খারাপ বাবা

—ইস্পানুয়েল?
—নো, ইংলিশ! ওয়েল, কলিং সামওয়ান হু নোউজ স্প্যানিশ।
বাচ্চা দু’টো তিড়িংতাড়িং করে হাসতে হাসতে আমার পেছনে বোর্ডিং গেটের কাছে এল। আমার এক সহকর্মী তাদের গলায় ঝোলানো কার্ডটা দেখে নিয়ে তাদের পিতার সঙ্গে কথা বলে বুঝে নিল কে তাদের মায়ামি থেকে পিক আপ করবে! এবার বাচ্চা দুটো এগিয়ে এল বিদায় নিতে, ছোট ছেলেটা ৭ বছর, বড়টা দশ বছরের। ষোলো বছর বয়সের নিচে যারা একাকী ভ্রমণ করে তাদের বলা হয় ‘কোম্পানি মাইনর’। যে অভিভাবক তাঁর গন্তব্যস্থল থেকে কোম্পানি মাইনরকে গ্রহণ করবেন চেক ইনের সময় একটি ফরমে তার বিস্তারিত লিখে নেওয়া হয়। ফোনে কথা বলে যাচাই করে স্টেট আইডি দেখিয়ে তবেই নিতে হয় বাচ্চা যাত্রীকে। তিনটি পাতার একটি রাখা হয় যাত্রা শুরুর প্রান্তে, একজন এজেন্ট ফ্লাইট এটেন্ডেনটের স্বাক্ষর নিয়ে বাচ্চাকে বুঝিয়ে দেন এবং অপর প্রান্তে একই নিয়মে একজন কাস্টমার এজেন্টকে আবার তিনি বুঝিয়ে দেন। 

যাই হোক, হঠাৎ ছোট বাচ্চাটা তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। বড় ছেলেটাও এগিয়ে এল; তার চোখ থেকেও টপটপ করে করে পানি পড়ছে। মুখে সাহসের হাসি থাকলেও ততক্ষণে লোকটার চোখও লাল হয়ে এসেছে। আমার সামনে এক অসহায় পিতা। আমি বুঝে নিলাম উনি ভাগ হয়ে যাওয়া একজন খারাপ বাবাই না, উনি ভালোবাসা প্রকাশে ব্যর্থ একজন বাবাও। একজন পিতার জন্য সন্তানের চোখের পানি যে কত কষ্টের সে দৃশ্য কি কখনো দেখেছি? বাচ্চাগুলোর নীরব কান্না দেখে আমার মাথা ঘুরছে। আমার এত কাছে এসব ঘটছে যে আমার দ্বারা এ দৃশ্য সহ্য করা কষ্টকর হলো। নদীর ভাঙনের মতো কিছু আমার ভেতরে আঘাত করছে। সর্বনাশ, মানুষজনের সামনে আমার চোখ ভিজে উঠছে। এই লজ্জাকর অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমি আমার এলোচুলের শরণাপন্ন হলাম। যতটা সম্ভব মুখ ঢেকে রাখলাম। তারপর চোখের চশমাও কিছুটা রক্ষা করল। আস্তে করে মাফলার দিয়ে চোখের কোণ মুছে ফেলেছি। যদিও আমার খুব শব্দ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ততক্ষণে সেই সহকর্মী বাচ্চাটাকে আদর করে সান্ত্বনা চেষ্টা করছে। আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম স্প্যানিশ না জানার জন্য। কারণ এদের সান্ত্বনা দেওয়ার পরিবর্তে আমিও কেঁদে ফেলতাম। মুখ অন্যদিকে ঘোরাতে দেখি আরেক আফ্রিকান আমেরিকান মেয়ে, বোধ করি এগারো বছর বয়সের, বাপকে ধরে কাঁদছে। আজ একি হলো? আজ কি বিশ্ব পিতৃ দিবস? এ রকম একা বাচ্চারা আরও গেছে। কাউকে কখনো কাঁদতে দেখিনি। যে চোখের পানিকে আমি ভোর চারটা থেকে সংযত রেখেছি সে কেন এমন বেয়াড়া হয়ে উঠছে?
