আমেরিকায় প্রতিদিন মারা যান একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী

২০১৩ সালের এক শনিবার। নিউইয়র্কের ব্রুকলিনের ডাম্বো এলাকায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী লুইজ কামারিলো কাজ করছিলেন। ১৮ বছর বয়সী এই তরুণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে সংগৃহীত আবর্জনা ট্রাকে তুলছিলেন। ঠিক এই সময় আরেকটি ট্রাক তাঁকে চাপা দেয়। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। লুইজ কামারিলোর এই মৃত্যু নতুন কিছু নয়। আমেরিকায় প্রতি দিনই কোনো না কোনো পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মৃত্যু হচ্ছে। এর কোনোটি দুর্ঘটনায়, কোনোটি আবার আবর্জনা থেকে হওয়া সংক্রমণের কারণে। সোজা কথায় এই পেশার মানুষদের এমন উচ্চ মৃত্যুহারের পেছনের মূল কারণ অনিরাপদ কর্মপরিবেশ।

আমেরিকার পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের নিম্ন জীবনমান ও ঝুঁকির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ১৯৬৮ সালে মেমফিসের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নিজেদের অধিকার আদায়ের দাবিতে ধর্মঘটে গিয়েছিলেন। ময়লাবাহী গাড়ির হাইড্রোলিক প্রেসের নিচে চাপা পড়ে ইকোল কোল ও রবার্ট ওয়াকার নামের দুই পরিচ্ছন্নতাকর্মীর মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে এই ধর্মঘট ডাকা হয়। সেই সময় এই ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন ড. মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর অর্ধশত বছর পরও আমরা তাঁর জীবনের শেষ পাদে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া কাজগুলো বাস্তবায়ন করতে পারিনি। জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাজের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিতের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু এই কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা অন্য অনেক ক্ষেত্রে অর্জিত হলেও অধরা রয়ে গেছে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ক্ষেত্রে।
গত জানুয়ারিতে প্রোপাবলিকা পরিচালিত এক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কাজের পরিবেশের ভয়াবহতা ও অনিরাপত্তার কথা সবিস্তারে উঠে এসেছে। বিশেষত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিযুক্ত পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কথা উঠে এসেছে এই প্রতিবেদনে। খুবই অল্প বেতনে কাজ করা এই সব পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রতিদিনই নিজের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলছেন।
প্রোপাবলিকার অনুসন্ধানে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়েছে নিউইয়র্ক নগরের পরিস্থিতির ওপর। এতে নিউইয়র্কের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের যে অবস্থা উঠে এসেছে, তা ১৯৬৮ সালের মেমফিসের থেকে খুব একটা আলাদা নয়। নিউইয়র্কের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের অধিকাংশই আফ্রিকান–আমেরিকান। শহরের আবর্জনা পরিষ্কারের জন্য তাঁরা এমন বহু ঝুঁকি নেন, যা এমনকি তাঁদের প্রাণসংশয়ের কারণ হতে পারে। বিনিময়ে তাঁদের খুব অল্প বেতন দেওয়া হয়। প্রতিদিনই তাঁদের গাছের ডাল, ভাঙা কাচ, সংক্রমণ ঘটাতে পারে এমন জৈবিক বর্জ্য, বিষাক্ত পদার্থ নাড়াচাড়া করতে হয়। কখনো কখনো বিরতিহীনভাবে তাঁদের এসব কাজ করতে হয়। এমনকি অতি নিম্ন ও অতি উচ্চ তাপমাত্রাতেও তাঁদের ছুটি মেলে না সহজে। আর এসব করতে গিয়ে ছোটখাটো আঘাত পাওয়াটা একরকম নৈমিত্তিক ব্যাপার।
