ব্রুস ট্রেইল

১৩ বছরের জাকওয়ান থাকে কানাডার একটি আধা গ্রাম আর আধা শহরে। ক্লাসে জাক নামেই সে বেশি পরিচিত। তাদের এলাকায় প্রায় ৩০ হাজার মানুষের বাস। ডাউন টাউন বলে একটা এলাকা আছে বটে। নিজস্ব একটা সিটি করপোরেশন ভবনও আছে। তবে ওই পর্যন্তই। সবচেয়ে উঁচু ভবনটি মাত্র চারতলা। ডাউন টাউনের আশপাশের কিছু এলাকা ছাড়া কোথাও সড়কবাতি নেই, এমনকি ডাউন টাউনের বাসাগুলোতেও বড় বড় সব উঠোন। আর ডাউন টাউন ছেড়ে একটু ডানে বা বাঁয়ে নামলেই সব অ্যাক্রেজ, মানে কয়েক একর এলাকাজুড়ে বড় বড় সব গ্রাম্য বাড়ি। অনেক বাড়ির সামনেই ঘোড়া বা গরু চরতে দেখা যায়। হেক্টরের পর হেক্টর জুড়ে খেত-খামার অথবা ঝোপঝাড়। কোথাওবা বিশাল এলাকাজুড়ে সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এসবের কারণেই স্থানীয় লোকেরা একে আদর করে গ্রামই বলে। এই গ্রামের একদিক দিয়ে মহাসড়ক চলে গেছে, আর অন্যদিকে একটা পায়ে হাঁটা মেঠোপথ—ব্রুস ট্রেইল। এটা তো বনবাদাড়ের পাহাড় পর্বতের আর খাল–বিলের দেশ। ব্রুস ট্রেইলটা এই গ্রামের কাছে এসে বনবাদাড়ের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। মেঠো পথ যখন বনবাদাড়ের ভেতর দিয়ে গিয়েছে তখন সেটাতে অনেক অজানা আশঙ্কা আর উত্তেজনার সংমিশ্রণে মনটা উন্মুখ হয়ে ওঠে। বন এতটাই গভীর! গ্রাম ছেড়ে একটু সামনে গিয়ে পথটা যখন পাহাড় আর উপত্যকার ভেতর দিয়ে গিয়েছে, সেখানে নৈসর্গিক সৌন্দর্যে চোখের পাতা পড়ে না। আর খাল-বিলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মেঠোপথটা তো মানুষকে টেনে পানিতে নামিয়ে ছেড়েছে।
জাকের সঙ্গে বন্ধু মার্ক ক্লাস এইটে পড়ে। দুজনের মধ্যে অনেক মিল। সুযোগ পেলেই সাইকেল নিয়ে এদিক-সেদিক হাওয়া। এমন কোনো পাড়া নেই, যেখানে তাদের বন্ধু নেই। তাদের ক্লাসের প্রিয় বান্ধবী আমতা। স্কুলের কাছেই থাকে। কোনো এক অজানা কারণে সেই হলো ক্লাসের মধ্যবিন্দু। বিকেল বেলা তার বাসাতেই সবাই আড্ডা জমাতে আসে। জাক আর মার্কের স্কুলটা অবশ্য তাদের পাড়া থেকে একটু দূরেই। প্রতিদিন সকালে স্কুলবাস সবাইকে যার যার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় আর ফেরত দেয় পড়ন্ত বিকেলে। এভাবে ঘুরে ঘুরে স্কুলবাসে যেতে তাদের প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে, আবার আসতেও লাগে আরও এক ঘণ্টা সময়। সেদিন মার্ক বলল, আমি না গুগল ম্যাপ দেখে বাসায় ফেরার একটা শর্টকাট পথ আবিষ্কার করেছি। চল স্কুলবাসে বাসায় না ফিরে আমরা বরং হেঁটে বাসায় ফিরে যাই। বেশি তো