বিশৃঙ্খল আমেরিকা, নির্লিপ্ত প্রেসিডেন্ট

নিউইয়র্কে ট্রাম্প বিল্ডিংয়ের বাইরে অভিবাসীদের পক্ষ বিক্ষোভ। ফাইল ছবি: রয়টার্স
নিউইয়র্কে ট্রাম্প বিল্ডিংয়ের বাইরে অভিবাসীদের পক্ষ বিক্ষোভ। ফাইল ছবি: রয়টার্স

আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলেছিলেন ‘সক্রিয়তার সময়’ এই শুরু হলো। সদ্য সাবেকের গলফপ্রীতিকে কটাক্ষ করে তিনি বলেছিলেন এ ‘খেলাঘর’ নয়, যে খেলেই সময় কাটানো যাবে। তিনি আভাস দিয়েছিলেন যে আমেরিকার আকাশে এক নক্ষত্রের উদয় হতে চলেছে, কর্মই যার ধ্যান, কর্মই যার জ্ঞান। আমূল বদলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল এবং এখনো আছে তাঁর সব কথার সারবিন্দুতে। কিন্তু এখন এই বিশৃঙ্খল সময়ে, যখন ওয়াশিংটন থেকে ওয়াল স্ট্রিট পুরোটাই অস্থির হয়ে উঠেছে, তখন তাঁকে দেখা যাচ্ছে দর্শকের আসনে। পাঠক বুঝে যাওয়ার কথা যে এই তিনিই সেই ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে ধন্ধ লাগতেই পারে। কারণ, তাঁর কথার খই এখন আর অত একটা ফুটছে না। তিনি এখন যেন আবার দ্য অ্যাপ্রেনটিসের বিচারকের আসনে বসে আছেন।
কদিন আগেই মার্কিন শেয়ারবাজারের রমরমা অবস্থার পুরো কৃতিত্ব নিজের ঝুলিতে ভরেছেন তিনি। কিন্তু গণেশ উল্টে যেইমাত্র এই শেয়ারবাজার গত কয় বছরের মধ্যে সবচেয়ে অস্থিতিশীল অবস্থায় উপনীত হলো, অমনি তিনি মুখে কুলুপ এঁটে বসেছেন। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এনে দেওয়ার দাবি জানানো এই প্রেসিডেন্ট আক্ষরিক অর্থেই পুঁজিবাজারকে ভুলে যেতে চাইছেন যেন। প্রতিরক্ষা বাজেটসহ বিভিন্ন বিষয়ে কিছুদিন আগেও ব্যাপক সরগরম বক্তব্য দিলেও অনেকটা তাঁর সংযুক্তি ছাড়াই কংগ্রেস দুই বছরের বাজেট পাস করেছে। এমনকি হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের পদত্যাগ নিয়েও তাঁর কণ্ঠে তেমন জোর কোনো বক্তব্য আসছে না। একেবারেই যে আসেনি, তা নয়। রব পোর্টারের পদত্যাগ নিয়ে তিনি দুই লাইন বলেছেন। আর তা অবধারিতভাবেই উসকে দিয়েছে বিতর্ক।
তবে কোনো রাষ্ট্রের শীর্ষ কর্তার সময়ে সময়ে মৌনব্রত পালন নতুন কিছু নয়। এটা প্রয়োজনীয়ও বটে। এমন সময় আসতেই পারে যে চারপাশে কাঙ্ক্ষিত মান ও গতিতে কাজ চলবে, আর প্রেসিডেন্ট অর্কেস্ট্রার নিয়ন্তা হিসেবে ছড়ি ঘুরিয়ে চলবেন, অহেতুক বাক্যবাজি ছাড়াই। তবে যখন এই শীর্ষ কর্তার নামটি ডোনাল্ড ট্রাম্প, তখন বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। নিজ মহাবিশ্বের একমাত্র নিয়ন্তা হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করা ট্রাম্পের পক্ষে এতটা নীরবতা ঠিক মানায় না। আনুষ্ঠানিক না হোক, অনানুষ্ঠানিক বক্তব্যের জন্য টুইটার তো রয়েছেই ‘টুইটার প্রেসিডেন্টের’ কাছে। কিন্তু তিনি কিছুই বলছেন না। হয়তো তিনি অতিসত্বরই এই নীরবতা ভাঙবেন, হয়তো দর্শকসারি থেকে উঠে এসে মঞ্চে দাঁড়াবেন আবার পুরোদস্তুর তারকা হিসেবে আবার। আলোচনার কেন্দ্রটি বেশিক্ষণ তাঁর থেকে দূরে থাকবে—এটা ভাববার কোনো কারণ নেই।
অভিবাসন বিষয়ে আলোচনার সময় সম্প্রতি ট্রাম্পের এই নীরবতার প্রসঙ্গে ডেমোক্র্যাট সিনেটর ক্রিস কুনস বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট নিজেকে একজন বিরাট সমঝোতাকারী হিসেবে দাবি করেন। একই সঙ্গে চুক্তি করার শিল্প রপ্ত করেছেন বলেও দাবি করেন তিনি। কিন্তু মাঝে মাঝে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদানটি হয়, যখন তিনি নিজের অবস্থানের জানান দিয়ে আমাদের কাজ করার ফুরসত দেন এবং চুপ থাকেন।’
