সে কি কেবলই যাতনাময়?

সামনে আসছে ভ্যালেন্টাইনস ডে; ভালোবাসা দিবস। এরই মধ্যে দোকানগুলোর শেলফ ভরে উঠেছে হৃদয়াকৃতির চকলেট, পারফিউম, কার্ড, ফুলসহ রকমারি সব উপহার সামগ্রীতে। ভালোবাসা উদ্‌যাপনের জন্য একটি বিশেষ দিন পালন করা নিয়ে বিশেষত আমাদের বাঙালিদের মধ্যে রয়েছে নানামুখী মত ও দৃষ্টিভঙ্গি। ভালোবাসা দিবস পালন করা বা না করা নিয়ে আমি নিজেও তেমন একটা বিচলিত নই। কিন্তু ভালোবাসা প্রকাশের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমার অনেক কিছু বলবার আছে।

দোভাষী হিসেবে একজন বাঙালি পুরুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে প্রথম এই বিষয়টি আমাকে বেশি করে ভাবিয়েছিল। সাইকো সেক্সুয়াল কেসের ক্লায়েন্ট পুরুষ হলে একজন নারী দোভাষীর নিয়োগ কোনো পক্ষের জন্যই তেমন স্বস্তিদায়ক নয়। সাক্ষাৎকার কিছু দূর যেতে না যেতেই তিনি আমার সঙ্গে যথেষ্ট সহজ হয়ে উঠলেও মনোবিদের প্রশ্নগুলোর জটিল প্রকৃতির কারণেই আমার বাঙালি ক্লায়েন্টকে সেগুলো বুঝিয়ে বলে তার কাছ থেকে উত্তর আদায় করা ছিল আমার দোভাষী জীবনের অন্যতম কঠিন কাজ। রোগীর পারিবারিক ইতিহাস জানতে গিয়ে একপর্যায়ে চিকিৎসক প্রশ্ন করলেন, ‘ডিড ইয়োর প্যারেন্টস হ্যাভ আ গুড রিলেশনশিপ?’ উত্তরে আমার ক্লায়েন্ট বললেন, ‘সম্পর্ক তো বালাউ আছিল মনো অয়, খারাপ কুনতা দেখছি না কোনো দিন।’
‘ওয়ার দে লাভিং টুয়ার্ডস ওয়ান অ্যানাদার ইন ফ্রন্ট অফ ইউ?’ চিকিৎসকের পরের প্রশ্ন। আমি একটু থমকে যাই, কথাটা কীভাবে বুঝিয়ে বলব চট করে বুঝে উঠতে পারি না। অবশেষে বলি, ‘আপনার মা-বাবারে মায়া মহব্বত করতে দেখছইননি কোনো দিন?’ এমন প্রশ্নে দুই হাতে নিজের গাল চাপড়ে তওবা করেন ক্লায়েন্ট, ‘আস্তাগফিরুল্লা আস্তাগফিরুল্লা। ইতা কি জাতোর প্রশ্ন গো আফা? আমরা কুনো তারার লাখান বেহায়া বেশরমনি, যেনে হুরুতার সামনে মায়-বাফে মায়া মহব্বত করতা? ইতা কোনো দিন দেখছি না’। (আমরা কি তাদের মত নির্লজ্জ যে, মা-বাবা সন্তানের সামনে প্রেম-ভালোবাসা করবে?)
আমি চিকিৎসককে বুঝিয়ে বলি, ‘হি হ্যাজ নেভার সিন হিজ প্যারেন্টস বিইং লাভিং টুয়ার্ডস ওয়ান অ্যানাদার। ইট’স কনসিডারড আ ম্যাটার অফ শেইম টু ডিসপ্লে অ্যাফেকশন ইন ফ্রন্ট অব চিলড্রেন’। (নির্লজ্জতার প্রশ্নে পশ্চিমাদের প্রতি কটাক্ষটুকু অনুবাদ করি না ইচ্ছা করেই।) শুনে চিকিৎসক মনে হলো একটু অবাক হলেন; কিন্তু কোনো মন্তব্য করলেন না, নীরবে নোটস নিতে থাকলেন। পরবর্তী প্রশ্ন, ‘আস্ক হিম ইফ হিজ প্যারেন্টস ইউজড টু আরগ্যু অর ডিস-অ্যাগ্রি আ লট।’ আমার ভাষান্তর, ‘আফনার মা-বাফে দরবার কাইজ্জা করতানি?’ আর আমার ক্লায়েন্টের উত্তর, ‘ইতা কিতা মাতোইন? সব ঘরোউ দরবার কাইজ্জা অয়, দুই দিন বাদে আবার হকলতা ঠিক অই যায়।’
এর পরের কয়েকটি প্রশ্ন ছিল অনেক বেশি জটিল, ক্লায়েন্টের নিজের যৌনজীবন সম্পর্কে। চুম্বক অংশটি এ রকম—
—‘ওয়াজ ইয়োর ম্যারেজ লাভ অর অ্যারেঞ্জড?’
—‘মায় বাফে যেখানো বালা বুঝছোইন, ওখানো বিয়া দিছোইন। আমি প্রেম-উম করছি না কোনো দিন। আমরার পরিবারো ইতা সিস্টেম নাই।’
—‘হাউ ওল্ড ওয়্যার ইউ হোয়েন ইউ ফার্স্ট হ্যাড সেক্স?’
—‘কত আর অইব? তেরো/চৌদ্দ।’
—‘হু ওয়াজ ইট ইউথ?’