১৯৬৮ সালে এই অনিরাপদ কর্মপরিবেশের উন্নতি ও বেতন–ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনে নামেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। সে সময় মেমফিসের এই আন্দোলন জাতীয় ইস্যু হয়ে উঠেছিল। মেমফিসের গির্জা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংগঠন সে সময় পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের চিকিৎসার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। সব মিলিয়ে সে সময় পুরো আমেরিকায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের অধিকারের বিষয়টি ব্যাপকভাবে সামনে আসে। এটা এতটাই যে আমেরিকান ফেডারেশন অব স্টেট, কাউন্টি অ্যান্ড মিউনিসিপ্যাল এমপ্লয়িজ এই ধর্মঘটকে শ্রমিক ঐক্য গড়ে তোলার একটি দারুণ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। আর মার্টিন লুথার কিং এই আন্দোলনকে দেখেছিলেন দরিদ্রদের অধিকার প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে। কিন্তু এসবই যে হয়নি, তা এখনকার আমেরিকায় পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের একই বাস্তবতা এবং তা নিয়ে কারও মাথা না ঘামানোই বলে দেয়।
এ বিষয়ে নিউইয়র্ক টাইমস–এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের হিসাবে দেখা গেছে, আমেরিকায় পেশা হিসেবে দমকলকর্মী কিংবা পুলিশকর্মীর জীবনের চেয়েও একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর জীবন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। একমাত্র জেলে, কাঠুরে, উড়োজাহাজের পাইলট ইত্যাদি পেশায় এর চেয়ে বেশি ঝুঁকি রয়েছে।
আর নিউইয়র্ক শহরের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। বিশেষত বেসকারি প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ জীবন যাপন করেন। কর্মক্ষেত্রের ঝুঁকি একই থাকলেও সরকারি কর্মীদের মতো নেই কোনো আর্থিক নিরাপত্তা। স্যানিটেশন বিভাগের ইউনিয়নভুক্ত পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা স্বাস্থ্যসেবা, পেনশনসহ সম্মিলিতভাবে ৬৯ হাজার ডলারের আর্থিক নিরাপত্তা পান। কিন্তু বেসরকারি পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের জন্য এমন কোনো নিরাপত্তা নেই। তাঁরা শিফটপ্রতি ৮০ ডলার হিসেবে কাজ করেন। নেই কোনো ওভারটাইমের ব্যবস্থাও। আর স্বাস্থ্যসেবা কিংবা অবসরোত্তর আর্থিক সুবিধার তো কোনো প্রশ্নই নেই।
এটি ইউনিয়নভুক্ত নয় এমন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সব পরিচ্ছন্নতাকর্মীর জন্যই সত্য। এই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ৬০ শতাংশের বেশি আবার সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর, যাদের বার্ষিক আয় ৩৫ হাজার ডলারের নিচে। প্রোপাবলিকার তথ্যমতে, ২০১৬ সালে আমেরিকায় নিহত পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ৮০ শতাংশই ছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের। নিউইয়র্ক শহরে ২০১৪ সাল থেকে মিউনিসিপ্যাল ট্রাক দুর্ঘটনায় কোনো পরিচ্ছন্নতাকর্মী মারা না গেলেও, শুধু ২০১৭ সালেই সাত বেসরকারি পরিচ্ছন্নতাকর্মী মারা গেছেন এমন দুর্ঘটনায়।
প্রোপাবলিকার অনুসন্ধানে নিউইয়র্কের পাঁচটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এতে ৭১ শতাংশ পরিচ্ছন্নতাকর্মী কাজের সময় আহত হয়েছিলেন বলে জানান। এর মধ্যে ৯৩ শতাংশ জানান, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সম্পর্কিত কোনো প্রশিক্ষণ তাঁদের দেওয়া হয়নি। আর ৬২ শতাংশের ভাষ্যমতে, তাদের আবর্জনাবাহী ট্রাকটি নিরাপদ নয়। শুধু এখানেই শেষ নয়, অনেকেই জানান, কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন সংকট সম্পর্কে কর্তৃপক্ষকে জানাতে তাঁরা ভয় পান। কারণ, তাঁরা মনে করেন যে অভিযোগ করলে তাঁদের শিফটের সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হবে।
মেমফিস ধর্মঘটের ৫০ বছর পরও আমেরিকার পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নিরাপদ নন। না তাঁদের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ উন্নত হয়েছে, না দেওয়া হচ্ছে যৌক্তিক বেতন–ভাতা। এমনকি সামাজিক নিরাপত্তা জালের আওতায় নেই অধিকাংশ পরিচ্ছন্নতাকর্মী। ফলে ১৯৬৮ সালের বাস্তবতাতেই এক রকম স্থির হয়ে আছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা। এই অবস্থায় সামষ্টিক আন্দোলন ছাড়া আর কোনো পথ দেখছেন না বিশ্লেষকেরা।
১৯৬৮ সালে মার্টিন লুথার কিং বলেছিলেন, ‘পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সাহায্যে যদি আজ আমি এগিয়ে না আসি, তাহলে তাদের ভাগ্যে কী ঘটবে?’ এই একই প্রশ্ন আরও দৃঢ়ভাবে এখন আবার উচ্চারণের সময় এসেছে।