দূর না, শর্টকাটে গেলে মাত্র চার কিলোমিটার পথ। যেই বলা সেই কাজ, শুরু হলো বাসায় ফেরার শর্টকাট পথ খোঁজা। উঠতি বয়সে আবিষ্কারের নেশা তো বড় শক্ত জিনিস। প্রথম দিন পথ হারিয়ে এরা কিছুটা নাস্তানাবুদ হলো ঠিকই, কিন্তু শর্টকাট রাস্তাটা একসময় ঠিকই পেয়ে গেল। প্রথম কিছুটা পাকা সড়ক তারপর ব্রুস ট্রেইল ধরে গেলেই সবচেয়ে ভালো। বাসায় ফেরার এই শর্টকাট পথের প্রায় দুই কিলোমিটার পথ ব্রুস ট্রেইলের মধ্য দিয়ে গেছে। মাঝখানে আবার ট্রেইলটা একটা পাহাড়ি ঝরনার পাশাপাশি অনেক দূর চলে গেছে।
এই গ্রামের বেশ কয়েক বর্গকিলোমিটার সংরক্ষিত বনাঞ্চল। এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সুন্দর কিছু জলপ্রপাত। সবই ৫০–৬০ ফুটের মতো উঁচু। হাজার হাজার গ্যালন পানির একসঙ্গে পড়ার শব্দ বেশ কিছু দূর থেকেই শোনা যায়। ট্রেইলটা এখানে এসে বনের ভেতর দিয়ে বিভিন্ন জলপ্রপাত ছুঁয়ে-ছুঁয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। কোনো কোনো জায়গায় ট্রেইলটা পরিষ্কার নুড়িপাথর বিছানো আবার ছোট ছোট ঝোপে ঢেকে গেছে ট্রেইলের কিছু অংশ। হাঁটার সময় বোঝার উপায় নাই কোনটি সেই মেঠোপথ আর কোনটি জঙ্গল। দূরে দূরে গাছে সাদা দাগ দেখে নিজেকে পথ খুঁজে নিতে হয়। এই ট্রেইলের ভেতর কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যেতে কার না ভালো লাগে। জাকের সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে স্টিফিনি নামের জলপ্রপাতটা। এটা তাদের বাসা থেকে হাঁটাপথের ভেতরেই। প্রায় ৭০ ফুট উঁচু এই জলপ্রপাতের যেখানে হাজার হাজার গ্যালন পানি প্রতিনিয়ত পড়ছে, সেখানে একটা পুকুরমতো তৈরি হয়েছে। তারপর একটা চিকন ঝিরিঝিরি নালা। এই নালায় ট্রাইওপস নামের একধরনের আদিম প্রকৃতির চিংড়ি মাছের ছড়াছড়ি। নালার ঠান্ডা পানিতে পা ডুবিয়ে ছোট ছোট এসব চিংড়ি মাছ দেখতে জাকের খুব ভালো লাগে।
শুরু হলো দুই বন্ধুর প্রতিদিন হেঁটে বাসায় ফেরা। ট্রেইলের কাছে আসতে না আসতেই তাদের কল্পনায় প্রকৃতি আর বাস্তবতা নিজেদের গা ঘষতে শুরু করে। ট্রেলের ভেতর যেতে না যেতেই দুজনই এক প্রশান্তির দেশে হারিয়ে যায়। স্টিফিনি ফল পর্যন্ত আসার অনেক আগেই ব্রুস ট্রেইলটা তিরতির করে বয়ে যাওয়া এক ঝরনার পাশ ধরে বহুদূর চলে গেছে। সেই ঝরনার পাশেই ইয়া মোটা এক উইলো গাছ পানির ওপর ঝুঁকে আছে। গাছটার ঝাঁকড়া পাতাগুলো যেন পানি ছুঁতে চায়। মার্কই প্রথম সেই গাছটা দেখতে পেল। আর দেখামাত্র গাছের ওপর একটা চৌকি বানানোর আইডিয়া মাথায় এল। জাক তো এক নজর দেখেই