ক্রিস কুনসের এই বক্তব্য সত্য ও তির্যক। কিন্তু এই বক্তব্যের পরও কোনো পাল্টা তির ছুড়ে দেননি ট্রাম্প। অন্য কিছু না থাকলেও তাঁর হাতে তো টুইটার ছিল। কিন্তু সেখানেও তিনি নীরব। ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের অবস্থান কখনো সবিস্তারে জানান না। কিন্তু ছোট ছোট টুইটার পোস্টের মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে নিজের পরিবর্তনশীল অবস্থানের কথা নিয়মিতই জানান। কখনো কখনো তিনি চলমান গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন আলোচনার সময় এমন সব অবস্থান এর মাধ্যমে প্রকাশ করেন, যা পুরো আলোচনার গতিপথ কিংবা ঘটনার কেন্দ্রটি বদলে দেয়। এমনকি নিজের প্রশাসন নিয়েও তাঁকে হরহামেশাই আগুনে সব বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। কিন্তু হোয়াইট হাউস থেকে ওয়াল স্ট্রিট পর্যন্ত একের পর এক ঘটনা ঘটলেও তিনি এখন একদমই নির্লিপ্ত হয়ে আছেন। এমনকি সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সাবেক প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটন, উত্তর কোরীয় নেতা কিম জং–উন, ইরান, ইসরায়েল–ফিলিস্তিন কোনো কিছুই তাঁকে উদ্দীপ্ত করতে পারছে না। এমন নীরব এমন নিস্পৃহ ডোনাল্ড ট্রাম্প সত্যিই দুর্লভ। এ যেন কলিঙ্গের যুদ্ধের পর সম্রাট অশোকের বৈরাগ্যের মতো। কিন্তু ট্রাম্প কোন যুদ্ধটি জিতেছেন?
ট্রাম্পের এই দার্শনিক নির্লিপ্ততা যেন পেয়ে বসেছে হোয়াইট হাউসকেও। বিভিন্ন ক্ষেত্রেই ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা নির্লিপ্ত সব বক্তব্য দিচ্ছেন। সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন জানান, এই বছরের মধ্যবর্তী কংগ্রেস নির্বাচনে রাশিয়া এরই মধ্যে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছে। কিন্তু এটি বন্ধে আমেরিকার করার তেমন কিছু নেই।
ফক্স নিউজকে তিনি বলেছেন, ‘(নির্বাচনে রাশিয়ার) যোগসাজশের লক্ষ্য থেকে থাকলে, তারা একটা না একটা পথ খুঁজে বের করবেই। আমরা চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু যতই চেষ্টা করি, তারা যদি এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তাহলে তা তারা করবেই।’ ব্যাপারটা অনেকটা এমন যে ‘বাবা কিসে কী হয়, সবই অনিত্য, সবই নিয়তি।’ নির্বাচনে রুশরা যোগসাজশের ইচ্ছা করলে তা থামাবে কে। নিয়তিতে থাকলে রুশরা নির্বাচন নিয়ে খেলবেই।
এমন ধারা বক্তব্য শোনা গেছে দক্ষিণ কোরিয়া সফররত ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের কাছ থেকেও। হোয়াইট হাউসে চলমান অস্থিরতা সম্পর্কে তাঁর কাছে জানতে চাইলে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আইনসভার কার্যালয় ও প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছে। কিন্তু ভোট সামনে রেখে আমরা একরকম স্ট্যান্ডবাই অবস্থায় রয়েছি।’