—‘বাসাত একজন মহিলা থাকতা, কাম কাজ করতা, গরিব আত্মীয়। তান লগে কিলান কিলান অই গেছিল।’
শেষের উত্তরটা দেওয়ার সময় ভদ্রলোকের গলা কেঁপে গেল না এবং ‘আস্তাগফিরল্লাহ’ জাতীয় কোনো দোয়া দরুদও তিনি পড়লেন না। কাজ করতে গিয়ে ক্লায়েন্টের ব্যক্তিগত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তার প্রতি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা পেশাদারিত্বের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু এই ইন্টারভিউ থেকে জাতি হিসেবে ভালোবাসা প্রকাশের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। আমরা সন্তানদের সামনে ঝগড়াবিবাদ করাকে ভুল ভাবি না। কিন্তু তাদের সামনে প্রেম-ভালোবাসা প্রকাশ করাকে লজ্জাজনক মনে করি। ফলে আমাদের সন্তানেরা সুস্থ-সুন্দর প্রেমময় সম্পর্ক দেখে বড় হয় না। দ্বন্দ্ব ও গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে বড় হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসা ও দৈহিক সম্পর্কের প্রতি অসুস্থ দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটে। মা-বাবা এসব বিষয় নিয়ে সন্তানদের সঙ্গে আলোচনাও করেন না। শৈশব পেরিয়ে কৈশোর বা বয়ঃপ্রাপ্তির সময়ে নিজেদের শারীরিক পরিবর্তনের বিষয়টা কীভাবে সামলাবে, তা তারা শেখে না। এর ফলাফল হতে পারে খুবই বিপজ্জনক, যেমনটা হয়েছে আমার ক্লায়েন্টের ক্ষেত্রে। খুব অল্প বয়সে অস্বাভাবিক যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ার কারণে পরিণত বয়সে এসে তিনি জটিল মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছেন, যা তাঁর যৌনজীবনে অতৃপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধরনের ঘটনা বিরল নয়। একটি ছোট শহরতলির একই হাসপাতালে এই সমস্যায় আক্রান্ত দু’জন রোগীর জন্য কাজ করেছি আমি।
যদিও সময়ের সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে তারপরও নারী-পুরুষের মধ্যে সুস্থ ভালোবাসার সম্পর্ককে এখনো আমাদের দেশে সুন্দরভাবে দেখা হয় না। কিছুদিন আগে একটা ভিডিও দেখলাম, বগুড়ার একটি মোবাইল কোর্ট বাহাত্তর জোড়া যুবক-যুবতীর বিচার করছে। যেহেতু পুরো ঘটনাটা ভিডিওতে ধারণ করা হচ্ছে, নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে ছেলেগুলো মাথা নত করে আছে এবং মেয়েগুলো ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। ম্যাজিস্ট্রেট গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছেন, ‘যদি তোমাদের মা-বাবা আসেন, তাহলে সামান্য ফাইন করে ছেড়ে দেব। না এলে সব ক’টাকে জেলে পুরে দেব।’
কী ছিল এদের অপরাধ? খুন, রাহাজানি, ছিনতাই? না, এদের একমাত্র অপরাধ ছিল ভালোবাসা। ভিডিওটি দেখতে গিয়ে বাচ্চাগুলোর জন্য কষ্টে, লজ্জায়, অপমানবোধে আমার নিজেরই গাল লাল হয়ে উঠেছিল। ভাবতে অবাক লাগে যে দেশে খুনিরা নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায়, পুলিশ ঘুষ খায় নিরন্তর, হোমরা-চোমরা লোকেরা দুর্নীতি করে পার পেয়ে যান, যে দেশে আইনসিদ্ধ পতিতালয় পর্যন্ত আছে, সেই দেশেই আবার অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রেমকে এতো বড় অপরাধ হিসেবে দেখা হয় যে, তাদেরকে আসামির মতো লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে বিচার করা হয়।
উঠতি বয়সে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করা খুবই সুস্থ ও স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। আমরা আশা করতে পারি না যে, বিয়ে করার মতো সামাজিক অবস্থান সৃষ্টি হওয়া পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা এই আকর্ষণের অনুভূতিকে জোর করে দমিয়ে রাখবে। অনেক অসামাজিক আচরণের মূলে রয়েছে ভালোবাসার প্রতি আমাদের এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। আমার মতে দমিয়ে রাখা যৌন আকর্ষণ পথে-ঘাটে মেয়েদের প্রতি যৌন নির্যাতনের অন্যতম কারণ। আমি মেয়েদের প্রতি পুরুষের অশোভন আচরণের জন্য সাফাই গাইছি না। কিন্তু এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই যে, অবদমন যেকোনো অনুভূতিকে আরও প্রবল করে তোলে এবং তা ক্ষতিকর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
আমাদের উঠতি প্রজন্মের প্রতি আমাদের এই সব অসমীচীন দাবি তাদের ওপর কী নিদারুণ আবেগিক চাপ সৃষ্টি করে, আমরা তা ভেবে দেখি না। একদিকে আমরা তাদেরকে বলছি, সন্ত্রাসী হয়ো না, আবার অন্যদিকে বলছি ভালোবেসো না। আমরা শুধুই তাদেরকে বিভ্রান্ত করছি। অসহায় করে তুলছি। রবী ঠাকুর ঠিকই বলেছিলেন, এই দেশে ভালোবাসা আসলে ‘কেবলই যাতনাময়’।