জাঁকজমক নয়, বিয়ে হলো দুজন মানুষের বন্ধন

প্রবাসীরা বেশির ভাগ সময় বাংলাদেশে গিয়ে নিজেদের বিয়ে কিংবা ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে গিয়ে মাস খানেক ধরে বাড়িতে লাইটিং করেন। এই অর্থ থেকে সাশ্রয় করে অনেক গরিব মানুষকে সাহায্য করা সম্ভব
প্রবাসীরা বেশির ভাগ সময় বাংলাদেশে গিয়ে নিজেদের বিয়ে কিংবা ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে গিয়ে মাস খানেক ধরে বাড়িতে লাইটিং করেন। এই অর্থ থেকে সাশ্রয় করে অনেক গরিব মানুষকে সাহায্য করা সম্ভব

চার ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার ছোট ছেলেটি ওয়াশিংটনে এএসএম রিসার্চ ফেডারেল কোম্পানিতে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত। বড় তিন ছেলেমেয়েকে ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছি। এবার ছোট ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার পালা। কিন্তু বিয়ের আগেই ছেলের কিছু শর্ত মানতে হবে। সেটা কী? মেয়ের বাবার বাড়ির অবস্থা, মেয়ের সৌন্দর্য বা গায়ের রং এসব দেখার দরকার নেই। দেখতে হবে মেয়ে আর তাঁর পরিবার কতখানি শিক্ষিত ও শালীন! আর বিয়েতে জাঁকজমক, লোক দেখানো খরচপাতি এসব করা যাবে না। 

‘ওমা এ কেমন কথা! বড় তিন ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়েছি সাধ্যের ঊর্ধ্বে খরচ করে, আনন্দ বৃদ্ধির জন্য-পাকাদেখা, পানচিনি, হলুদ, মেহেদি, বিয়ে, বউভাত, মাছভাত, গাছরোপণসহ কত আনন্দ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি। আর বাড়ির সবচেয়ে ছোট ও রোজগেরে ছেলের বিয়ে হবে সাদামাটা!’ এখান থেকে আত্মীয়স্বজনদের মেয়ের সন্ধান করার তাগিদ দিতে থাকলাম। মোটামুটি তিনটা মেয়ে সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে গত বছর জানুয়ারিতে বাংলাদেশে গেলাম।
যাওয়ার তিন দিন পরে প্রথম মেয়েটাকে দেখতে গেলাম। পরিবার সম্পর্কে খোঁজ এখানে থাকতেই করা হয়েছিল। দুই পক্ষের পছন্দ মিলে যাওয়াতে ওখানেই কাজি ডেকে নগদ মোহরানা পরিশোধ করে বিয়ের কাজ সমাধা হলো। কোনো পক্ষেরই কোনো দাবি ও চাহিদা নেই। দুই পক্ষ মিলে শুধু একটা ‘রিসেপশন’-এর দিনক্ষণ ও ভেন্যু ঠিক করা হলো। ওই দিন নতুন বউ আমি ঘরে তুলব।
বিয়ের সাজে বাড়ি আলোকসজ্জায় সাজবে। ফুর্তি হবে! বাদ্য-গীত হবে! নাহ্ তা কেন হবে না? ছেলে আমাকে বোঝায় ‘মা শোনো, ওই সব করতে গিয়ে যে টাকা খরচ হবে তা শুধু নষ্টই হবে।’ আমি তাকে কৃপণ বলে বকা দিই। সে ওই সব খরচের হিসাব করে টাকাগুলো আমার হাতে দিয়ে বলে, ‘ওই টাকা তুমি সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য খরচ করো, তাদের পেটপুরে খাওয়াও, একটু শান্তিতে ঘুমানোর জন্য তোশক কিনে দাও, মশা থেকে রক্ষা পাওয়ার মশারি কিনে দাও, তাতে টাকাগুলো নষ্ট হওয়া থেকে মানুষের কল্যাণে বাঁচবে।’ আমি বুদ্ধিহীন মা, আমার শুকনো খটখটে মগজ থেকে আনন্দাশ্রু গাল বেয়ে পড়তে লাগল।
আসলে বিয়ে হলো দুজন বিবাহযোগ্য নারী-পুরুষের মধ্য দাম্পত্য সম্পর্ক প্রণয়নের বৈধ চুক্তি ও তার স্বীকারোক্তি। বিয়ের অনুষ্ঠান মানেই জাঁকজমক, হইচই সাধ্যের সর্বোচ্চ খরচ নয়। আমার অবাক লাগে এখনো ছেলের সুস্থ চিন্তার প্রসার দেখে। আমি একটা বিশেষ কিছু করলে, ঢোল না পেটানো পর্যন্ত-পেটের ভাত চালই থেকে