সেই আইডিয়াতে রাজি। সেই গাছের ওপর তারা দুই বন্ধু মিলে একটা তক্তা মতো বানাল। তক্তাটা পানির এতই কাছাকাছি যে বসলে মনে হয় যেন পানির ওপর ভাসছি। শান্তিতে লুকিয়ে থাকার মতো একটা জায়গা বটে। কোথাও কেউ নেই। পানির কুলকুল ধ্বনি আর বাতাসের ঝিরঝির শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। মাঝে মাঝে অবশ্য নাম না-জানা কিছু পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। অগভীর স্বচ্ছ পানিতে কিছু ছোট্ট মাছ ঘোরাফেরা করছে।
আজ শনিবার। তাই জাকের বাবার জন্য এটা একটা ব্যস্ত দিন। শনিবার অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ সবই বন্ধ। আজকের দিনটা খুবই সুন্দর। ঝলমলে রোদ আর মিষ্টি মৃদুমন্দ বাতাস। বাইরে কাজ করার জন্য এসব দিনই আদর্শ। সামার শেষ হয়ে আসছে। অনেক দিন ধরে ঘরের সামনের লনের ঘাসগুলোর তেমন একটা যত্ন নেওয়া হয় না। বাসার সীমানা ঘিরে বেশ কিছু ফুল গাছ। ফুল গাছগুলো বেয়াড়াভাবে এদিক–সেদিক বেঁকে যাচ্ছে দেখে জাকের বাবা হাত করাতটা খুঁজতে লাগলেন। ঘরের কোথাও পেলেন না, ছোট কুড়ালটাও নিখোঁজ। এদিকে ছেলে আবার ইদানীং প্রায়ই একটু দেরি করে স্কুল থেকে বাসায় ফিরছে। সন্দেহ তো একদিকেই যায়। বাবা ছেলেকে ডেকে বললেন, ইদানীং তুমি মনে হয় একটু ব্যস্ত। তোমার গোপন প্রোজেক্ট সম্পর্কে কিছু কি জানতে পারি? জাক উনাকেতাদের গোপন ডেরা দেখাতে নিয়ে গেল। ব্রুস ট্রেইলেরই আরেকটা শাখা পথ ধরে প্রায় দেড় কিলোমিটার বনের ভেতরে হেঁটে তারা সেই বিশাল উইলো গাছটাতে পৌঁছাল। পানি ছুঁইছুঁই সেই মাচা দেখে বাবা বললেন, কে কে মিলে এটা বানিয়েছ। জাক তার বন্ধুর নাম বলল। তিনি মার্ককে চিনলেন, একই পাড়ার ছেলে, তার ছেলের মতোই আরেকটা গেছো বাঘ। কখন বানিয়েছ? প্রতিদিন স্কুলের পরে, একটু একটু করে। বাবা এবার পরিষ্কারভাবে তাঁর টুলবক্সের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির হারিয়ে যাওয়ার রহস্য বুঝলেন। এখানে যে নেকড়ে থাকতে পারে জানো? জাক মাথা নেড়ে প্রবল প্রতিবাদ জানাল। বুঝলেন এভাবে কাজ হবে না। বাবা ছেলেটার হাতটা ধরে পানি বরাবর হাঁটতে লাগলেন। এখানে–সেখানে চোরা কাদা। কোথাওবা ঝরনার পাড়ে বালু জমে অনেক জায়গাজুড়ে বালিকাময় হয়ে আছে। ওরা দুজন সাবধানে চোরা কাদা এড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। চোখ মাটিতে নিবদ্ধ। কানগুলো কিন্তু টান টান করে দুই দিকে খোলা আছে। বিশেষ করে দূরে যে ব্ল্যাক কেপ চিকাডিগুলো ডাকছে, সেগুলোর প্রতি বাবা বেশ মনোযোগ দিচ্ছেন। চিকাডিগুলো চড়ুই