হিটলারের কসাইখানায়

ডাকাও ক্যাম্পের বন্দীদের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য
ডাকাও ক্যাম্পের বন্দীদের স্মরণে নির্মিত ভাস্কর্য

ডিসেম্বরের প্রথম দিকে বেলজিয়াম থেকে নতুন একজন শিক্ষক এলেন নেটওয়ার্কিং শেখাতে। পিটার গ্রস নামের এই ভদ্রলোক জার্মানদের মতো নন। যদিও তাঁর পৈতৃক নিবাস ব্যাভারিয়ারই কোনো এক শহরে। কিন্তু তিনি নিজেকে জার্মান বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন না। একদিন বললেন, যদি একদিন ডাকাও ঘুরে আসতে, তাহলে বুঝতে পারতে আমি নিজেকে কেন জার্মান ভাবি না। আমি বললাম সেখানে ঘুরে আসার দরকার কী? তুমি তো বেলজিয়ামে থাকো, তুমি জার্মান হতে যাবে কেন?
- জন্মসূত্রে আমি জার্মান।
- কতজনই তো পরে ভিনদেশের নাগরিক হয়!
- আমারটা সে রকম নয়। আমি এখনো বেলজিয়ামের নাগরিকত্ব নিইনি। জার্মানি আমার দেশ। তারপরও কিছু কথা থাকে। ডাকাওতে হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প আছে।
- আছে মানে!
- ছিল আরকি, এখন সেটা মেমোরিয়াল। সুযোগ পেলে দেখে এসো, তারপর কথা হবে।
ব্যস, মাথার মধ্যে ডাকাও ঢুকে গেল। রুমন, এনায়েত, রাকিব রাজি। মিউনিখ থেকে ১৯ কিমি দূরে ডাকাও। পাতালরেল ইউবান চলে না। আমাদের যেতে হবে এসবানে। এসবান মানে স্নেলচুক বান, শম্বুকগতির ট্রেন, সময় লাগে ২২ মিনিট। ইউবানের প্রায় দ্বিগুণ। ভালো দিক হচ্ছে মাটির ওপর দিয়ে চলে, দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে। ডাকাও স্টেশন থেকে ৭২৬ নম্বর বাস যায় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। ২৪ ডিসেম্বর ছাড়া প্রতিদিনই নয়টা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত খোলা থাকে ডাকাও কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। আমরা ঠিক করলাম শনিবারে যাব।
ইউবান স্টেশনের মতো ঝকঝকে নয় এসবান স্টেশন। হফবানহপের (সেন্ট্রাল স্টেশনের) সঙ্গে লাগোয়া হলেও কাগজের টুকরা পড়ে থাকতে দেখলাম প্ল্যাটফর্মে। ফারের জ্যাকেট মোড়া তিনজন সুন্দরী চিপসের প্যাকেট খুলে একটা–দুটো মুখে দিচ্ছে, এটি সম্ভবত তাদেরই অবদান। ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্য, দস্তানা টুপি কিছুই বাদ দিইনি আমি। ট্রেন আসার সময় এক দমকা বাতাসে আমার আমার চকচকে টাক মাথার বুড়োটে চেহারা উন্মুক্ত করে টুপি উড়ে গেল তাদের পায়ের কাছে। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনজনই হেসে উঠল হা হা করে। একজন দয়া করে উঠিয়েও দিল টুপিটা। এই সুন্দরীদের সামনে এভাবে বেআব্রু হওয়ায় আমি বিব্রত, তবু ভদ্রতা বজায় রাখার জন্য বললাম ডাঙ্কেশুন। মেয়েটি বলল, ‘ওয়েলকাম। আমি জার্মান নই।’
অপরিচিতদের সঙ্গে আলাপচারিতায় আমি পারদর্শী নই। বললাম, ‘ও।’
সে বলল, ‘আমি শ্যারন, আয়ারল্যান্ড থেকে বেড়াতে এসেছি, তোমরা ডাকাও যাচ্ছ?’
ততক্ষণে আমার জড়তা খানিকটা কেটেছে। বললাম, ‘তোমরা?’
- আমরা পিটার হাউসেনের দিকেই যাচ্ছি, কিন্তু তোমাদের আগে নেমে যাব।
- পিটার হাউসেন?