প্রকৃতি চায় মানুষ তার কষ্টের সময় কাঁদুক; তাই বুঝি সেই কান্না লুকিয়ে রাখা আরও বেশি কষ্টের। স্বাভাবিক থাকার ব্যর্থ চেষ্টা বুকের ভেতর সারাক্ষণ জানান দিতে থাকে সূক্ষ্ম ব্যথা হয়ে। এ সময়টা আশপাশে আপনজন কেউ থাকলে ভালো হতো কিন্তু অবুঝ তেরো বছরের মেয়ে ছাড়া আর কেউ কাছে নেই। কিন্তু সে ওই মুহূর্তে গভীর ঘুমে।
রাত চারটা বাজে তার ঘুমে থাকার কথা। জেগে থাকলেও যে তাকে ধরে কাঁদতাম তা কিন্তু না। বাচ্চা মানুষ, সঙ্গে সঙ্গে তখন মনে পড়ল আরেকজনের কথা। আমার বড়বোনের মেয়ে ঊর্মি। আমার কাছে খবর সাধারণত তার কাছ থেকেই আসে, তবে কি সে কোনো খবর পায়নি? তা কী করে হয়? তাকে কল দিলেও ভয়েস মেইলে চলে গেল। ফোন কি বন্ধ? আমি স্বাভাবিকভাবে চায়ের মগে চুমুক দিতে দিতে ফেইসবুকে ঢুকলাম। উদ্দেশ্য পরিস্থিতি বোঝা। সে জানে কি না!
প্রথমেই ‘অন দিস ডে তে’ আমার মেয়ের গানের ভিডিও ২০১৪ সালের,
‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে
এ জীবন পুণ্য করো দহন দানে।’
এই মুহূর্তে আমার সত্যিই একটা আগুনের পরশমণি দরকার যে সব কষ্ট ভুলিয়ে দেবে। সব পাপ মুছে পুণ্যে ভরে দেবে। দুঃখ প্রকাশ করে পরিচিত অনেকেই স্ট্যাটাস দিয়েছেন। একটু পরেই পেলাম ঊর্মির এক ঘণ্টা আগে প্রোফাইল ছবিতে কান্নারত একটা মেয়ের ছবি দিয়েছে, যাতে ইংরেজিতে লেখা, ‘When will I see you again?’
(আমি আবার কখন তোমাকে দেখতে পাব)
যার উত্তর, ‘কখনো না।’
মানুষ অতি শোকে উল্টাপাল্টা কাজ করে। সেও করেছে একটা দুঃখের প্রোফাইল পিকচার লাগিয়ে তার দুঃখটা সবাইকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে। অথচ সামাজিক মাধ্যমে মানুষজন ভুল বুঝে আবোলতাবোল কমেন্ট করার কথা কিন্তু তার ফ্রেন্ডলিস্টে অতি পারিবারিক সবাই আছে। তাই তাকে কেউ আঘাত করেনি এই বলে যে, ‘কোনো প্রেমিককে সে দেখার আশা ব্যক্ত করছে?’ পিতা-কন্যার সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি প্রেমের। একটা ২৫ বছরের মেয়ে যে কয়েক ঘণ্টা আগে থেকে তার জন্মদাতা পিতার মৃত্যুশোক একাকী বয়ে বেড়াচ্ছে ভিন দেশে। যে কোনো সন্তানের জন্য এটা খুব বেদনাদায়ক। বিদেশ না থাকলে আমিও বুঝতাম না, কি এক এলোমেলো কষ্ট! অনেকেরই তো এ রকম মা-বাবা মারা যান কিন্তু কাছে প্রিয়জন কেউ থাকে না। আমি থেকেও কিছু করতে পারছি না। প্রতিদিন মেসেঞ্জার ভরা ফানপোস্ট থাকে। আজ ফোন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম! আমার আরেক ভাগনে খবরটা দিয়ে রেখেছে। আমি দুলাভাইয়ের জন্য কি খুব বেশি আবেগাচ্ছন্ন? নাকি এই মেয়েটার জন্য? আরও ছেলেমেয়ে আছে। দুই ভাগনে কিছুদিন আগেই দেশে গিয়েছে। কারও কথাই তেমন মনে হচ্ছে না, শুধু এর কথা ভাবছি। আমার মধ্যে ক্রমশ এলোমেলো ভাব চলে আসছে।
কামরানের সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা হলো। কী স্বাভাবিক ভাবে বলছে, ‘বড় আপাকে সাদা শাড়ি দিয়ে এসেছি।’ কল্পনা করতেও চোখ ভরে উঠে। বড় আপার কি খুব বেশি বয়স? না, তবে দুলাভাইয়ের সঙ্গে অনেক ব্যবধান। মনে হলো বড় আপার লাল রং খুব পছন্দ, একটা লাল ছোট পাড় প্লেন কাতান শাড়ি ছিল, এখনো নিশ্চয় আলমারিতে রাখা আছে। লাল রং বড় আপার খুব প্রিয়। দুলাভাই কারও পিতা কারও ভাই কারও অন্য কিছু অথচ স্বার্থপরের মতো আমি বারবার বড় আপার কথা ভাবছি।