প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কিছু নির্দিষ্ট সময়ে রিজার্ভ বেঞ্চে বসে থাকার নজির আগেও দেখা যায়। বিল ক্লিনটনের সময়ে, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন পাসের লক্ষ্যে গঠিত টাস্কফোর্সের প্রধান করা হয় হিলারি ক্লিনটনকে। কিন্তু এ বিষয়ে বিস্তারিত একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের পরও তা ক্যাপিটল হিলে আটকে যায়। আর এই অভিজ্ঞতা থেকেই ক্লিনটন ও তাঁর উত্তরসূরিরা বিশেষ মুহূর্তে নীরবতা অবলম্বনের নীতি গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এই নীতি নিয়েছিলেন ‘নো চাইল লেফট বিহাইন্ড’ শীর্ষক শিক্ষা প্রকল্পের জন্য। স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়নের সময় একই নীতি নিয়েছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও।
কিন্তু ট্রাম্পের বাস্তবতা তূলনামূলক আলাদা। যে বিভাজনের রেখা তিনি টেনেছেন, তা দিন দিন গাঢ় হয়েছে। এই বিভাজনের মধ্যে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প একরকম নীরব থাকতে বাধ্য হচ্ছেন বলা যায়। বিশেষত গত সপ্তাহে বাজেট পাসের আগে তিনি বলেছিলেন, ‘অভিবাসন বিষয়ে কোনো সুরাহা না হলে প্রয়োজনে সরকার অচল হোক। কিন্তু কঠোর অভিবাসন আইন ছাড়া কোনো ব্যয় বরাদ্দ নয়।’ কিন্তু সিনেট নেতারা তাঁর সেই কথা শোনেননি। তাঁরা অভিবাসন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই বাজেট পাস করেছেন।
অর্থাৎ ট্রাম্পের এই নীরবতা তাঁর প্রকল্পিত নয়, বরং এই নীরবতার পেছনে রয়েছে কংগ্রেস ও সিনেট নেতাদের প্রচ্ছন্ন অবজ্ঞা। বিষয়টি আর অনুমানে নেই। নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিল ক্লিনটনের সময়ের হোয়াইট হাউসের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ মারিয়া একাভেস্তে সরাসরিই বলেছেন, ওয়াশিংটনের অন্য খেলোয়াড়েরা, তা কংগ্রেসেরই হোক, কিংবা সিনেটেরই হোক এই উপসংহারে উপনীত হয়েছেন যে, ‘চলো তাঁকে এড়িয়েই চলি। আমাদের অনেক কাজ করার বাকি আছে।’ এ ক্ষেত্রে বাজেট ইস্যুটিই সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তিনি এ ক্ষেত্রে গঠনমূলক ছিলেন না। ফলে তাঁরা (সিনেট নেতারা) তাঁকে এড়িয়ে গেছেন।
এই একই কথার সমর্থন পাওয়া যায় সিনেটের ডেমোক্র্যাট দলীয় নেতা চাক শুমারের কথাতেও। তিনি বলেছেন, ‘যখন আমাদের হাতে অনেক কাজের বিপরীতে সময় থাকে খুব কম, তখন হোয়াইট হাউসকে এক পাশে সরিয়ে রেখেই আমরা কাজ করি।’
তবে বাজেট আলোচনার অন্তিমে ট্রাম্পের এই নীরবতা একরকম কাজে এসেছে। তিনি তাঁর চাওয়ামতো বড় প্রতিরক্ষা বরাদ্দ পেয়েছেন। তবে একই সঙ্গে বেড়েছে অভ্যন্তরীণ ব্যয় বরাদ্দও। তবে এই দুই কূল বাঁচাতে গিয়ে বাজেট ঘাটতি বেড়ে ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন কোটিতে দাঁড়িয়েছে, যা ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সঙ্গে মানানসই নয়। তিনি বাজেট কার্যালয়কে সুসংগঠিত করার পাশাপাশি, বাজেট ঘাটতি মুছে দেওয়া ও জাতীয় ঋণের পরিমাণ কমানোরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু এর বদলে তিনি আমেরিকানদের উপহার দিয়েছেন আরও বড় বাজেট ঘাটতি।
তবে একেবারে চুপ ছিলেন ট্রাম্প, এমনটা বললে সত্যের অপলাপ হবে। বাজেট ইস্যুতেই তিনি আনুষ্ঠানিক বক্তব্য না দিলেও টুইটারে পোস্ট দিয়েছেন। যথারীতি ডেমোক্র্যাটদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে তিনি মধ্যবর্তী নির্বাচনে আরও রিপাবলিকানকে বিজয়ী করার আহ্বান জানিয়েছেন। বোঝা যায় মধ্যবর্তী নির্বাচনই এ মুহূর্তে ট্রাম্প ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের ধ্যান–মন–জ্ঞান। কিন্তু সেই সূত্রেও ট্রাম্প তেমন একটা সরব নন। যতটা আছেন, তা ঠিক ট্রাম্পসুলভ নয়।