পাতালপুরী কোথায়?

পাতালপুরীর হিরে জহরত, ধন দৌলত, রাজকন্যে—এ নিয়ে কত রূপকথা! কল্প কাহিনি! দৈত্য-দানব, রাজপুত্র। রোমাঞ্চকর জগৎ। সিনেমা হয়েছে পাতালপুরী নিয়ে। 

এই পাতালপুরী কোথায়? নিউইয়র্ক-লন্ডনের পাতাল রেল বা আরবের তেল খনি নয়। নয় অস্ট্রেলিয়ার ইউরেনিয়াম, ভার্জিনিয়ার কয়লা বা অ্যাঙ্গোলার সোনার খনি। কোথায় এ পাতালপুরী? এর অস্তিত্ব কি আছে?
আছে। সে কথাই বলেছিলেন বিনয় বাবু। বিনয় কৃষ্ণ দাস। বিশিষ্ট ‘চা কর’। আমীনাবাদ নুরজাহান চা বাগানের সুপারিনটেনডেন্ট। শুধু চা নয়, বাংলায়ও ছিল তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। সিলেট শহরের আম্বরখানার জ্যোতি মঞ্জিলে তাঁর প্রধান কার্যালয়।
১৯৭৩ সালের প্রথমদিকে প্রাচীনতম সাপ্তাহিক যুগভেরীতে প্রুফ রিডারের চাকরির জন্য দরখাস্ত করি। সম্পাদক আমীনুর রশীদ চৌধুরী ইন্টারভিউর দায়িত্ব দিলেন বিনয় বাবুর ওপর। কী কঠিন ইন্টারভিউ! তার ব্যক্তিত্ব আর পাণ্ডিত্যে আমি মুগ্ধ। সাক্ষাৎকার শেষে হাজির হলাম সম্পাদকের কক্ষে।
বুঝলাম, আমার চাকরি হয়েছে। পরবর্তী জীবনে বিনয় বাবুর স্নেহধন্য হয়েছি নানাভাবে। সত্তরোর্ধ বয়সেও তিনি ছিলেন চমৎকার স্বাস্থ্যের অধিকারী। নিয়মিত যেতেন চা বাগান পরিদর্শনে। সে সময় প্রাঞ্জল ভাষায় যুগভেরীর সম্পাদকীয় লিখতেন আমীনুর রশীদ চৌধুরী। কখনো কখনো আমাদের অনুরোধে লিখতেন বিনয় বাবু। সেটা হতো পাণ্ডিত্যপূর্ণ-বৈশিষ্ট্যময়। হারবাল চিকিৎসায় তাঁর ছিল প্রচুর জ্ঞান। ছোট খাটো অসুখ বিসুখে তাঁর পরামর্শে নিজে উপকার পেয়েছি বহুবার।
বিনয় বাবু ছিলেন স্বামী স্বরুপানন্দের একনিষ্ঠ ভক্ত। স্বামীজির অনুষ্ঠান পর্বে আমাকে আমন্ত্রণ জানাতেন। প্রকৃতি ও মানবপ্রেম বিষয়ে তাঁর ভাবনার কথা বলতেন। মনে পড়ে, গাছপালা বিষয়ে রেডিও বাংলাদেশের এক কথিকায় স্বরুপানন্দের উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম। ‘ভূত থাকে জঙ্গলে। সে জঙ্গল উজাড় করলে তারা থাকবে কোথায়? বসত বাড়িতেই চলে আসবে।’
বিনয়কৃষ্ণ দাসের জ্যেষ্ঠ পুত্র বিচারপতি বিজন কুমার দাস (বি কে দাস) শাহাবুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। কাজল নামের তাঁর আরেক পুত্র চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
১৯৮৯ সালের কথা। সপরিবারে ইমিগ্রান্ট হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে আসব। ভিসা-টিকিট নিয়ে অপেক্ষায় আছি। বিনয় বাবু তাঁর মির্জা জাঙ্গালের বাসায় আমি এবং আমার স্ত্রীকে নিমন্ত্রণ জানালেন। বাসায় গিয়ে দেখি মহা আয়োজন। বেগুন ও রুই মাছের ভাজি, খাসির মাংস, মাছ ও সবজির আট দশ রকমের রান্না। সু স্বাদু সব খাবার। বিনয় বাবু তাঁর স্ত্রীর পাশে বসে পরম সোহাগে আমাদের খাওয়ালেন। সব শেষে ছিল দধি, পায়েস, মিষ্টান্ন ও ফলফলাদি।
খাবার দাবার শেষে নানা বিষয়ে কথা বলছি। বিনয় বাবু বললেন, ‘আমরা পাতাল পুরীর কথা বলি, জানেন পাতালপুরী কোথায়?’ আমি হা করে তাকিয়ে থাকি। বললেন, ‘একটা গ্লোব সামনে নিয়ে বসুন। বাংলাদেশের মাটি খুঁড়ে নিচে যেতে থাকুন, যেতে থাকুন, যেতে যেতে কোথায় গিয়ে উঠবেন? যেখানে গিয়ে উঠবেন, সে জায়গার নাম “আমেরিকা”। এই আমেরিকাই হলো আমদের পাতালপুরী। ধনদৌলত, হিরে-জহরতে ভরা এই দেশ।’
বিনয় বাবু নেই। পরলোকগত। কিন্তু তাঁর পাতালপুরীর কথা আজও ভুলিনি। আমেরিকায় বসে কখনো ভাবি, বিনয় বাবুর কথার বিপরীতটাও হতে পারত। সেটা কেমন?
এই ধরুন, আমেরিকার মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে, নিচে যেতে যতে কোথায় গিয়ে উঠব? সে তো ‘বাংলাদেশ’।
রূপকথার আরেক পাতালপুরী। কিন্তু সেই ধনদৌলত, হিরে-জহরত কোথায়? হয়তো হবে একদিন, আজ না হোক কাল।

লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক।