শূন্যতার কাঁটাতারে শুয়ে আছেন কবি

মাহবুব হাসানের সর্বশেষ প্রকাশিত কবিতার বই শূন্যতার কাঁটাতারে শুয়ে আছি। বের করেছে কলকাতার আবিষ্কার প্রকাশনী। বইটি নিয়ে লিখব লিখব করে কেটে গেছে অনেক দিন। এরই মধ্যে আমি বইটি বেশ কয়েকবার উল্টেপাল্টে পড়ে ফেলেছি। লিখছিলাম না, এর পেছনে হয়তো খানিকটা দ্বিধা কাজ করছিল। কারণ, কবি মাহবুব হাসান বইটি উৎসর্গ করেছেন আমাকে এবং আমার স্ত্রী মুক্তি জহিরকে। মাহবুব অবশ্য এসব দ্বিধার তোয়াক্কা করেন না। তোয়াক্কা না করার জন্য প্রচণ্ড রকমের আত্মবিশ্বাসী হতে হয়। আমি নিশ্চিত নই আমার সেই পর্যায়ের আত্মবিশ্বাস আছে কি না।
শেষ পর্যন্ত যখন বসে গেছি, শূন্যতার কাঁটাতারে শুয়ে শুয়ে কবি মাহবুব হাসান কী করছেন, তা পাঠকের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করি। মানুষ যখন নিজেকে শূন্যে ভাসান, তখন তিনি হয় প্রচণ্ড হতাশায় নিমজ্জিত অথবা ঘোরের ভেতরে ডুবে থাকেন। কবি মাহবুব হাসানের মধ্যে দুটোই আছে। ঘোর ও হতাশা। হতাশা থেকে উৎসারিত উচ্চারণ, ‘আমাদের কোনো নদী নেই, জল নেই, পানির পিপাসাও নেই?/ কেবল আছে নোংরা বুড়িগঙ্গা আর আবর্জনার শীতলক্ষ্যা আমাদের/ আর আছে নদীগ্রাস,/ হাঁসফাঁস করা বালুমহালের টেক্কা-রুহিতন-হরতনের অবারিত খেলা!/ সারা বেলা! (আমাদের কোনো নদী নেই)’। শুধু হতাশাই বা বলছি কেন? এটাই কি আজকের বাস্তব চিত্র নয়? এটাই হয়তো কাব্য সাংবাদিকতা? ভূমিদস্যুদের বালুমহাল দখল, জল দখলের মহড়া কি প্রতিনিয়ত আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশের প্রধান শহর ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহরে? এই দৃশ্যই তুলে এনেছেন কবি।
আবার ঘোরের উচ্চারণ শুনি অন্য জায়গায়, ‘কোনো শব্দ হয় না আমাদের সেই পদচারণায়,/ নিঃশব্দে ডাহুক-ডাহুকি হেঁটে যায় অনন্তের পথে! (স্বপ্নের ভেতর)’। অনন্তের পথ থেকে তিনি তুলে আনেন এক অনিন্দ্য সুন্দরী রমণীকে, যার নাম ইয়ানা। ইয়ানার সঙ্গে তাঁর স্বপ্নের ভেতর বিয়ে হয়ে যায়। তিনি স্বর্গের সুখ লাভ করেন। স্বর্গের ঝরনাজলে অজু করে অপেক্ষা করেন ফজরের আজানের জন্য। এই চিত্রকল্প থেকে কবির চিন্তার জগৎকে আমরা আবিষ্কার করতে পারি। তিনি ধর্মভীরু একজন মানুষ। এই ভিন দেশের এক অনিন্দ্য সুন্দরীকে তিনি উপভোগ করেন বৈবাহিক সম্পর্কের ভেতরে এবং আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাতে অপেক্ষা করেন আজানধ্বনির। আজানের ধ্বনি শোনার জন্য তিনি কান পেতে আছেন বটে কিন্তু তাঁর ঠোঁট তখনো সেই রূপসীর উষ্ণ ঠোঁটে। আস্তিক্যবাদ কবিতাকে দুর্বল করে ফেলে যাঁরা বলেন আমি তাঁদের সঙ্গে একমত নই। কবিতার শরীরে এক স্বর্গীয় মায়া থাকা দরকার। কবিতা মানুষের হৃদয়ে স্বর্গীয় অনুভব তৈরি করে। বিশেষ করে কবির হৃদয়ে। আস্তিক্যবাদের মধ্য থেকে কবি যদি সেই স্বর্গীয় অনুভব পেয়ে যান এবং তৈরি করেন কিছু সুন্দর পঙ্‌ক্তি, যা মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করে, ক্ষতি কী? যখন মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি ৮০০ বছর পরও আমেরিকার সবচেয়ে বেশি বিক্রীত কবি, তখন কি করে বলি আস্তিক্যবাদ কবিতাকে দুর্বল করে। বরং ঈশ্বরের অপার রহস্য অনুসন্ধান কবিতাকে অন্য এক গভীরতার কাছে নিয়ে যায়, যা কবিতাকে করে তোলে চিরকালের।
