বিতাড়ন-প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করছেন আদালত

অনিবন্ধিত অভিবাসীদের আমেরিকা থেকে বিতাড়নে ট্রাম্প প্রশাসনের নেওয়া পদক্ষেপে বেশ ত্বরিত গতিতে কাজ করছে অভিবাসন এজেন্সি। বিভিন্ন স্থানে হুটহাট অভিযান চালাচ্ছে ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই) এজেন্টরা। ট্রাম্প প্রশাসন এখন পর্যন্ত তার অভিবাসনবিরোধী অবস্থানের পাশে আইসিইসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে পাশে পেয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মার্কিন ফেডারেল আদালতের অবস্থান আলাদা। অনিবন্ধিত অভিবাসীদের বিতাড়নে গৃহীত পদক্ষেপ এসে আটকে যাচ্ছে আদালতে।
শুরু থেকেই অভিবাসনবিরোধী প্রশাসনের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের বিপরীতে দাঁড়িয়ে অনিবন্ধিত অভিবাসীদের পাশে রয়েছেন ফেডারেল আদালত। সাত মুসলিম দেশের নাগরিকদের আমেরিকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে জারি করা নির্বাহী আদেশ থেকে শুরু করে অনিবন্ধিত অভিবাসী বিতাড়নে গৃহীত পদক্ষেপ আটকে দেওয়ায় ভূমিকা রাখছেন আদালত। সর্বশেষ অভিবাসী অধিকারকর্মী রবি রাগবিরের আমেরিকা থেকে বিতাড়নের পদক্ষেপ আটকে দিয়েছেন আদালত। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রবি রাগবিরের ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আমেরিকা ছাড়ার কথা থাকলেও ৮ ফেব্রুয়ারি ম্যানহাটন আদালতে তাঁর আইনজীবীর করা মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তা আটকে গেছে। প্রশাসন জানিয়েছে, এই বিষয়ে আদালতে সিদ্ধান্ত আসার আগ পর্যন্ত রবি রাগবির আমেরিকায় থাকতে পারবেন।
শুধু রবি রাগবির নন, এমন বহু ব্যক্তির বিতরণের আদেশই এভাবে মামলা ও আদালতের মাধ্যমে আটকে যাচ্ছে। রবি রাগবিরের আইনজীবীর মতো প্রশাসনের বিরুদ্ধে অধিকার খর্বের অভিযোগ এনে অনেকেই মামলা করছেন। আর এসব মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আদালতও গণ-বিতাড়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। নিউজার্সির হাইল্যান্ড পার্কে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী ইন্দোনেশীয় খ্রিষ্টানদের বিতাড়নের প্রক্রিয়াও গত সপ্তাহে সাময়িকভাবে স্থগিত করেছেন নিউজার্সি ডিস্ট্রিক্ট আদালত। এ আগের দিন বোস্টনে ৫০ ইন্দোনেশীয়কে বিতাড়নের বিষয়েও একই ধরনের আদেশ দেন এক বিচারক। গত ডিসেম্বরে একইভাবে ৯০ সোমালি নাগরিকে বিতাড়নের প্রক্রিয়াও থমকে গিয়েছিল মায়ামি বিচারকের আদেশে। একই বছরের জুনে শতাধিক ইরাকি নাগরিকের বিতাড়ন প্রক্রিয়ায় সাময়িক স্থগিতাদেশ দেয় ডেট্রয়েট আদালত, যা পরে আরও সম্প্রসারিত হয়ে ১ হাজার ৪০০ অনিবন্ধিত নাগরিকের সাময়িক সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
এই ফেডারেল বিচারকেরা অভিবাসন ইস্যুতে কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত না দিলেও তাঁরা এমন একটি অবস্থান নিচ্ছেন, যাতে করে সংকটাপন্ন অভিবাসীরা নিজেদের অধিকার আদায়ে আইনি প্রক্রিয়ায় লড়াইয়ের সময় পান। তাঁরা বিতাড়ন–প্রক্রিয়া বিলম্বিত করছেন। আদালতের এই ভূমিকায় এরই মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আইসিই কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে আইসিইর উপপরিচালক থমাস ডি হোমান নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষকে বৈধ ও ন্যায্য প্রক্রিয়ায় আমেরিকা থেকে বিতাড়নের হাত থেকে বাঁচাতে ফেডারেল বিচারকেরা একের পর এক যেসব আদেশ দিচ্ছেন, তাতে আমি ভীষণ রকম সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। করদাতাদের অর্থে দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ায় সবকিছু বিবেচনার পরই তাঁদের বিতাড়নের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আদালতের আদেশ জননিরাপত্তা নিশ্চিতে আইসিইর পদক্ষেপের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিতাড়নের সম্মুখীন হওয়া অনিবন্ধিত অভিবাসীদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে রয়েছে অপরাধমূলক কার্যক্রমে সংযুক্তির সুস্পষ্ট অভিযোগ। যদিও অবৈধভাবে আমেরিকায় প্রবেশ নিজেই একটি অপরাধ।’
