কাজী জহিরুল ইসলামের পাঁচটি কবিতা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ভাষা
‘খাকানা, কাতাদানা তামাকা দাখা না
দাশা গায়া দাখা হাবা’

একটি মাত্র আকার
নিরাকার প্রেমকে নিঃসঙ্কোচে করেছে প্রকাশ
একটি মাত্র স্বরচিহ্ন, আকার
দূরের প্রেমকে কাছে ডাকার
কী উজ্জ্বল ভাষা,কী ঋজু, কী সুদৃঢ়
সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে
অক্ষরের চেয়ে দীর্ঘ...
এবার মেয়েটির কথা বলি
ওর নাম পলি
বয়স তের/চৌদ্দ
শহরের কোনো এক সাহেবের ঝি
ঘরের ভেতরে ঘর

তার ভেতরে নিশ্ছিদ্র প্রহর
একদিন সে খুব গোপনে সাহেবপুত্রের স্কুলব্যাগ
থেকে চুরি করে
এক অলৌকিক আকার

দূরের নিবিড় গ্রামে ফেলে আসা বাল্যসখা
একটিমাত্র আকারেই কী উজ্জ্বল ভেসে ওঠে...


ছায়ামানুষেরা রোদের
কনসার্ট শোনে

রোদে ভেজা শীত, কী মিষ্টি, কৈশোরচুমুকরোজ্জ্বল
মরা বৃক্ষ এক পুরোনো খুব, নতুন জানালায় বাঁধা
পেছনে আকাশ, কোজাগরী, রঙপাল্টায় দ্রুত
এই দেখি নীল, আবার এই দেখি ভয়ঙ্কর সাদা।

শন শন বাতাস, কাচে, শার্শিতে মাতাল দুঃশাসন
মরা ডালে মর্মর প্রহর, ভেঙে পড়ে মার্চের উঠোনে
ইলেক্ট্রিক পোল থেকে আকাশে লাফ দেয় কাঠবেড়ালি
ছায়ামানুষেরা আলোপোহায় আর রোদের কনসার্ট শোনে।

দিদজেরিদু

ভিয়েনার স্টিফেনপ্লাটসে এ-কোন রাজত্ব আদিবাসী শব্দের
পাথরে বিছিয়ে দেহ কোন গুহামানবী বাজাও প্রাণ, বাজাও দিদজেরিদু
স্টিফেনপ্লাটস বেজে ওঠে, বাজে শোনব্রুন সভ্যতা
উঠে দাঁড়ালে কেনো হে নারী আমাকে দেখে, হে শিল্পী
হে শ্বেতাঙ্গ ছুৎমার্গ ভগ্নি, তাসমান জলের স্পন্দিত প্রিয়তমা, মারিনা,
আমাকে ভাসিয়ে দাও শব্দের তরঙ্গে
তোমার কি মনে নেই
আজ থেকে বহু শতাব্দী আগে
আমরা দু’জন মিলে জন্ম দিয়েছি এ-কাগজ-সভ্যতা
ইথার ও বিজলীর কাছে পরাজিত আজ পাথর ও জল, বেদুইন-বর্শা
আমাদের মাছগুলো এখন সুশি, সুগন্ধ ছড়ায় কাচের টেবিলে
আমাদের পাতাগুলো ওদের স্বাস্থকর ভেজমিল।

তুমি আজ উদ্বাস্তু সগৃহে, কেউ বলে সাঁওতাল, কেউ মাওরি, আবার কেউ
আমিশ, মায়ানস, কতো কতো নাম আমাদের
উন্মূল বলে আঙুল তোলে নপুংসক সভ্যতা
বাজাও দিদজেরিদু মারিনা
বাজাও দিদজেরেদু ফুলমণি মুরমু
শানিত তরবারির মতো সুউচ্চে তুলে ধরো এই নিরহংকার অস্ত্রখানি
এটাই প্রতিবাদের একমাত্র অস্ত্র
আজ তোমাদের মুখগুলো দিদজেরিদু
তোমাদের হাতগুলো, তোমাদের পাগুলো,
তোমাদের ছিপছিপে দেহখানি আজ সরব দিদজেরিদু

শব্দের আঘাতে ভেঙে দাও এই অসভ্য দেয়াল
দিদজেরিদুর মিইয়ে যাওয়া অধঃশব্দ এক মহাকম্পন তুলে
বিদীর্ণ করবেই আকাশের মেঘ।

মারিনা, হে প্রিয়তমা, আরও জোরে ফুঁ দাও,
এতো জোরে যে তোমার কন্ঠ ফেটে
ডাহুকীর মতো বেরিয়ে আসুক সৃজনশীল রক্ত।

বীণা রায়

জীবন আমায় ঠেলতে ঠেলতে এনেছে খাদের কিনারায়
পড়তে পড়তে পড়েই গেলাম, হাত বাড়ালো বীণা রায়
জুয়োর জীবন ফুরিয়েছিলাম প্রলোভনের কয় দানে
খাদ থেকে আজ উঠে দেখি আবার আমি ময়দানে।
ঋতুচক্রে কাঁপন ধরে ভয় পেয়ে যাই ঠান্ডাকে
অশ্বখুরের শব্দে কি আর রক্তনদী বান ডাকে?

এখন ডানা গোটানো দিন চায়ের কাপে বর্ষা নেই
দিন-রাত্রি একইরকম ঝাপসা দেখি ফর্শাতেই।

বাংলাদেশ-৩

লোকটির পাহাড়ের মতো দু’পা টলছে
শহরের প্রধান স্কয়ারে এনে দাঁড় করানো হয়েছে ওকে
কোর্তার পকেট থেকে দুটি ঈগলশিশু বেরিয়ে গেল
দেহের চেয়ে স্ফীত একটি মাথা কোনো রকমে বসে আছে ওর স্কন্ধদেশে
তার চেয়েও বড় মুখ, ঠোঁট দুটো সমুদ্রের বিস্তৃত তটরেখা।

সমবেত জনতার মধ্য থেকে একজন, সম্ভবত নারী,
চিৎকার করে কিছু একটা বললো
দু’জন সামরিক-দর্জি মই বেয়ে উঠে এলো লোকটির দুই কাঁধে
এরপর বড় বড় দুটি সুঁই দিয়ে
সুবৃহৎ দানবীয় লোকটির ঠোঁট দুটো সেলাই করতে লাগলো

ওর দু’চোখের অশ্রুধারায় দুটি নদী হলো
একটি গঙ্গা এবং অন্যটি ব্রহ্মপুত্র।