আমেরিকা শুধু সাদাদের?

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন, শুধু শ্বেতকায় ইউরোপীয়দের আমেরিকায় অভিবাসী হিসেবে আসতে দেওয়া উচিত। গত বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসে কংগ্রেসের একটি দ্বিপক্ষীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি মন্তব্য করেন, হাইতি ও আফ্রিকার মতো ‘জঘন্য’ (তাঁর ভাষায় ‘শিটহোল’) দেশ থেকে মানুষ আমরা কেন আমেরিকায় আসতে দিচ্ছি? তিনি এ কথাও যোগ করেন, আমাদের উচিত নরওয়ের মতো দেশ থেকে লোকদের আসতে দেওয়া। এশিয়া থেকে আরও অধিক সংখ্যায় অভিবাসী আগমনের পক্ষেও মন্তব্য করেন ট্রাম্প।

যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরে ট্রাম্পের এই মন্তব্য তীব্র সমালোচিত হয়েছে। কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাট সদস্যরা এই মন্তব্যকে ‘বর্ণবাদী’ বলে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কংগ্রেসের ‘ব্ল্যাক ককাস’ বা কৃষ্ণকায় সদস্যদের গ্রুপের প্রধান সেড্রিক রিচমন্ড বলেছেন, এখন আর কোনো সন্দেহ নেই যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন বলেন ‘আমেরিকাকে আবার মহান কর,’ তাঁর সে কথার অর্থ, ‘আমেরিকাকে আবার শুধু সাদাদের দেশ কর।’

হোয়াইট হাউস থেকে প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের সত্যতা অস্বীকার করা হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, ওয়াশিংটনের একদল রাজনীতিক যেখানে বিদেশের জন্য লড়তে প্রস্তুত, সেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সব সময় আমেরিকান মানুষের জন্য লড়াই করছেন। এক বিবৃতিতে হোয়াইট হাউস থেকে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট চান মার্কিন অভিবাসন ব্যবস্থার সংস্কার, যার অধীনে বিদেশিদের ঢালাও আগমনের অনুমতি প্রদানের বদলে তাঁদের গুণাবলির ভিত্তিতে আসতে দেওয়া হবে।

রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক দলভুক্ত কয়েকজন নেতা এদিন হোয়াইট হাউসে এসেছিলেন ট্রাম্পের সঙ্গে ‘ডাকা’ কর্মসূচিকে ঘিরে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তার সমাধান হিসেবে একটি দ্বিপক্ষীয় সমাধান প্রস্তাব নিয়ে।

 ‘ডাকা’, যার পুরো নাম ডেফারড অ্যাকশন ফর চাইল্ডহুড প্রোগ্রামস, তাকে কেন্দ্র করে এক বছর ধরেই তুমুল হল্লা চলছে। ওবামা আমলে জারি করা এই আইনের অধীনে শিশু অবস্থায় যারা বৈধ কাগজপত্র ছাড়া পিতামাতার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে, তাদের সাময়িকভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে অবস্থানের সুযোগ দেওয়া হয়। প্রায় ৮ লাখ তরুণ-তরুণী এই কর্মসূচির অধীনে লেখাপড়া ও চাকরির সুযোগ পেয়েছে। এই বছর মার্চের মধ্যে এই কর্মসূচির সময়সীমা শেষ হবে। তার আগে এই প্রশ্নে মার্কিন কংগ্রেস কোনো ব্যবস্থা না নিলে এদের সবাইকে হয় যার যার দেশে ফিরে যেতে হবে অথবা অবৈধ হিসেবে এ দেশে বাস করতে হবে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, তিনি চান ‘ডাকা’র ফলে যাঁরা বৈধভাবে থাকার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁদের এ দেশে বৈধভাবে থাকতে দেওয়া হোক। তবে তিনি শর্ত জুড়েছেন, এর পরিবর্তে মেক্সিকো সীমান্ত বরাবর দেয়াল নির্মাণের যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন, তা পূরণের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা হোক। তিনি লটারির মাধ্যমে ভিসা বিলি ও পারিবারিক ভিসা ব্যবস্থা বাতিলেরও পক্ষে।

অভিবাসনবিরোধী অতি কট্টর কিছু সদস্য ছাড়া অধিকাংশ রিপাবলিকান ‘ডাকা’ প্রশ্নে একমত। এই কর্মসূচিভুক্ত তরুণ-তরুণীদের বৈধতা প্রদানের পক্ষে তাঁদের দ্বিমত নেই, কিন্তু সীমান্ত নিরাপত্তা বৃদ্ধি ছাড়া এই কর্মসূচি বৈধকরণে তাঁদের আপত্তি রয়েছে। অন্যদিকে ডেমোক্র্যাটরা চান কোনো শর্ত ছাড়াই ‘ডাকা’ সদস্যদের বৈধতা দেওয়া হোক। এর বদলে দেয়াল নির্মাণ বাবদ কোনো অর্থ বরাদ্দে তাঁরা প্রস্তুত নন।