তবে আইসিই উপপরিচালকের এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের আইনজীবী লি গেলার্নট। তাঁর মতে, মার্কিন প্রশাসন অনিবন্ধিত অভিবাসীদের বিতাড়নে অনেকটা আচমকা পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে এমনকি অভিবাসন আদালতের মুখোমুখি করার ন্যায্য সুযোগটিও তাদের দেওয়া হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে নিজেদের আইনি ক্ষমতার বাইরে আদালত যাচ্ছে না। বিচারকেরা এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সচেতন।
আবারও নজর দেওয়া যাক রব রাগবিরের ঘটনা দিকে। বর্তমানে ৫৩ বছর বয়সী এই গ্রিন কার্ডধারী অভিবাসী একটি প্রতারণার মামলায় ২০০০ সালে অভিযুক্ত হন। কারাগারে কিছুদিন থাকার পর ২০০৬ সালে তাঁকে আমেরিকা ছাড়ার আদেশ দেওয়া হয়। পরে তাঁর আইনজীবীদের করা আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দেওয়া হয়। ২০১১ সাল থেকেই রাগবির নিয়মিতভাবে আইসিইতে হাজিরা দিয়ে আসছেন। এভাবেই চলছিল। কিন্তু গত ১১ জানুয়ারি আইসিইতে হাজিরার জন্য গিয়ে আর ফেরেননি তিনি। সেখানেই তাঁকে আটক রাখা হয়। পরে সেখান থেকে তাঁকে বিতাড়নের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। এ অবস্থায় রাগবিরের আইনজীবীরা একাধিক মামলা করেন। ওই মাসেরই শেষ নাগাদ ম্যানহাটন আদালতের বিচারক ক্যাথেরিন বি ফরেস্ট রাগবিরকে মুক্তি দেওয়ার আদেশ দেন। একই সঙ্গে তিনি রাগবিরের বিরুদ্ধে প্রশাসনের এমন পদক্ষেপকে ‘অহেতুক নিষ্ঠুরতা’ বলেও অভিহিত করেন। আর এর মাধ্যমেই রাগবিরের বিতাড়ন–প্রক্রিয়া প্রাথমিকভাবে বিলম্বিত হয়। পরে ৮ ফেব্রুয়ারি রাগবিরের আইনজীবী ম্যানহাটন আদালতে আরেকটি মামলা করেন, যেখানে বলা হয়, অভিবাসীদের অধিকার রক্ষায় রাগবির সোচ্চার ছিলেন। আর এ কারণেই তাঁর ওপর চড়াও হয়েছে প্রশাসন।
তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আইসিইর এনফোর্সমেন্ট অ্যান্ড রিমুভাল অপারেশনসের সহযোগী পরিচালক ম্যাথিউ টি আলবেন্স। তিনি বলেন, কোনো আন্দোলন বা প্রশাসনের সমালোচনা করার কারণে আইসিই কখনোই কোনো অনিবন্ধিত অভিবাসীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয় না। এ ধরনের যেকোনো অভিযোগ দায়িত্বজ্ঞানহীন, সন্দেহবাতিকগ্রস্ত ও অসত্য।
এরপরের দিন নিউওয়ার্কের ফেডারেল ডিস্ট্রিক্ট আদালতে রাগবিরের বিতাড়ন আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে পৃথক একটি শুনানিতে অংশ নিয়ে তাঁর আইনজীবী জানান, রাগবির অপরাধী নন। তাঁর মামলার শুনানিতে কিছু ত্রুটি ছিল। ফলে রবি রাগবিরকে আমেরিকা থেকে বিতাড়নের প্রক্রিয়া আপাতত থমকে গেছে। রবি রাগবিরের প্রতি কোনো অন্যায় করা হচ্ছে না, এমন সিদ্ধান্ত আদালত থেকে এলেই একমাত্র এ প্রক্রিয়া আবার সামনে বাড়তে পারে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, গত এক বছরে বিভিন্ন সময় আইসিইর নেওয়া অভিবাসী বিতাড়ন পদক্ষেপ আদালতে এসে থমকে গেছে। এটা মূলত ভুক্তভোগী অনিবন্ধিত অভিবাসীদের আইনি সহায়তা নেওয়ার একটা সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অভিবাসীরা নিজেদের অধিকার রক্ষা করতে পারলে তা হবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের গৃহীত অভিবাসনবিরোধী অবস্থানের বিপরীতে একটি শক্ত প্রত্যুত্তর।