প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে জাগছেন অশ্বেতাঙ্গ প্রার্থীরা

ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়াটা আমেরিকার অনেক ক্ষেত্রেই বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। বলা হচ্ছে আমেরিকাকে উল্টোরথের সওয়ার করেছেন তিনি। তাঁর ওভাল অফিসে প্রবেশের পর থেকে নারীর প্রতি বৈষম্য, বর্ণবাদসহ বহু বিষয় সামনে উঠে এসেছে। প্রেসিডেন্ট পদে তাঁর এক বছর পূর্তিতে আগের বছরের ২০ জানুয়ারির মতোই আমেরিকা শুনেছে নারী আন্দোলনকারীদের সোচ্চার কণ্ঠ। আর এবার জেগে উঠেছেন অশ্বেতাঙ্গ রাজনীতিকেরা। আর নারীদের মতোই তাঁদের এ জেগে ওঠার পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পই।

আমেরিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে যে কাজটি বারাক ওবামা করতে পারেননি, ঠিক সেই কাজটিই করে দেখাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে একটু অপ্রচল পন্থায়। তাঁর শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী বিভিন্ন বক্তব্য অশ্বেতাঙ্গদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিয়েছে। আর এই নিরাপত্তাহীনতা থেকেই তাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠছেন। এমন নয় যে আমেরিকায় অশ্বেতাঙ্গরা আগে রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু এখন তাঁরা নির্বাচনে সরাসরি অংশ নেওয়ার কথা ভাবছেন এই বোধ থেকে যে নিজেদের অধিকারের সুরক্ষা নিজেদেরই সামনে থেকে করতে হবে।
ক্যালিফোর্নিয়ার অরেঞ্জ কাউন্টির আইনের অধ্যাপক ও ওয়াশিংটন ডিসির সাবেক রাজনৈতিক সহযোগী মিনের প্রসঙ্গ এখানে টানা যেতে পারে। রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত থাকলেও তিনি আগে কখনোই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা ভাবেননি। কিন্তু এখন কোরীয় মা-বাবার এই সন্তান এ কথাই ভাবছেন। আর এই ভাবনার পেছনে রয়েছে প্রেসিডেন্টের নেওয়া একটি সিদ্ধান্ত।
সিএনএনকে মিন বলেন, ‘মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে অভিবাসী নেওয়া সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার যে সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্ট নিয়েছেন, তা অনেকটা চপেটাঘাতের মতো। অভিবাসীর সন্তান হিসেবে এটি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করেছে। কারণ এই সিদ্ধান্তের অর্থ হচ্ছে, এই দেশ ধর্ম ও বংশলতিকার বিচারে তার নাগরিকদের আলাদা করতে চাইছে। আর এই বোধ থেকেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা অনেক কঠিন ছিল। এত দিন একজন ভালো নাগরিক হিসেবে, ভালো বাবা হিসেবে বেঁচে ছিলাম। কিন্তু এদিকে বিপদ ঘনিয়ে আসছে। আমেরিকার আত্মা এক কঠিন মুহূর্তের সম্মুখীন হয়েছে।’
উচ্চশিক্ষিত এই ব্যক্তি আগামী নির্বাচনে লড়বেন রিপাবলিকান প্রতিনিধি মিমি ওয়ালটার্সের বিরুদ্ধে। তাঁর মতে, ডেমোক্র্যাটরা যদি তাঁর মতো মানুষকে মূল্যায়ন করে, তাহলে এশীয় ও লাটিন অভিবাসীদের এই অঞ্চল থেকে তারা বিজয়ী হতে পারবে।
শুধু মিন নন, একইভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন আরও অনেক অশ্বেতাঙ্গ রাজনীতিক ও নাগরিক নেতা। মূলত অভিবাসী ও অশ্বেতাঙ্গদের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের বিরূপ মনোভাবই তাঁদের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার লড়াইয়ের মাঠে হাজির হতে উদ্বুদ্ধ করেছে। তাঁদের মতে, ট্রাম্প যে নীতি গ্রহণ করেছেন, তা আমেরিকার সংখ্যালঘুদের জন্য ভয়াবহ। আর এই সংকট মোকাবিলার একটি মাত্র পথই রয়েছে, তা হলো নির্বাচনে অংশ নিয়ে নিজেদের নীতিনির্ধারণী কেন্দ্রের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া।
