শীত আর কুয়াশার গল্প

নিউইয়র্কে এখন প্রচণ্ড ঠান্ডা। ঠান্ডার সঙ্গে যোগ হয়েছে ঘন কুয়াশা। খুব ভোরে যখন কুইন্স ব্রিজ ধরে কর্মক্ষেত্রের দিকে যাত্রা করি, তখন দূরের চেনা ম্যানহাটনের উঁচু দালানগুলো যেন কেমন অচেনা হয়ে যায়। সড়কের গাড়িগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে যখন পাশ কেটে চলে যায় তখন রূপকথার সেই ফেইরি টেইলের গল্প চোখের সামনে ভেসে উঠে। মনে হয় আমি নিজেই বুঝি সেই রূপকথার এক নায়ক। কিন্তু যে শীত আর কুয়াশার স্মৃতি নিত্যই আমার মানসপটে ভেসে বেড়ায়, সেই শীতকে আমি হাজার চেষ্টা করেও আর খুঁজে পাই না। জানি শীতের কথা মনে হলেই আমার মতো অন্যদের সবার অন্তরাত্মায় কিছু নস্টালজিক স্মৃতি দোল খেতে শুরু করে। আহা! শীতকাল মানেই যেন এক উৎসবের মৌসুম। রঙিন ছেলেবেলার পরতে পরতে শীত নিয়ে কত স্মৃতি যে জড়িয়ে আছে তার কী কোন শেষ আছে!

আমাদের বাংলাদেশে গ্রাম বাংলায় শীত আসে চুপি চুপি অনেকটা ধীর পায়ে। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ির বড় বড় বাক্স বা আলমারির গহ্বর থেকে লেপ, কম্বল আর কাঁথা বীরদর্পে আমাদের মনুষ্য আঙিনায় প্রবেশ করতে শুরু করে। আহা! শীতের রাতে লেপের নিচে পাদুটো জড়সড় করে ঘুমানোর মতো আরাম পৃথিবীতে আর কী হতে পারে? স্পষ্ট মনে আছে, শীত আসার আগে থেকেই মা আমাদের ভাইবোন এবং বাবার গলার, হাতের, ঘাড়ের মাপ নিয়ে নিতেন। মাপ-ঝোঁক শেষ হলে তিনি হয়ে যেতেন ওলের সুতা দিয়ে সোয়েটার বোনার একজন ধ্যানী কারিগর। কথায়, চলনে-বলনে-আচরণে গার্হস্থ্য জীবনের সব কাজের পাশাপাশি তাঁর হাত দুটো থাকত সদা চঞ্চল, আঙুলগুলো হয়ে উঠত ক্ষিপ্রতার প্রতীক। স্পষ্ট দেখতে পেতাম কিছুদিনের মধ্যেই কত দক্ষতা আর শিল্পকে ধারণ করে মায়ের ধূসর রঙের উলের কাঁটা থেকে সোয়েটার বা মাফলারগুলো কত আদর আর ভালোবাসায় জড়াজড়ি করে আমাদের গায়ে উঠে আসত! এই স্মৃতি ভুলি কেমন করে? সত্যি, আমাদের দেশে শীত কতই না সুন্দর আর শৈল্পিক হয়ে আমাদের দরজায় টোকা দিয়ে যেত?