যায়। আর আমার ছেলে হয়ে সে প্রকাশের বাইরে থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, আমার সত্যি গর্ব হয়। 

সময় পাল্টেছে। একসময় ছেলেমেয়েরা বাবা-মার কাছ থেকে শিখত আর আমি প্রতিনিয়ত শিখছি ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে। যেখানে তাদের বয়সী ছেলেমেয়েরা নিজেদের বিয়েতে ‘তুঘলকি এলাহি’ শানশওকত আর রাজসিক জাঁকজমকে একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে, বিয়ের চাকচিক্যে নিজেদের মানমর্যাদা বাড়ানোর চিন্তা করে, দেশে হোক বা প্রবাসে হোক, বিয়ের অনুষ্ঠান বলিউডের সিনেমার অনুকরণ করে, সেখানে আমার ছেলের ভাবনার গভীরতা আমাকে মুগ্ধ করে।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ। বিয়েবাড়িতে হিন্দি নৃত্য-গীত দেখে মনে হয় বাংলা গান, নাচ, সংস্কৃতি, বসন, ভূষণ বলে কিছু নেই। কোনোকালে ছিল না। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাংলা ভাষা চর্চা, এসব যেন বইয়ের পাতায় ওগুলো যত্নে রাখার জন্য।
একদিনের রাজা-রানি সাজিয়ে প্রথম সারির পার্টি সেন্টারে রিসেপশন হলো ছেলের। নববধূকে সালংকারে সাজাতে ছেলে বউ কেউ অমত করল না। কাঁচা ফুলের গেট বানানো হলো। আমন্ত্রণপত্রে ‘উপহার নয় দোয়া কাম্য’ লেখা দেখে অভ্যাগতরা অনেকে নগদ টাকা দিতে চাইলে আমরা সবিনয়ে তা ফিরিয়ে দিই। বিয়েবাড়িতে বৈভবের কাড়া-নাকাড়া বাজনা না শুনে আমার অনেক আত্মীয় তির্যক হাসি হেসেছেন।
বিয়ের অনুষ্ঠানে ফটোগ্রাফিতে দেখি আজকাল হিন্দি সিনেমার স্টাইল। ফটোগ্রাফার ও ভিডিওগ্রাফার হয় বিয়ে নামক মুভির ডিরেক্টর। তাদের ডিরেকশনে বিভিন্ন সুন্দর সুন্দর ভেন্যুতে চলে ফটো শুটিং। চলে রিহার্সাল। বিয়ের অনুষ্ঠানে বর-বউ কীভাবে উঠবে, বসবে, হাসবে, তাকাবে, নাচবে সব ফটোগ্রাফার ও ভিডিওগ্রাফার বলে দেয়। আমার ছেলের বিয়েতেও পেশাদার ফটোগ্রাফার ও ভিডিওগ্রাফার ছিল। তারা বর-বধূ ও আমাদের নির্দেশে কাজ করেছে।
বিয়ের আড়ম্বর কমিয়ে উদ্বৃত্ত টাকাগুলো সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের কল্যাণে দান করে, আমরা যা পেয়েছি, সে অমূল্য প্রাপ্তি আমাকে শান্তি দিয়েছে, সুখ দিয়েছে, দিয়েছে স্বস্তি।