চারটি ম্যাজিক ওয়ার্ড শেখান সন্তানকে

মেয়ে গুঞ্জরী সাহাকে কোথায় কী রকম ব্যবহার করতে হবে শিখিয়ে দেন মা সুতপা মণ্ডল
মেয়ে গুঞ্জরী সাহাকে কোথায় কী রকম ব্যবহার করতে হবে শিখিয়ে দেন মা সুতপা মণ্ডল

একজন মানুষকে সঠিক মূল্যায়নের প্রধান মাপকাঠি হলো তার ব্যবহার। সৌজন্যতার প্রকাশ মানবচরিত্রের একটি প্রধান অংশ, ব্যক্তিজীবনে এর প্রভাব অনেক বেশি।

আমরা বাংলাদেশিরা নিজের দেশে যেমন আচরণ করি না কেন দেশের বাইরে আমরা ভিন্ন মানুষ। বিশ্বের যে মাটিতে আমাদের বসবাস, সেখানে ভদ্র, নম্র, বিনয়ী, সৎ ও কর্মঠ—এসব চারিত্রিক বিশেষণে আমরা বিশেষায়িত। আমাদের শিষ্টাচার কিংবা সৌজন্যতার কারণে আমরা প্রশংসিত। তবে আমাদের হাবভাব যথেষ্ট ভদ্রতা বা সৌজন্যতা প্রকাশ করলেও যথাযথ শব্দের অলংকারে সেটা প্রকাশ করতে জানি না।
তিনটি ম্যাজিক ওয়ার্ডস হতে পারে এই সমস্যার সমাধান। ‘সরি’, ‘প্লিজ’ আর ‘থ্যাংকয়্যু’—এই তিনটি জাদুময় শব্দের প্রয়োগে আপনি অসাধ্যসাধন করতে পারেন। সেই সঙ্গে চতুর্থ শব্দ ‘এক্সকিউজ মি’ যদি রপ্ত করা যায়, তবে তো আর কোনো কথাই নেই।
নিউইয়র্ক সিটির বাংলাদেশি প্রধান এলাকায় পাবলিক স্কুলে কাজের সুবাদে, প্রতিনিয়ত এ দেশে নতুন আগত অভিবাসী পরিবারের শিক্ষার্থীর সঙ্গে কাজের সুযোগ ঘটে। এদের অনেকেই বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আগত। নিউইয়র্কে আসার এক সপ্তাহের মধ্যেই এখানকার স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ ঘটে। এখানে প্রি-কিন্ডারগার্টেনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চেয়ে শিষ্টাচার, সৌজন্য আত্মনির্ভরশীলতা ও স্বাবলম্বী হওয়ার শিক্ষা বেশি দেওয়া হয়। 

