ব্যর্থ, বিভক্ত ও সফল

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রথম বছর পূর্ণ করছেন ২০ জানুয়ারি। বছর শেষে এক জনমত জরিপ বলছে, ৫৩ শতাংশ মার্কিন নাগরিক মনে করেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প ব্যর্থ। তিনি সফল—এ কথা বিশ্বাস করেন মাত্র ৪১ শতাংশ মার্কিন নাগরিক। দেশটির ৬১ শতাংশ মানুষ মনে করেন, ট্রাম্পের সময়ে আমেরিকা আগের চেয়েও অধিক বিভক্ত হয়ে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।

ব্যক্তি হিসেবে বিতর্কিত ও সমালোচিত হলেও এই সময়ে নিজের অ্যাজেন্ডা পূরণে, বিশেষত অর্থনীতি ও রক্ষণশীল মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছেন তিনি। মার্কিন বিচারব্যবস্থায় রক্ষণশীল বিচারকদের নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে ট্রাম্প ইতিমধ্যেই গত অর্ধশতকে যুক্তরাষ্ট্র নারী-পুরুষের সমানাধিকার, পরিবেশ সংরক্ষণ ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যে অগ্রগতি অর্জন করেছিল, তা ঠেকিয়ে দিয়েছেন। অন্য কিছু না হোক, শুধু এই এক কারণেই ট্রাম্প তাঁর কট্টর সমর্থকদের কাছে একজন ত্রাতা। এই বৈপরীত্যের কারণে ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকার পাঠকেরা তিনটি শব্দে ট্রাম্পের প্রথম বছর ব্যাখ্যা করেছেন—বিশৃঙ্খলা, বিভক্তি ও সাফল্য।

নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয় ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। সাংবাদিক মাইকেল উলফের গ্রন্থ ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি অনুসারে তিনি জিতে গেছেন—এই খবরে খুশি হওয়ার বদলে ট্রাম্প ভীত হয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী মেলানিয়া কেঁদে ফেলেছিলেন। নিজেকে ‘একজন জিনিয়াস’ হিসেবে দাবি করলেও এই দায়িত্ব গ্রহণের জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলেন না ট্রাম্প। দায়িত্ব পালনে তিনি অযোগ্য, গত এক বছরে অজ্ঞতা, ভ্রম ও খামখেয়ালিপূর্ণ ব্যবহারের ভেতর দিয়ে ট্রাম্প প্রায় প্রতিদিন সে কথার প্রমাণ রেখে গেছেন।

নির্বাচনের আগে থেকেই নানা স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে পড়েন ট্রাম্প। তাঁর বিজয়ের পেছনে রাশিয়ার হাত ছিল, এই অভিযোগ নিয়ে প্রথম দিন থেকেই তাঁর ক্যাম্পেইন নিয়ে এফবিআইয়ের তদন্ত শুরু হয়। বিরোধী ডেমোক্র্যাটরা আঁতাতের অভিযোগে ট্রাম্পের অভিশংসন বা ইমপিচমেন্ট দাবি করেছেন। নিত্যনতুন আর্থিক ও নারীঘটিত কেলেঙ্কারির জন্যও দেশের ভেতরে ও বাইরে ট্রাম্পের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। গত সপ্তাহেই জানা গেছে, একজন ‘পর্নো তারকার’ সঙ্গে নিজের অবৈধ সম্পর্ক ঢাকতে নির্বাচনের আগে তিনি মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়েছিলেন। 

ট্রাম্প শুধু অযোগ্য নন, তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত। ক্ষমতা গ্রহণের আগে ট্রাম্প ওয়াল স্ট্রিটের ও ওয়াশিংটনের দুর্নীতি দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর ঠিক উল্টো কাজটাই করেছেন। একদিকে মন্ত্রিসভায় ওয়াল স্ট্রিটের ধনকুবেরদের স্থান দিয়েছেন, অন্যদিকে প্রধান নীতিনির্ধারণী ভূমিকা দিয়েছেন সাবেক জেনারেলদের। এমনকি স্টিভ ব্যাননের মতো শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদী ব্যক্তিকে প্রধান রণকৌশলবিদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। নির্বাচিত হওয়ার পরেও ট্রাম্প পারিবারিক ব্যবসা থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত করেননি। উল্টো হোয়াইট হাউসকে ব্যবহার করেছেন নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থে। সে কথা উল্লেখ করে ওয়াশিংটন পোস্ট মন্তব্য করেছে, ট্রাম্প সম্ভবত আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রেসিডেন্ট হবেন।