নামকরণের ক্ষেত্রেও কবি বেশ মুনশিয়ানার স্বাক্ষর রেখেছেন। যেমনি গ্রন্থটির নামকরণে, তেমনি এর বেশ কিছু কবিতার নামকরণেও। কয়েকটি কবিতার নাম এখানে উল্লেখ করি ‘রোদের মুখ’, ‘ঘুমকে আমার পাহারায় রেখে’, ‘সময় ফুঁড়তে ফুঁড়তে’, ‘বৃষ্টির আয়াত’, ‘এক স্বপ্নদ্রষ্টা পাখি’, ‘তুমি খেলছ চন্দনা যেমন খেলে আকাশ’, ‘পাখিদের কোনো বন্দুক নেই’, ‘মুহূর্ত ভেঙে’ ইত্যাদি।
কবির ব্যক্তিগত আর্থিক-সামাজিক অবস্থান, রুচি-অভ্যাস জানা থাকলে তাঁর কবিতা ব্যাখ্যা করা কিছুটা সহজ হয়। মাহবুব হাসানের সঙ্গে আমার নিবিড় সখ্য তাঁর প্রতিটি কবিতার অর্থ আমার কাছে স্পষ্ট করে তোলে। বইটি পড়তে পড়তে আমি খুঁজে পাই প্রতিদিনের দেখা মাহবুব হাসানকে। একজন মানুষ তাঁর জামার পকেটে আকাশ নিয়ে ছুটছেন ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টক্লেয়ার সিটি, পমোনো থেকে আড়াআড়ি তিন হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে নিউইয়র্কের কুইন্সে। সেই আকাশে যেমন শূন্যতার কাঁটাতার আছে, তেমনি আছে আদিগন্ত বিস্তৃত স্বপ্ন। এই স্বপ্ন ও শূন্যতায় চার-পাঁচ বছর ধরে ঝুলে আছেন কবি মাহবুব হাসান। তিনি প্রতিদিন দেখেন স্বপ্নের ফুল অঙ্কুরিত হচ্ছে ম্যানহাটনে, জ্যামাইকায়, জ্যাকসন হাইটসে। আবার এই শহরে রাত নামে, তুষারপাত হয়। স্বপ্নেরা অন্ধকারে ঢেকে যায়। তখন তিনি অন্য চোখ মেলেন। দেখেন, ‘ঝাপ্পুরি খেলছে কিশোর কিশোরী/ এক বহমান মেঘের জলে! সেখানে কোনো স্রোত নেই কিন্তু আকার তার স্রোতস্বিনীর/ আমি এই সব দেখতে দেখতে তর্কের বারান্দায় গিয়ে উঠি/ আর সঙ্গে সঙ্গে হাসনাহেনা ফুলের বাসনা পাই, দেখি/ বিরিয়ানির ম ম ঘ্রাণ উঠে আসছে কোনো এক গহন রহস্য থেকে/ আমার পেট ক্ষুধায় পাক দিয়ে ওঠে/ (নিরাকার আঁধার ভেদ করে)’।
ধর্ম সম্পর্কে মার্ক্স বলেছেন, অসহায় মানুষের ভরসা। অর্থাৎ যখন সেসব হারিয়ে ফেলে তখন ধর্মের কাছে আশ্রয় নেয়, এতে তার কষ্ট লাঘব হয়। কবি যখন স্বপ্ন হারিয়ে ফেলেন, তখন তিনি কার কাছে হাত পাতেন? আমরা দেখি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহর যখন কবিকে কিছুই দেয় না, দিনের শেষে হতাশায় নিমজ্জিত না হয়ে তিনি ফিরে যান তাঁর ঝাপ্পুরি খেলার দিনগুলোতে। এই স্মৃতির জানালা তাঁর অন্ধকার ঘরে আলো জ্বেলে দেয়, সেই আলোতে তিনি দেখতে পান বহুদূরের আনন্দময় উজ্জ্বল কৈশোর দিন। এতে তিনি উজ্জীবিত হন এবং নতুন স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমি সবুজ ভালোবাসতে বাসতে আকার পেতে থাকি/ আমি আরেকজন মানুষ হয়ে উঠি।’
মাহবুব হাসান সত্তরের দশকের কবি, একজন মুক্তিযোদ্ধা। স্বভাবতই তাঁর কবিতা উচ্চকিত হওয়ার কথা, প্রতিবাদী হওয়ার কথা। প্রতিবাদ তাঁর কবিতায় আছে বটে। কিন্তু এই গ্রন্থে তা এসেছে বেহাগের সুরের মতো, স্লোগানের বা রাইফেলের গর্জনের মতো নয়। মাহবুব হাসানের মতো পরিণত কবিদের দিকে তরুণ কবিরা তাকিয়ে থাকেন নতুন কোনো দিকনির্দেশনার জন্য। কেমন হওয়া উচিত আগামী দিনের কবিতা, এই ইঙ্গিত মাহবুব হাসানরা না দিলে কে দেবেন? এই গ্রন্থে আমরা তার কিছু ইঙ্গিত পেয়েছি কবিতার নামকরণে, কিছু ইঙ্গিত পেয়েছি শব্দচয়নে অপ্রমিত এবং সাহিত্যে অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহারে। তিনি আমাদের এই ইঙ্গিত দিচ্ছেন, কোনো শব্দই কবিতার জন্য অনুপযুক্ত নয়, যদি কবি এর সঠিক প্রয়োগ করতে পারেন।