আরেকটা বিষয় ছিল, শীত মানেই পিঠা খাওয়ার এক মহাউৎসব। ইদানীং দেখতে পাই বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে গ্রামে রাস্তার ফুটপাথে গ্রাম বাংলার পিঠা নিয়ে অনেক দোকানপাট গজিয়ে উঠেছে। এটি সত্যি আশাব্যাঞ্জক এক খবর। তবে আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি পিঠা তৈরি জন্যে আলাদা করে চাল দাদির বাড়ি থেকে আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হতো। আম্মা সেই চাল কৃপণের মতো জমিয়ে রাখতেন শীতের সময় আমাদের পিঠা খাওয়াবেন এই আশায়। কত রকমের শীতের পিঠা! বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্রই তখন পিঠার উৎসবের ধুম পড়ে যেত। পিঠার নাম অঞ্চলভেদে একেক রকম। নাম দিয়ে কাজ কী? উৎসবের রং তো সবখানেই সমান! বাড়িতে মেহমান এলে পিঠাই ছিল সবচেয়ে ভালো আপ্যায়ন। শীতকালে কোন বাড়িতে বেড়াতে যাবেন আর সেখানে পিঠা খাবেন না, তাও কি হয়! এখনো স্পষ্ট মনে আছে, আম্মা শীতের সময় খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ভাপা পিঠা বানাতেন। ঢাকনা দেওয়া একটা বড় রুপালি রঙের হাঁড়ির মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধা। সেই কাপড়ে ভাপের তাপে তৈরি হচ্ছে সেই লোভনীয় পিঠা। সাদা গোলাকার সেই ভাপা পিঠার মাঝখানে থাকত খেজুরের গুড়। গরম-গরম পিঠা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের সবার ডাক পড়ত। তারপর আমাদের সবার মিলিত আনন্দে চলত সেই লোভনীয় পিঠা খাওয়ার উৎসব।
শীতের রাতে কেউ কি কখনো খেজুরের রস খেয়েছেন? মনে আছে সেই স্মৃতি? আমাদের গ্রামের বাড়িতে টুনু চাচার অনেক খেজুরের গাছ ছিল। দিনের বেলায় সেই খেজুর গাছ থেকে টপ টপ করে মাটিতে রস পড়ত। আমরা তখন আকাশের দিকে হাঁ করে সেই রস আস্বাদনের চেষ্টা করতাম। কখনো রসের ফোঁটা জিহ্বার ডগায় পড়ত, কখনো কখনো তা ভুল করে কপালেও পরত। আহা! কি সেই আনন্দ! তা কি মুখে প্রকাশ করা যায়? তবে একটা ঘটনার কথা খুব বেশি মনে আছে। গভীর রাত। গ্রামের কয়েকজন অতি উৎসাহী যুবক তখন আমাদের বাড়ির পেছনেই বিশেষ এক অভিযানের অপেক্ষায়। আমিও সে দলে ছিলাম। ঠিক মনে আছে। আমি তখন ঘুমের অভিনয় করে শুয়ে আছি। দেখতে দেখতে বাড়ির সব আলো নিবে গেল। তখন আমি লেপের নিচ থেকে মাথাটা বের করে মায়ের সদ্য বোনা সয়েটার গায়ে চড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে বের হয়ে গেলাম। সঙ্গে আব্বার পাঁচ ব্যাটারির টর্চ লাইটটি নিতে ভুললাম না। বাইরে এসেই দেখি আমার অপেক্ষায় টিপু, সরাফত, ফারুক, কামালসহ আরও কয়েকজন। তারপর সবাই গেলাম আমাদের পুকুরপাড়ে খেজুর গাছগাছের তলায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার। শীতের রাতে কুয়াশার চাদরে খেজুর গাছগুলোকে দেখলে তখন মনে হতো কোন ভৌতিক রাক্ষস-খোক্ষস জাতীয় কোনো কিছু। চোখের পলকেই টিপু, সরাফতসহ কয়েকজন গাছগুলোতে উঠে বেঁধে রাখা রসের কলসগুলো একে একে নামিয়ে আনল। তারপর শুরু হলো সেই কলস থেকে মধু আহরণ। কি ঠান্ডা সেই খেজুরের রস! আর কী অসম্ভব স্বাদ ছিল সেই রসে! ভুলি কেমন করে?
শীতের কুয়াশার কথায় আসি এবার। খুব ভোরে চেনা রাস্তার অলিগলিগুলো তখন সাদা কুয়াশায় ঢেকে যেত। খুব কাছের পরিচিত মানুষটাকেও তখন কত অপরিচিত মনে হতো! কণ্ঠ শুনে আমরা তখন ব্যক্তিটির পরিচয় জানতে পারতাম। তবে সবচেয়ে সুন্দর লাগত যখন নদীর ‍বুকে কুয়াশা নামত সেই দৃশ্য দেখে। দূরে মাছ ধরার ছোট ছোট নৌকাগুলোর হারিকেনের বাতি মিট মিট করে জ্বলতে দেখা যেত। কুয়াশার রঙের সঙ্গে সেই হারিকেনের বাতির রং মিশে কেমন যেন একটা নতুন রং তৈরি হতো। সেই রং তখন আমাদের আত্মাকেও রাঙিয়ে দিত। সেই সঙ্গে ছিল মাঝিদের হালকা হাঁকডাক। নদীর পানির ওপর যখন কুয়াশা ভেসে বেড়াত তখন মনে হতো কী যেন এক অশরীরী আত্মা পানির ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে।
নিউইয়র্কেও শীত নামে। কুয়াশার চাদরে গোটা শহর ডুবে যায়। কিন্তু কই? বাংলাদেশের মতো তো এখানে সেই শীতের ঘ্রাণ খুঁজে পাই না? বাংলাদেশে ফেলে আসা সেই কুয়াশাকেও আর দেখা মেলে না। কোথায় আমার সেই প্রাণের শীত আর মোহনীয় কুয়াশা? কেউ জানেন কী?