পাখির মতো ছোট হলেও বড়সড় জন্তুদের প্রতি এদের বড়ই নজর। তেমন কিছু দেখলে এরা চিৎকার দেবেই। কাছেই অবশ্য কয়েকটা রবিন বেরিফল খেতে ব্যস্ত। এটা একটা বিরাট সান্ত্বনা। রবিন পাখির চোখ ভীষণ প্রখর। সামান্য বিড়াল দেখলেই এরা হুলুস্থুল শুরু করে দেয়। বেশি দূর যেতে হলো না। পানির পাশে পাশে বিভিন্ন জন্তুর পায়ের ছাপ। এই যে হরিণের পায়ের ছাপ। এখানে একটা মা হরিণ তার বাচ্চাকে নিয়ে পানি খেতে এসেছিল। একটু দূরেই অনেক খরগোশের পায়ের ছাপ। ওরা দল বেঁধে পানিতে এসেছিল। দুজন আরও এগোতে লাগল। এবং পেয়েও গেল। একটা নিঃসঙ্গ হরিণের পায়ের ছাপ আর তারই পেছন পেছন পানি পর্যন্ত আরেকটা ভিন্ন ধরনের পায়ের ছাপ। বাবা পরিষ্কারভাবে এখানে ঘটে যাওয়া নাটকটা পড়তে পারছেন। একটা হরিণ পানি খেতে এসেছিল। কাছে কোথাও লুকিয়ে ছিল একটা নেকড়ে বাঘ। নেকড়েকে দেখে ভয় পেয়ে হরিণটা লাফিয়ে ঝরনা পেরিয়ে উল্টো দিকে পালিয়ে যায়। নেকড়েটাও পিছু পিছু একই পথ ধরে হরিণকে অনুসরণ করে বনের ভেতর হারিয়ে যায়। জাকের কিন্তু ‍সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদ। বাবা এটা নেকড়ের পায়ের ছাপ হতেই পারে না, এটা একটা কুকুরের পায়ের ছাপ। একটা বড় কুকুর। তুমি চিড়িয়াখানায় নেকড়ে দেখনি। এটা যদি নেকড়ে হতো, তবে তো তার পায়ের ছাপ এত বড় হতো। ছেলে তার হাত গোল করে দেখায়। বাবা এবার হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করলেন, এভাবে কাজ হবে না। সব বয়সের দোষ। এরা তরুণ ছেলে। এরা তো বনেবাদাড়ে যাবেই। গাড়ির হেডলাইট থেকেও পাওয়ারফুল বাবার টর্চটা তো আগেই সে দখল করেছিল। এবার তাই বাসায় এসে বাবা তার ডগ স্প্রেটা আর দামি হান্টিং নাইফটা ছেলের হাতে দিলেন। ডগ স্প্রে নেকড়ের ওপর ভালোই কাজ করে। তবে কথা দিলেন শিগগিরই একটা ভালো এয়ার হর্নও কিনে দেবেন। বিপদে পড়লে এয়ার হর্ন এসওএস হিসেবে ভালো কাজ করে। এটার শব্দ আসে পাশের লোকালয় থেকে ঠিকই শুনতে পাওয়া যাবে। ছুরির জন্য শর্ত রইল একটাই, ছুরিটা বাবার কাছেই থাকবে। স্কুলের পরে মাঝে মাঝে শুধু বিকেল বেলার জন্য এটা তার হাতে পাবে।
এটাই জীবন। ১৩ বছরের ছেলে ১৩ বছরে ছেলেদের মতোই। বিপদ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। স্বভাবতই কৌতূহলী। ভীষণ প্রাণবন্ত আর উদ্যমী। জন্মগতভাবে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। দিন-দুনিয়ার খবর নেই, ঘাস–লতাপাতায় সময় যায়। একদিন এর ১৮ হবে, একদিন ২৫। সেদিন কি তাদের প্রকৃতির সঙ্গে এই ভালোবাসা টিকে থাকবে!