ছোট ছোট শিশুদের মধ্যে ঝগড়া আর নালিশের মুখোমুখি আমরা সারা দিনই হই। এসব অভিযোগের সমাধান করতে গিয়ে ওদের ভদ্রতা, শিষ্টাচার, আত্মরক্ষা ও আত্মনির্ভরশীলতার শিক্ষা দিই। দুই সহপাঠীর ঝগড়া নিষ্পত্তিতে দোষী ব্যক্তিকে যখন ‘সরি’ বলায় সাব্যস্ত করা হয় তখন সবাই কমবেশি সময় নেয় বা কেউ কেউ ‘সরি’ বলতে অনীহা প্রকাশ করে। তবে বাংলাদেশি কিংবা উপমহাদেশীয় শিক্ষার্থীদের বেলায় এই অনীহা একটু বেশি দেখা যায়। বন্ধুকে চট করে ‘সরি’ বলতে অনেকেরই বেশ বাঁধে। কেউ কেউ কেঁদে ফেলে। কেউ কেউ না বলার জন্য গোঁ ধরে বসে থাকে।
ঘরে বড়দের মধ্যে ‘সরি’ বলার প্রচলন কম হওয়াটা এর কারণ হতে পারে। নিজেকে প্রশ্ন করুন, মাসে কবার আপনি আপনার কাছের মানুষটিকে ‘সরি’ বলেছেন। অনেক সময় আমরা বড়রাও অনিচ্ছাকৃত ভুল করে বসি ছোটদের সঙ্গে। কিন্তু আমরা কি ছোটদের ‘সরি’ বলি?
প্রি-কের শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমেই আমরা ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চ সার্ভ করি। বাংলাদেশ থেকে আগত শিশুরা কোনো কিছু চাইলে ‘গিভ মি’ ‘গিভ মি’ বলে সাধারণত। সেই সময়ে স্প্যানিশ ও গায়ানিজ শিশুরা বলে, ‘গিভ মি প্লিজ’। আর শ্বেতাঙ্গ শিশুরা বলে ‘মে আই হ্যাভ সাম মোর প্লিজ’।
বাসায় খাবার টেবিলে আমরা সাধারণত বলি, ‘আমাকে মাংসের বাটিটা দাও’ ‘পানিটা দাও’ কিংবা ‘আরেকটি তরকারি দাও’। শিশুরা আমাদের এই কথোপকথনে ইংরেজি ট্রান্সলেসন করে। আমরা তো ‘আমি কি একটু পেতে পারি প্লিজ!’ কিংবা ‘প্লিজ আমাকে আরেকটু দাও’ এভাবে বলি না। তবে আমাদের অভিব্যক্তি ও মুখভঙ্গিতেই এটা প্রকাশ করে থাকি, যেটা আমাদের শিশুরা বুঝে নিতে অপারগ। তাই তাদের শেখানোর কথা মাথায় রেখে আমাদের বাক্যবিন্যাসে ‘ম্যাজিক’ শব্দের ব্যবহার বাড়াতে হবে।
‘এক্সকিউজ মি’—শব্দের সহজ বাংলা হচ্ছে ‘আমাকে মাফ করবেন।’ এই শব্দটা আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে তেমন ব্যবহার করি? করি না। ছুটির সময় এই দেশে অভিভাবকদের নিয়ম হলো, আগে এলে আগে দাঁড়ানোর। কিন্তু অনেক বাংলাদেশি অভিভাবককে দেখি, দেরিতে এসে হুড়মুড় করে, একে অন্যকে ধাক্কা দিয়ে সামনে চলে আসার চেষ্টা করতে। এই নিয়ে অন্য দেশের অভিভাবকেরা যখন অভিযোগ করেন, তখন আমার ইতালিয়ান সহকর্মী প্রশ্ন করে, ‘তোমরা বাংলাদেশিরা এক্সকিউজ মি বলতে এত কৃপণ কেন?’ ভিড়ের মধ্যে, অন্যের মনোযোগ পেতে, যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে ‘এক্সকিউজ মি’ শব্দের ব্যবহার নিজেরাও করতে হবে ও সন্তানদেরও শেখাতে হবে।
বড়দের চোখে চোখ রেখে কথা বলা আমাদের সংস্কৃতিতে অন্যায় হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আই কন্টাক্ট ছাড়া কোনো কথোপকথনই যথার্থ হয় না। তাই শিক্ষক যখন ছাত্রের সঙ্গে কথা বলেন, তখন ছাত্রকে অবশ্যই শিক্ষকের চোখে চোখ রেখেই উত্তর দিতে হবে। অনেক সময় শিক্ষক মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে হলেও ছাত্রের আই লেভেল আর নিজের আই লেভেল এক রেখে কথা বলেন। তাই আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে নয়, মাটির দিকে তাকিয়ে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেবে, শিশুকে এভাবে শিখিয়ে বিভ্রান্ত করবেন না।
অভিভাবকদের কাছে অনুরোধ, আপনার সন্তানের সুশিক্ষার পথ সুগম করতে তাকে সাহায্য করুন। বর্তমানে যে দেশে আপনার সন্তানকে বড় করছেন, সেই দেশের নিয়মনীতি আয়ত্তে আনার চেষ্টা করুন। এতে আপনি নিজেও উপকৃত হবেন, আপনার সন্তানও উপকৃত হবে আর কমিউনিটিকেও সাহায্য করা হবে।