পিতৃহীন ঊর্মি, অনেক ছবির সঙ্গে, পিতৃহীন এই দু’বাচ্চা এবং আরও এক ছবি আমার চোখে ভেসে উঠল। যে বাপকে দেখার আশায় লাল হয়ে উঠত। যার জীবনের প্রথম কথা শুরু হয়েছিল, ‘বাপ বাপ’ বলে। অনেকটা রেলগাড়ির মতো না থেমে বলত, ‘বাপ বাপ বাপ বাপ’। মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে আমাকে অবাক করে দিয়েছিল আমেরিকা প্রবাসী বাবার জন্য টিভি বিজ্ঞাপন থেকে শেখা গান গেয়ে—
‘কাটে না সময় যখন আর কিছুতে
বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না
জানালার গ্রিলটাতে ঠেকাই মাথা
মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না
আয় খুকু আয় খুকু আয়’
যাকে আমি কখনো জীবনের ঘাত প্রতিঘাতের বিন্দুমাত্র দেখতে দেইনি। অসুস্থ পরিবেশ কাকে বলে সে জানেই না। সৌভাগ্যক্রমে পারিবারিক রাজনীতি, ঝগড়াঝাঁটি বিদ্বেষের সঙ্গে আমি নিজেই অপরিচিত। প্রাসাদ না রাখলেও রাজকুমারীর মতো যত্নে বড় করেছি। এক সময় আশায় আশায় থাকলেও সময়ে সে বুঝে গেছে বাবা জিনিসটা তার নয়। দাদার বাসায় প্রথম দিন তার মোনা ফুফুর কাছ থেকে শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর দিন ফেইসবুকে সালমান খানের দুই মায়ের সঙ্গে ছবি দেখে বলেছিল, ‘সালমান খানের দুই মা?’ আমি বলেছিলাম, ‘বিখ্যাত মানুষদের দুই মা থাকে...।’ সে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল। কথা হচ্ছে দুর্ভাগ্য সঙ্গ দিলে মানুষের কিছু করার থাকে না। আমার শাশুড়ি মৃত্যুর দু’দিন পূর্বে আমার কাছে নাকি ক্ষমা চেয়েছেন? আমার ক্ষমা দিয়ে কী হবে? যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। তবে বুঝলাম, যে তাঁর ছেলেকে ভালোবাসার অপরাধ উনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। উনি ক্ষমা চাইলেও সেতো দোষী। একজন খারাপ বাবা।
আমেরিকায় বাবা-মা ছাড়াও যে বাচ্চারা বড় হয় মেয়ে তা জানে। মানিয়ে নিয়েছে ব্যাপারটা। যদি কখনো কোনো অভিযোগ করত তবুও না-হয় বুঝতাম। কিন্তু কিছু বলে না, দেখা হলে মুখ টিপে হাসে, কিছু প্রশ্ন করলে হ্যাঁ-নাতে সীমাবদ্ধ। না উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে না দুঃখ, না এ রকম কোনো আবদার। ‘পৃথিবীতে খারাপ মানুষ অনেক আছে, কিন্তু একজনও খারাপ বাবা নেই’—এই ভুল কথা কেন হুমায়ূন আহমেদ লিখেছিলেন? যে সব বাবারা, যে কোনো কারণেই ভাগ হয়ে যায়, তারা খুব খারাপ বাবা। আমার মেয়ে কিছু না বললেও আমি বুঝতে পারি। সে দিন নিউজার্সিতে ফ্লোরা ভাবি কেন জানি বলছিলেন, ‘মরে গেলে সহ্য করা যায় কিন্তু থেকেও নাই এ জিনিসগুলো মানা যায় না।’ উনি নিজে খুব ছোটবেলা বাবা হারিয়েছেন। সেই অভাব নাকি এখনো বোধ করেন, যখন দেখেন, তাঁর মেয়েকে তার বাবা একটু বেশি আদর করেন। এমন ক্ষণ প্রতিটা বাবাবিহীন সন্তানের মাঝেই কাজ করে। আমি মাঝে মাঝে ভুলক্রম আমার বাবার কোনো কথা শুরু করলে পরে কথাটা ঘুরিয়ে ফেলি। কার জন্য এ বাচ্চাগুলো কষ্ট পায়? সব ক্ষেত্রে বাবারা হয়তো দায়ী নয়, তবে এই খারাপ বাবারা কোনো দিনও মন খুলে গাইতে পারে না,
‘আয়রে আমার কাছে আয় মামনি
সবার আগে আমি দেখি তোকে
...আয় খুকু আয়।’