- এই ট্রেনটা পিটার হাউসেন পর্যন্ত যায়। সম্ভবত ৯টা স্টেশন পরে ডাকাও, মেমোরিয়ালে যাবার জন্য সবাই ওখানেই নামে।
আর কিছু বলার আগেই আমরা ট্রেনে উঠে গেলাম। সকালের দিকে ইউবানে যেমন ভিড় থাকে, এসবানে ভিড় তার চেয়ে কম। কোথাও গ্রাম, কোথাও শহরের মধ্য দিয়ে যেতে থাকল ট্রেন। ২২ মিনিটের মাথায় ট্রেন থামল ডাকাও।
ছিমছাম এই স্টেশনের মেইন এক্সিটের সামনে দিয়ে একটি ফুটপাত গিয়েছে মেমোরিয়াল সাইট পর্যন্ত। সেই পথে গেলে প্রায় পঞ্চাশ মিনিট হাঁটতে হবে। তাই বাসে উঠলাম স্টেশনের সামনের বাসস্টপ থেকে। এখান থেকে ৭২৪ আর ৭২৬ নম্বর বাস যায় মেমোরিয়ালে। ট্রেনের যাত্রীদের নতুন করে টিকিট কাটা লাগে না। দশাসই এক চালক ছাড়া বাসে আর কোনো লোক ছিল না। তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে দেখলেন কি দেখলেন না, তাঁর ঘন ভ্রুর জন্য তা বোঝা গেল না। ১০ মিনিটের মাথায় বাস থামল পিটাররোজ রোডে, ডাকাও মেমোরিয়েল স্টপেজে। এখান থেকে বাঁ দিকে একটা পাকা রাস্তা চলে গেছে জোরহাজ (গার্ড হাউস) পর্যন্ত। জোরহাজে ঢোকার আগে একটি ছোট্ট অফিসের মতো, এখানে কফিটফি পাওয়া যায়, যাঁরা গাইডেড ট্যুরে যেতে চান তাঁরা এখানে যোগাযোগ করতে পারেন। ডাকাও–বিষয়ক বইপুস্তকও পাওয়া যায় এখানে।
বাইরে কুয়াশা ঢাকা দিন, সূর্যের আলো ঘোলাটে আলোয় মেমোরিয়ালের প্রবেশদ্বার বেশ দূরে মনে হচ্ছিল। গার্ড হাউসটাকে মনে হচ্ছিল টালিতে ছাওয়া একটা দোতলা বাড়ির মতো। পাকা রাস্তার সমান্তরাল একটি পুরোনো রেললাইন রাস্তার বাঁ দিক ঘেঁষে গার্ড হাউস পর্যন্ত গিয়েছে। এই পথে ডাকাওয়ের বন্দীদের ওয়াগানে চড়িয়ে কাজে পাঠানো হতো বিভিন্ন কারখানায়। গার্ড হাউসের নিচে লোহার গরাদের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম আমরা। গার্ড হাউস দিয়ে ঢুকে হাতের ডানে কয়েক কদম হাঁটলেই থার্ড ব্র্যাকেটের মতো একটি বিল্ডিং। নাৎসি আমলে এটি ছিল মেইন্টেন্যান্স বিল্ডিং। এখন এটাই প্রধান মিউজিয়াম। এর দুই মাথার ছোট দুটি অংশে বুকস্ট্যান্ড, লাইব্রেরি, সেমিনার রুম, প্রশাসনিক অফিস আর কাউন্সেলিং রুম। মাঝের অংশে মিউজিয়াম আর অডিটোরিয়াম। মিউজিয়ামে বন্দীদের খাদ্যতালিকা, ডাক্তারি পরীক্ষার কাগজ, ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, পোশাক–আশাকসহ অনেক কিছু। একটি দেয়ালে হিটলারের শিল্পকর্মও চোখে পড়ল। জার্মানির সিংহভাগ মানুষের কাছেই এখন হিটলার নন্দিত নন। তাই বলে তাঁরা হিটলারের আঁকা ছবির অমর্যাদা করেনি।
ডাকাও মেমোরিয়ালে ঢোকার জন্য কোনো পয়সা দিতে হয় না। সংগ্রহশালায় ঘোরাঘুরি করছি, একজন লোক এসে বলল, তোমরা কি গাইডেড ট্যুরে যেতে চাও? গাইডেড ট্যুরের অনেক সুবিধা আছে। ১১টার সময় ইংরেজিতে গাইডেড ট্যুর শুরু হবে। আমার সঙ্গীদের কেউ কেউ উশখুশ করছিলেন গাইডেড ট্যুরের খরচের কথা ভেবে। ভদ্রলোক বললেন, কোনো পয়সা লাগবে না। এখান থেকে ট্যুর শুরু হবে। সব দেখে ফেরত যেতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেগে যাবে। বারান্দায় আরও কিছু লোককে জড়ো হতে দেখে আমরাও এগিয়ে গেলাম।
