মন কন্দলের জয়যাত্রা

টুপটাপ বৃষ্টি, কনকনে শীত, এখানে নিউইয়র্কে বলে স্নো শাওয়ার, ব্রুকলিন মসজিদ থেকে ফজরের আজান ভেসে আসছে ‘আসসালাতু খয়রুম...মিনান্‌নাউম’। ঘুমের চেয়ে নামাজ উত্তম। ঘুম ভেঙে গেল। মীরাকে যেভাবে ঢাকায় ছেড়ে এসেছি, ঘুমের ঘোরে ও সেখান থেকে শুরু করল। বিবাহিত নারীর আমার প্রতি আসক্তির অযথা কারণ আমি আজও বের করতে পারিনি। আমার মধ্যে ও এমন কী দেখেছিল, যা ওর স্বামীর মধ্যে ছিল না! বিত্ত, বৈভবে সে তো আমার চেয়ে আরও উঁচুতে ছিল। তবু ও আমার মধ্যে কি খুঁজে পেতে চেয়েছিল, বলি বলি করে বলা হয়নি। শেষে মন খারাপ করে বসে সে জন্য আর জিজ্ঞেস করিনি। এখন বড্ড আফসোস হয়, কেন করলাম না। পৃথিবীতে আমরা শুধু মানুষের দোষই খুঁজে বেড়াই। সে জন্য অনেকে নিজের মনের কথা প্রকাশ করে না। বুকের মধ্যে তালা দিয়ে রাখে। মরে গেলে ওই তালা লাগা অবস্থায়ই মনের ঘরে রয়ে যায়। তা কেউ জানে না, কেউ জানেন না...!
বিবাহিত নারীর কি প্রেম করা সাজে? তা যদি হয় সে আরেক বিবাহিত পুরুষ এবং তার যদি থাকে কবি কবি ভাব, যদি হয় লেখক, এরা তো উদাসীন ও অর্বাচীন হয়। আমি আসলেও তাই, ভবঘুরে ও বেকার, আমি তাকে কীভাবে উদ্ধার করব? সে যাই হোক, সে আমাকে অমোঘ ভালোবাসায় তালা মেরে চাবি হাতিয়ে নিয়েছে। এটা অন্যায় আমি জানি। কিন্তু একটা জায়গায় আমি বারবার হোঁচট খাই, সেটা মন। আমার ঘোর আপত্তি, কিন্তু মনের লম্বা দমের সঙ্গে আমি পেরে উঠি না। আমি অনেক ভেবেছি, প্রেম-ভালোবাসা? উত্তর একটাই হয়, সেটা মনের দুর্বলতা। অথবা বলা যায় মদ খাওয়ার মতো খেলে নেশা হয়। নেশা ফুরিয়ে গেলে কিছু বাকি থাকে না। আমি যৌনতা নিয়েও ভেবেছি, শরীর পেয়ে গেলে আর আকর্ষণ থাকে না, টান কমে যায়। তবু মানুষ এগুলো কেন করে? মনে হয় জৈবিক রসের রসায়নে রঞ্জিত হয়ে সাময়িক উত্তেজনায় দুর্বল ও জীবনবঞ্চিত মানুষেরা কেন আপস করবে ভেবে, মনের সঙ্গে জোর পায় না। নদীর স্রোতের টানে গা ভাসিয়ে দেয়।
আমি কাউকে দোষ দেব না—এই স্পর্ধা আমার কোথায়? আমি শুধু বলব, যারা জীবনে উত্তেজনায় বিশ্বাস করে বা মজা পায়, তারা ধরাশায়ী হয় বেশি। একদিকে কঠোর ইসলামি জীবনবিশ্বাস ও প্রথার রক্তচক্ষু, দুই মন, দুই টানার নাচের পুতুল হয়ে জীবন অনেকের হায় হায় হয়ে গেছে। ঘুমের ঘোরের স্বপন সব সময় মিছে, জীবন প্রসূত নয়। তবু কখনো কখনো পেছনের জীবন ক্ষণিক টান, ভালো লাগা, অনুভূতি, দুর্বলতা স্বপ্নের নির্জীব সময়কে আন্দোলিত করে বৈকি! আমার আজকের মনের অজানা মুহূর্তগুলো হয়তো এরই প্রতিবিম্ব। সেই প্রতিবিম্ব নিয়েই হাঁটছি আমি। সেই অনেক দিনের পুরোনো ঘটনা, মনে হয় যেন কাল ঘটে গেছে। আয়নায় আমার চেহারা ও আমি—এতটুকু মনের দূরের ঘটনা।
ফেসবুকে গল্প লিখতে লিখতে আর ও পড়তে পড়তে জানাশোনা। মন্তব্য, ভালো লাগা না-লাগার আলোচনায় খুব কাছে এসে গেলাম। খুব অধীর আগ্রহে ও অপেক্ষা করতে থাকে। সময় বের করে দেশে যাওয়া আমার জন্য সহজ নয়। তবু যেতে হলো, চলে গেলাম। হরতাল, পেট্রলবোমার ঝলকানিতে আনন্দভ্রমণ আনন্দের হয়ে গেল। ওর সঙ্গে দেখা হলো, জানা হলো, দেওয়া হলো, নেওয়া হলো, আর কী চাই? আমার একলা থাকার বাসায় আসতে শুরু করল। ভালোবাসার পূর্ণতায় আমরা জীবন খেলার খেল খেলাতে আদিম খেলায় মেতে উঠলাম। ছুটির দিন কয়টা ময়ূরপঙ্খী নাও ভাসিয়ে অজানা দেশে প্রতিদিন চলে যেতে লাগলাম। আমার নিউইয়র্কে ফেরার সময় হয়ে এল। আমি এক পড়ন্ত বিকেলে ফিরে এলাম। কম্পিউটারের স্ক্রিনে ওর ফটো দেখতাম আর বিভোর হয়ে কবিতা লিখতাম।
জানাতো ভালো আছে, কিন্তু সংসারে সুখ নেই। আর টেনে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। এর সমাপ্তি চাইছে, এরপর ফেসবুকে আসা বন্ধ করে দিল। একদিন ওর বান্ধবী ফোন করে জানাল, ও সুইসাইড করেছে। সবাইকে মুক্তি দিয়েছে, নিজেরও মুক্তি মিলেছে...! বুকটা ভেঙে গেছে, কিছু না পারতাম, ভালো বন্ধুর মর্যাদায় সাহায্য তো করতে পারতাম। আত্মহত্যা করা তো মহাপাপ, ও কি সেটা জানত না? আমি নিজেকে দোষ দিই না। ভালোমন্দ মিলেই জীবন। জীবনের ক্ষণিক অভাবনা যদি মনে দোলা দেয়, আন্দোলিত করে ক্ষতি কী? চলছিল তো চলুক সেই হাওয়া গাড়ি টমটমের মতো! কষ্ট হয় এ জন্য যে ভালোবাসার মানুষটির উপকারে আসতে পারলাম না। মৃত্যু সব সময়ই দুঃখের এবং সেই মৃত্যু যদি অস্বাভাবিক হয়, কষ্টের মাত্রা আরও বাড়ে, সহ্যশক্তি হ্রাস পায়, আমি ভুগছি। জীবন কঠিন ও বাস্তব এবং এই অল্প দিনের এই জায়গায় আমি দুঃস্বপ্নে ভুগছি, ভোগাচ্ছি আমার আত্মাকে। মীরা, পারলে আমাকে দূর থেকে কম্পিউটারের মনিটরের মতো দেখে মাফ করো...!