এশিয়ান আমেরিকান প্যাসিফিক আইল্যান্ডারের (এএপিআই) প্রেসিডেন্ট বরুণ নিকোর বলেন, এই বছরের কংগ্রেস নির্বাচনে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী দৌড়ে প্রায় ৬০ জন প্রার্থী অংশ নিতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অবশ্য নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই কর্মকাণ্ড অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই রান ফর সামথিং নামের একটি সংগঠন সম্ভাব্য ১৫ হাজার প্রার্থীকে প্রশিক্ষণ দিতে এক বিশেষ কার্যক্রম হাতে নেয়। সংগঠনটির সহপ্রতিষ্ঠাতা ও হিলারি ক্লিনটনের প্রচার দলের সাবেক সদস্য আমান্ডা লিটম্যান জানান, এই সম্ভাব্য প্রার্থীদের দুই-তৃতীয়াংশই নারী। আর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অশ্বেতাঙ্গ।
ক্যালিফোর্নিয়ার অরেঞ্জ কাউন্টির মিনের মতো ইলিনয়ে রিপাবলিকান প্রতিনিধি র‍্যান্ডি হাল্টগ্রেনের বিরুদ্ধে আগামী নির্বাচনে যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র লরেন আন্ডারউডই অশ্বেতাঙ্গ ও নারী। কোনো একদিন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার চিন্তা করলেও তা যে এত তাড়াতাড়ি হবে, তা এমনকি লরেনও ভাবতে পারেননি। ওবামা প্রশাসনের স্বাস্থ্য ও মানবসেবা বিভাগের এই উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা যে ২০১৮ সাল হবে, এমন কোনো ভাবনা ছিল না। কিন্তু হিলারি ক্লিনটন হেরে গেলেন। আর ওয়াশিংটনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চলে গেল রিপাবলিকানদের হাতে। এরপর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে রিপাবলিকানদের আনা স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনে যেদিন হাল্টগ্রেন সই করে বসলেন, সেদিনই আমি এই প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হই। গণতন্ত্রের স্বার্থে আমার মতো অনেকেই এখন এমন কিছু করছে, যা আগে তারা কখনো করেনি।’
আন্ডারউডের নির্বাচনী এলাকার বাসিন্দাদের ৮৫ শতাংশেরও বেশি শ্বেতাঙ্গ। ফলে তাঁর এই প্রার্থী হওয়াটা শুধু শ্বেতাঙ্গ নয়, কৃষ্ণাঙ্গদের কাছেও এক বড় বিস্ময় হয়ে হাজির হয়েছে। সিএনএনকে তিনি বলেন, ‘ভোটিং রাইটস অ্যাক্ট কার্যকর রয়েছে এমন অঞ্চলগুলো থেকে সাধারণত কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানরা নির্বাচনে প্রার্থী হন। কিন্তু আমি এমন জায়গা থেকে প্রার্থী হয়েছি, যেখানে ৮৫ শতাংশই শ্বেতাঙ্গ।’
তবে অনেক অশ্বেতাঙ্গই আসছে কংগ্রেস নির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণা করলেও কতজন শেষ পর্যন্ত টিকবেন, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে। কারণ, ডেমোক্র্যাট দল থেকে শুধু অশ্বেতাঙ্গরাই প্রার্থী হচ্ছেন না। রয়েছেন অনেক শ্বেতাঙ্গ প্রার্থী। প্রাথমিক নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পেতে এ ক্ষেত্রে প্রচার কার্যক্রমের বড় ভূমিকা থাকবে। এই কার্যক্রমের জ্বালানি অর্থাৎ প্রচার তহবিল যার যত বেশি থাকবে, সে অনেকটাই এগিয়ে থাকবে। ফলে এবারে এই বিষয়টির প্রতিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠন। সম্মিলিতভাবে অশ্বেতাঙ্গ প্রার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে এসব সংগঠন।
এই বিষয়ে এএপিআইয়ের প্রেসিডেন্ট বরুণ নিকোর বলেন, ‘অন্য সংগঠনগুলোর সঙ্গে আমরা একযোগে কাজ করছি। কারণ, আমরা মনে করি জোটবদ্ধতার মাধ্যমে আমাদের পক্ষে বেশি ক্ষমতা অর্জন সম্ভব।’
আর ল্যাটিনো ভিক্টরি প্রজেক্টের রাজনৈতিক পরিচালক মায়রা ম্যাকিয়াস বলেন, ‘আমরা মূলত ল্যাটিনো সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে এমন অঞ্চলগুলোয় বেশি মনোযোগ দিচ্ছি। একই সঙ্গে অন্য সংগঠনগুলোকেও সহায়তা করার নীতি আমরা গ্রহণ করেছি। ল্যাটিনোরা অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি ঐক্যবদ্ধ। আর এই ঐক্য জোরদারের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ধন্যবাদ না জানিয়ে উপায় নেই।’