ওভারকোট পরা মাথায় স্কার্ফ জড়ানো বেশ লম্বা একটি মেয়ে এল আমাদের সামনে। বলল, ‘আমার নাম লরা। আমি ভালো ইংরেজি জানি না, তাই প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আপনারা রাজি থাকলে আজ আমি আপনাদের এই মেমোরিয়াল ঘুরিয়ে দেখাতে চাই।’
লরা সুশ্রী, তার সৌজন্যবোধ চমৎকার। আমাদের কেউ একজন বলল, ইংরেজি আমাদেরও মাতৃভাষা নয়। আমরা তোমার সঙ্গে আছি।
মিষ্টি হাসি দিয়ে শুরু করল লরা। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি ১৯৩৩ সালে এইখানে শুরু হয়েছিল ভিন্নমতাবলম্বীদের শায়েস্তা করার স্কুল। পরবর্তী ১২টি বছর এটি পরিণত হয়েছিল ভয়াল উপত্যকায়। শুধু ব্যাভারিয়া নয়, সমস্ত জার্মানিতে এর কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। আমাদের সংক্ষিপ্ত ট্রিপে আমরা দেখব ইন্টারন্যাশনাল মনুমেন্ট, ইন্টার্ন ব্যরাকের, গার্ডদের টাওয়ার, কিছু প্রার্থনার স্থান রোল কলের জায়গা, ক্রিমাটোরিয়াম, গোসলখানা আর বাংকার। যদিও এস এস ব্যারাক এলাকাটি এই ডাকাও ক্যাম্পের অনেক ঘটনার সাক্ষী কিন্তু এস এস ব্যারাকে আমাদের যাওয়া হবে না।
সাড়ে এগারোটা থেকে একটি ডকুমেন্টারি দেখতে পাবেন, আমার মনে হয় মুভিটা দেখে বের হওয়া ভালো। কারণ, এরপর আবার যখন ইংরেজি ডকুমেন্টারি দেখাবে, ততক্ষণে ৩টা বেজে যাবে, দিনে দুবার মাত্র ইংরেজি ভার্সন দেখায়। এটা মিস করা ঠিক হবে না। সে ক্ষেত্রে আপনারা মুভির আগ পর্যন্ত এই মিউজিয়াম এলাকা ঘুরে দেখতে পারেন।
মুভি শেষ হলে এখান থেকে ঠিক বারোটায় শুরু হবে আমাদের ট্যুর। আর একটা কথা, এই ট্যুর সম্পূর্ণ ফ্রি। তবে আপনারা যদি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য কিছু দান করেন, তা আমরা সানন্দে গ্রহণ করব। একটানা এতগুলো কথা বলে থামল লরা।
ডকুমেন্টারি দেখতে গিয়ে বিষাদে ভরে গেল মন। থার্ড রাইখের কদর্য দিকটা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে ধরা হয়েছে। ডাকাও থেকে গাড়ি ভরা লাশ নিয়ে যাবার দৃশ্যটি আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। তবে ডাকাওয়ের লাশ বহনের দৃশ্য আরও ভয়াবহ। কারণ, লাশগুলোকে কঙ্কালের মতো মনে হচ্ছিল। সারা অবয়বে, অর্ধাহার, অনাহার, অমানুষিক পরিশ্রম আর অসুখ–বিসুখের চিহ্ন। হিটলারের একটি বক্তৃতাও ছিল, যার বিন্দু–বিসর্গ বুঝিনি ভাষার কারণ, তবে তাঁকে দেখে উত্তেজিত মনে হচ্ছিল।
২২ মিনিট পর আলো জ্বলে উঠল হলে। মাত্র ২২ মিনিটের এই মুভিটি দেখে অনেকেই চোখ মুছতে মুছতে বের হচ্ছিলেন। বারোটার একটু আগে আমরা সবাই আগের বারান্দায় জড়ো হলাম গাইডেড ট্যুরের জন্য। লরা বলল, আশা করি মুভিটি আপনাদের ভালো লেগেছে।

গুরুত্বপূর্ণ বন্দীদের সেল
গুরুত্বপূর্ণ বন্দীদের সেল

