে একটি নারীবিষয়ক পত্রিকা তাঁর কর্মজীবনের সাফল্যকে স্বীকৃতি দান করেন।
বাংলাদেশ ও নিউইয়র্কে অবস্থানকালে কবির ১১টি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ ভ্রমণকালে কবির তিনটি বই যথাক্রমে—হৃদয়ে বাংলাদেশ, মাদার ও God kissed it প্রকাশিত হয়। ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ইংরেজিতে The Man: Father of Bangladesh বইটি আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। বইটির সম্পাদনায় ছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী।
২০১১ সালে নাইন-ইলেভেন ও বিশ্বের অমানবিক ঘটনার ওপর তিনি একটি কবিতার পাণ্ডুলিপি Poems about Truth তৈরি করেন, যেটি রকল্যান্ড সিটি হলে গৃহীত হয় এবং কবিতার আসরে তিনি আমেরিকান কবিদের সঙ্গে তাঁর কবিতা পাঠ করেন।
নারীবাদী লড়াকু কবির শারীরিক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও প্রকৃতির নান্দনিক সৌন্দর্যের মধ্যে ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন তিনি। অবসরে প্রিয় মানুষদের সঙ্গে সময় কাটাতে ও বই পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কবি আলেয়া চৌধুরীর সর্বাঙ্গীণ সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।