ট্রাম্পের বিজয়ের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল অভিবাসন প্রশ্নে তাঁর অবস্থান। জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের কারণে আমেরিকা ক্রমেই তার শ্বেত প্রাধান্য হারাচ্ছে—এই ভয় থেকে এ দেশে অভিবাসনবিরোধী মনোভাব তীব্র আকার ধারণ করেছে। এদের খুশি করতেই ট্রাম্প মেক্সিকানদের ধর্ষক বলেছেন, মুসলমানদের আগমন নিষিদ্ধের প্রস্তাব করেছেন, আফ্রিকান-আমেরিকানদের বলেছেন ক্রিমিনাল বা অপরাধী। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মেক্সিকোর সঙ্গে সে দেশের খরচে ২ হাজার মাইল লম্বা দেয়াল নির্মাণ করবেন। মাত্র গত সপ্তাহে হাইতি ও আফ্রিকার দেশগুলোকে ‘জঘন্য’ (তাঁর ভাষায় ‘শিট হোল কান্ট্রিস) বলে প্রবল বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন তিনি।

ব্যক্তি ট্রাম্প বিতর্কিত হলেও তাঁর অনুসৃত নীতির ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে, সে কথা মার্কিন নাগরিকদের দৃষ্টি এড়ায়নি। গত এক বছরে তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাংসদীয় সাফল্য ছিল করব্যবস্থার বড় ধরনের পরিবর্তন। বিরোধী ডেমোক্র্যাটদের দাবি, এর ফলে দেশের ধনীদের লাভ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এর ফলে যে অর্থনীতি অধিক সচল হয়েছে, এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ শেয়ারবাজারের রমরমা অবস্থা, ভোক্তাদের বর্ধিত আস্থা, বিনিয়োগ খাতে নতুন জোয়ার। কেউ কেউ এর নাম দিয়েছেন ‘ট্রাম্প বাম্প’ বা ট্রাম্পের ধাক্কা।

এই সাফল্যের জন্য অবশ্য আমেরিকাকে বড় ধরনের মূল্য চুকাতে হবে। নির্বাচনের আগেই ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ওবামা আমলে আরোপিত বিভিন্ন বিধিনিষেধ তিনি তুলে নেবেন। সে কথা তিনি রেখেছেন, ওবামা আমলে চালু করা প্রায় ২ হাজার নিয়ম-বিধি হয় বাতিল করেছেন বা স্থগিত ঘোষণা করেছেন। এর ফলে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ থেকে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সরকারি নজরদারি হ্রাস পেয়েছে।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বিধিনিষেধ শিথিল করার ফলে একদিকে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, পাশাপাশি অর্থনীতিতে বৃহৎ পুঁজির ক্ষতিকর প্রভাব বাড়ছে। বৃহৎ পুঁজি, বিশেষত তেল ব্যবসায়ীদের স্বার্থ মাথায় রেখে তিনি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে স্বাক্ষরিত জলবায়ু চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও উপসাগরীয় এলাকায় তেল-গ্যাস আহরণের অনুমতি দিয়েছেন, আদিবাসী আমেরিকানদের তীব্র আপত্তির মুখে তাদের সংরক্ষিত এলাকায় তেল-গ্যাসের পাইপলাইন স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। নিউ রিপাবলিক পত্রিকা লিখেছে, ট্রাম্পের গৃহীত ব্যবস্থার কারণে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নয়, সারা বিশ্বের পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। 

বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রেও ট্রাম্পের অবস্থান বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি ‘সবার আগে আমেরিকা’ নীতি অনুসরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই নীতির অর্থ ছিল বহুপাক্ষিকতা ও আন্তর্জাতিকতাবাদ থেকে আমেরিকার প্রস্থান। পরাশক্তি হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার ফল দাঁড়িয়েছে এই যে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে নেতৃত্বের আশা করে না। চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত মার্কিন প্রতিষ্ঠান গ্যালপের এক জরিপে বলা হয়, বিশ্বের মাত্র ৩০ শতাংশ মানুষ যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বের নেতা বলে মানে। একই জরিপে নেতা হিসেবে চীনের পক্ষে মত দিয়েছে ৩১ শতাংশ মানুষ।