অনেকে তখনো চোখ মুছছে, কোনো উত্তর দিল না কেউ। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে লরা শুরু করল তাঁর বর্ণনা, আপনারা ক্যাম্পে প্রবেশের সময় হয়তো লক্ষ করেছেন গেটের গ্রিলের মধ্যে একটি কথা লেখা আছে। মনে পড়ল মেইন গেটের সঙ্গে লাগানো একটি ছোট্ট পকেট গেট দিয়ে আমরা ঢুকেছি। ওই পকেট গেটের ওপরে একটি লেখা দেখেছিলাম। নিরস জার্মান ভাষা মনে করে আর পড়ার চেষ্টা করিনি।
লরা বলল, ওইখানে নির্লজ্জের মতো যে কথাটি নাযিরা লটকে দিয়েছিল তা হচ্ছে নাযি বাহিনীর মিথ্যে আশ্বাস, ‘আরবেট মাকথ ফ্রাই (কর্মেই মুক্তি)’। বন্দীদের এই কসাইখানায় ঢোকানোর সময় দেখিয়ে দেওয়া হতো এই বাণী। এর পর কাজে যাওয়া–আসার সময় বন্দীদের মনে হতো বাক্যটি তাদের উপহাস করছে। কারণ, ডাকাও থেকে মুক্তির ব্যাপারটি তত দিনে অকল্পনীয় হয়ে উঠত।
বন্দীরা ক্যাম্পে ঢোকার পর তাদেরকে প্রথমে বিবস্ত্র করা হতো। তারপর নিয়ে যাওয়া হতো জীবাণুনাশক রুমে। তারপর মাথার চুল কামিয়ে গোসলে পাঠানো হতো। গোসলের পর তাদের গায়ে উঠত কয়েদির পোশাক।
মেইনটেন্যান্স রুমের আর বন্দীদের ব্যারাকের মধ্যের ফাঁকা জায়গায় গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক স্মৃতিস্তম্ভ। এখানে প্রথমে চোখে পড়ে কালো ব্রোঞ্জের একটি ভাস্কর্য। এই ভাস্কর্যে কাঁটাতারে ঝুলন্ত কঙ্কালসার কিছু মানুষের ঝুলন্ত লাশ দেখে গা শিউরে ওঠে। ১৯৬৮ সালে নির্মিত এই ভাস্কর্য নির্মাণ করেছিলেন ভাস্কর নান্দোর গিল্ড। আমাদের সঙ্গে হাঁটছিল লরা। প্রয়োজনমতো জানিয়ে দিচ্ছিল নানা রকম তথ্য। নান্দোর গিল্ড নিজেও ছিলেন ডাকাওয়ের বন্দী, বলল লরা। তাঁর চেয়ে ভালো আর কে জানবে বন্দীদের যন্ত্রণার কথা? ১৯৪৫ সালে মুক্ত হলেও ডাকাও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ১৯৬৮ সালে, নান্দোর গিল্ডের এই ভাস্কর্য তখন থেকেই ডাকাওয়ের প্রতীকের মতো।
আন্তর্জাতিক স্মৃতিস্তম্ভের আরেকটা জিনিস বুকের মধ্যে বিষাদ ছড়িয়ে দেয়। কয়েকটি ভাষায় লেখা ছোট্ট একটি বাক্য, ‘নেভার এগেইন’ যতবার দেখছিলাম, ততবার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।
লরা এরপর আমাদের নিয়ে গেল রোলকল চত্বরে। নাযিদের সময় শীত গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই রোল কল হতো সন্ধ্যায়। যারা অসুস্থ হয়ে পড়ত, তাদেরকে শাস্তিও খেতে হতো রোল কলে। প্রথমে ৫ হাজার লোকের কথা ভেবে চালু করা হয়েছিল কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। ধীরে ধীরে কয়েক গুণ বেড়ে যায় বন্দীর সংখ্যা। তাদের চেনানোর জন্য আলাদা রঙের ইউনিফর্ম থাকত, লরার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সবাই। রোল কল চত্বরের সামনেই বন্দীদের ব্যারাক।