বৃহস্পতিবার মার্কিন সিনেটের একটি দ্বিপক্ষীয় গ্রুপ উভয় পক্ষের দাবি মাথায় রেখে একটি মাঝামাঝি প্রস্তাব উত্থাপন করে। সে প্রস্তাব নিয়ে কথা বলতেই তারা হোয়াইট হাউসে এসেছিল। তিনজন রিপাবলিকান ও তিনজন ডেমোক্রেটিক সিনেটরের সমন্বয়ে গঠিত এই গ্রুপ ‘ডাকা’ভুক্ত তরুণ-তরুণীদের বৈধতা প্রদান ছাড়াও সীমান্ত নিরাপত্তা বাড়াতে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব করে। এ ছাড়া বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন এমন অভিবাসীদের পিতামাতা ও ভাইবোন ছাড়া অন্য কাউকে ‘পারিবারিক ভিসা’ বন্ধের সুপারিশ রয়েছে তাদের প্রস্তাবে। ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর ২০০১ সালে এল সালভাদর ও ২০১০ সালে হাইতি থেকে প্রায় ২ লাখ উদ্বাস্তু যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পায়, ট্রাম্প প্রশাসন তাদের ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে যার যার দেশে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। সিনেট গ্রুপের সদস্যরা এই উদ্বাস্তুদের একাংশ যাতে যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে পারে, তেমন একটি প্রস্তাব নিয়েও ট্রাম্পের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তাঁরা বর্তমানে চালু লটারি ভিসা বাতিল করে এই খাতে নির্ধারিত অভিবাসীদের হাইতি ও এল সালভাদরের মতো দুর্দশাগ্রস্ত দেশের জন্য সংরক্ষণের প্রস্তাব করেন।

জানা গেছে, এই আলোচনার সময় হাইতির নাম ওঠামাত্র ঘোর আপত্তি করেন ট্রাম্প। ‘এই সব জঘন্য দেশ থেকে আমাদের লোক নিতে হবে কেন,’ তিনি প্রশ্ন করেন। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী একাধিক ব্যক্তির বরাত দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, ট্রাম্পের এই মন্তব্যে উপস্থিত সদস্যরা হতবাক হয়ে পড়েন।

কোনো কোনো রিপাবলিকান পর্যবেক্ষক ট্রাম্পের মন্তব্যকে সমর্থন করে বলেন, তিনি বর্ণবাদী কোনো মন্তব্য করেননি, বরং আমেরিকার জন্য লাভজনক হয় এমন একটি অভিবাসন ব্যবস্থার পক্ষেই মত প্রকাশ করেন। হাইতির লোকেরা অশিক্ষিত, অন্যদিকে নরওয়ের লোকেরা উচ্চশিক্ষিত, সে কারণেই তিনি নরওয়ের কথা বলেছেন।

এই ব্যাখ্যায় সবাই খুশি নয়। ট্রাম্প অনেক আগে থেকেই তাঁর বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সুপরিচিত। নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি মেক্সিকানদের ‘ধর্ষক’ ও ‘মাদক পাচারকারী’ বলে সম্বোধন করেন ও সব মুসলিমের যুক্তরাষ্ট্রে আগমন নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করেন। অভিবাসন প্রশ্নে তিনি ইউরোপ থেকে অধিক সংখ্যায় অভিবাসী আগমনের পক্ষেও মত রাখেন। হাইতির সবাই এইডস রোগে আক্রান্ত ও নাইজেরীয়রা ‘পর্ণকুটিরে’ বাস করে, এমন কথাও তাঁর মুখ থেকে শোনা গেছে।

কারও কারও ধারণা, ট্রাম্প পরিকল্পিতভাবেই ‘জঘন্য দেশ’ মন্তব্যটি করেছেন। তিন দিন আগে হোয়াইট হাউসে দুই দলের কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে এক সাক্ষাতের সময় তিনি ইঙ্গিত করেছিলেন, ‘ডাকা’ প্রশ্নে তিনি কোনো শর্ত ছাড়াই আইনে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত। তাঁর সে মন্তব্য এক মিনিটের ব্যবধানে তিনি নিজে পাল্টে ফেললেও তাঁর অতি-কট্টর সমর্থকদের কেউ কেউ এই নমনীয় অবস্থানে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে তাঁর বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তোলেন। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, নিজের সমর্থকদের বাগে আনতেই ট্রাম্প হাইতি ও আফ্রিকাকে ঢালাওভাবে ‘জঘন্য দেশ’ উল্লেখ করেন।

ট্রাম্পের এই মন্তব্য ঘিরে ধূমায়িত বিতর্কের ফলে ‘ডাকা’ প্রশ্নে সম্ভাব্য সমাধান আড়ালে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই প্রশ্নের মানবিক দিকটি ব্যবহার করে উভয় পক্ষই নিজেদের জন্য সুবিধা আদায় করে নিতে চাইছে। এ মাসের ১৯ তারিখের মধ্যে সরকারি ব্যয় বরাদ্দ নিশ্চিত না করা গেলে কেন্দ্রীয় সরকারের অনেক কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাবে। সে বাজেট বরাদ্দের জন্য ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন লাগবে। সে জন্য রিপাবলিকানদের ওপর চাপ বাড়াতে ডেমোক্র্যাটদের কোনো কোনো সদস্য ‘ডাকা’ প্রশ্নের সমাধান ছাড়া ফেডারেল সরকার বন্ধ করে দেওয়ার পক্ষে। অন্যদিকে এই বিষয়টি ডেমোক্র্যাটদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জেনে রিপাবলিকানরাও তাঁদের ওপর নিজেদের শর্ত বেঁধে দিতে চাইছেন।

সর্বশেষ: ব্যাপক সমালোচনার মুখে ট্রাম্প আবার নিজের বক্তব্য থেকে সরে এসেছেন। গতকাল শুক্রবার এক টুইট বার্তায় তিনি বলেছেন, আফ্রিকা বা অন্য কোনো দেশকে তিনি জঘন্য বলেননি। আরেকটি বার্তায় ট্রাম্প বলেছেন, তিনি গুণাবলির ভিত্তিতে অভিবাসন চান।