খুবই সাদামাটা, ৩৩০ ফুট লম্বা প্রতিটি ব্যারাকের দুই মাথায় দুটি দরজা। প্রতিটি ব্যারাক প্রথমে তৈরি করা হয়েছিল ৪৫ জনের জন্য। ৪৫টি খাট আর ৪৫টি লকার ছিল প্রতিটি ব্যারাকে। পরে বন্দীর সংখ্যা বেড়ে গেলে রুমে তিনতলা খাটের ব্যবস্থা করা হয়। বলছিল লরা, নতুন বন্দীরা থাকত সবচেয়ে ওপরের খাটে, একটু পুরোনোরা মাঝের খাটে আর সবচেয়ে পুরোনোরা নিচে। কেউ একজন কারণ জিজ্ঞাসা করায় লরা বলল, অনাহারে অপুষ্টিতে ওপরে ওঠার শক্তি থাকত না তাদের। আর এখন যে মেঝে বা খাট দেখছেন, তখন এর চেয়ে অনেক খারাপ ছিল। ব্যারাকে দরজা দুটি হলেও দুপাশের জানালাগুলো অনেক বড়। একজন বলল, এই জানালাগুলো বড় করা হয়েছিল বাইরে থেকে নজর রাখার জন্য। লরাওকে জিজ্ঞেস করতাম বিছানার চাদর, কম্বল-টম্বল সম্পর্কে।
সে বলল, চাদর প্রথম প্রথম দেওয়া হতো, নীল স্ট্রাইপের সে চাদর গলায় পেঁচিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল কয়েকজন। তারপর থেকে আর সেসব দেওয়া হতো না। প্রবল শীতের মধ্যে একটি কম্বল দেওয়া হতো মাত্র।
আপনারা যে ব্যারাকটি দেখছেন এটি আসলে আগেরগুলোর আদলে তৈরি করা হয়েছে। ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আমরা নুড়ি বিছানো পথে সামনে এগোতে থাকলাম। ৯৯০ ফুট লম্বা এই রাস্তা ৯৯ ফুট প্রশস্ত। একই রকম মোট ৩৪টি ব্যারাক ছিল রাস্তার দুই পাশে। লরা বলল, ব্যারাকগুলো সব ভেঙে ফেলা হয়েছিল ষাটের দশকে, এখন দুপাশে ভিতের মতো যা দেখছেন তা আসলে ধ্বংসাবশেষ নয়। ব্যারাকগুলো ভেঙে ফেলে নতুন করে কনস্ট্র্রাকশন শুরু হয় ১৯৬৩-৬৪তে, তখন ইচ্ছে করেই এ রকম বানানো হয়েছিল। আমরা যে রাস্তায় হাঁটছি, নাযিদের আমল থেকেই ক্যাম্প রোড নামে এর পরিচিতি। মেইনটেন্যান্স বিল্ডিং থেকে সোজা এই রাস্তা একেবারে ক্রিমাটোরিয়াম পর্যন্ত।
আমাদের একজন ক্রিমাটোরিয়াম চিনতে পারছিল না, লরা অনেক কসরত করে তাঁকে বোঝাল লাশ পোড়ানোর ঘর। আমার মাথায় একটা কথা ঘুরপাক খেতে থাকল। একই রাস্তার দুই মাথায় আসা–যাওয়া। মেইনটেন্যান্স বিল্ডিংয়ের যে পথে বন্দীর আগমন, সেই রাস্তারই শেষ মাথায় ক্রিমাটোরিয়াম, অন্য ভুবনের দরজা।
ব্যারাকের লাইন যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে বেস কয়েকটা উপাসনালয় গড়ে উঠেছে। লরা বলল, বুঝতেই পারছেন এই পবিত্র উপাসনালয়গুলো গড়ে উঠেছে ডাকাও মুক্ত হবার পর। ডাকাও ক্যাম্পে নির্যাতিত মিউনিখের আর্চ বিশপ জোহান্নেস হাজলারের উদ্যোগে ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এগোনি অব ক্রাইস্ট নামের একটি গির্জা। এর পর আরও পাঁচটি চার্চ নির্মিত হয়েছে এখানে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রোটেস্ট্যান্ট গির্জা, রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চ, জুয়িশ মেমোরিয়াল।
বয়স্ক দুই পোলিশ স্বামী–স্ত্রী কাঁদছিলেন গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে। লরা বলল, দে আর নট উইথ আস। ওনারা আলাদা আসেন, আমি গত দুই বছরও তাঁদের এভাবে কাঁদতে দেখেছি। একবার মনে হলো যাই, বুঝে আসি তাদের দুঃখের কারণ। আবার মনে হলো, আমার কাফেলা এগিয়ে লরার সঙ্গে এগিয়ে চলেছে, আমি পিছিয়ে থাকি কীভাবে?
ক্রিমাটোরিয়ামের সামনে একজন সাধারণ বন্দীর সাদামাটা মূর্তি। সেদিকে চোখ পড়লেই বুকের ভেতর ধক করে উঠল। কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখ, কঙ্কালের মতো শরীর, ঢোলা ওভারকোট, বড় একটা মানুষ যেন হঠাৎ করেই ছোট হয়ে গিয়েছে।
ক্রিমাটোরিয়ামে এসে প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে থাকল লরা?
ক্রিমাটোরিয়াম কেন? এখানেই কি গ্যাস চেম্বার ছিল?
গ্যাস কাদের দেওয়া হতো?
আরও নানান প্রশ্ন।
লরা বলল, গ্যাস চেম্বার এখানে ছিল বলে শুনিনি। ক্রিমাটোরিয়ামের কারণ হচ্ছে এখানে যে বিপুলসংখ্যক লোক মারা যেত তাদের সবাইকে সমাহিত করার মতো জায়গা ছিল না। ১২ বছরে ৩২০০০ লাশ। পুড়িয়ে ফেলা হতো।
আমি ভাবলাম আমাদের কথা শুনে অরা কী ভাববে? পৌনে এক বছরে ৩০ লাখ।
অফিশিয়াল ট্যুর এখানেই শেষ।
লরার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে মেইনটেন্যান্স বিল্ডিংয়ের দিকে আসছিলাম। বললাম ইহুদিদের সংখ্যা কেমন ছিল?
সে বলল, আমাকে প্রায় সব সময়ই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। প্রথমে কিন্তু ইহুদিরা টার্গেট ছিল না। ধীরে ধীরে বিভিন্ন অজুহাতে ইহুদিদের আনা শুরু হলো। ১৯৩৮ সালের নভেম্বরে এক রাতেই ১০,০০০ ইহুদিকে ধরে আনা হয় এখানে।
লরাকে বললাম, আমাদের আর কিছু বাকি থাকল?
একটু ভেবে নিয়ে সে বলল, যদি বাংকারে না গিয়ে থাকেন, ওখানে যেতে ভুলবেন না। রাইখের জন্য বিপজ্জনক যাজক, বুদ্ধিজীবী, বিজ্ঞানীদের রাখার জন্য পুরোনো টয়লেটের সংস্কার করে নির্জন সেল বানানো হয়েছিল।
মূল মিউজিয়াম বা মেইনটেন্যান্স বিল্ডিংয়ের পেছন দিকে লম্বা গলির মতো (দুই সারি বাথরুমের মাঝে যেমন থাকে) তার দুপাশে ছোট ছোট সেল। সামনে মনিটরের মতো। সেখানে জ্বলজ্বল করছে বন্দীর নাম, ডাকাওয়ে থাকার সময় কাল, তাদের দু–একটা বিখ্যাত কাজের কথা।
একটা ঘরের সামনে মার্টিন নিইমোলারের নাম দেখে থমকে দাঁড়ালাম। তিনি এখানে বন্দী ছিলেন জানতাম না। তাঁর বিখ্যাত কোটেশন মনে পড়ে গেল:
First they came for the Socialists, and I did not speak out—
because I was not a Socialist.
Then they came for the Trade Unionists, and I did not speak out—
because I was not a Trade Unionist.
Then they came for the Jews, and I did not speak out—
because I was not a Jew.
Then they came for me—and there was no one left to speak for me.
বাসে ওঠার সময় মন খারাপ হয়ে গেল। ভাবতে লাগলাম নিইমোলার কথাগুলো কি আমার জন্যই লিখেছেন? বাইরে শীতের বাতাসে পাতা ঝরছে। গাড়ির ভেতরের ওমে বেশ ঘুম ঘুম ভাব চললে আসছে। ঝরা পাতার কথা মনে থাকছে না।