মহান ভাষা দিবসেও বিভক্ত প্রবাসী বাংলাদেশিরা

জ্যাকসন হাইটসের ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অস্থায়ী শহীদ মিনার
জ্যাকসন হাইটসের ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অস্থায়ী শহীদ মিনার

অনৈক্য আর বিবাদে বিভক্ত নিউইয়র্কপ্রবাসী বাংলাদেশিরা অমর একুশে ফেব্রুয়ারির মতো জাতীয় অনুষ্ঠানেও বিভক্তির ঊর্ধ্বে উঠতে পারল না। ক্রমশ শক্তিশালী অভিবাসী হিসেবে বাংলাদেশিদের বিচরণ লক্ষণীয় হয় উঠলেও কোনো বিষয়ে যেমন ঐক্য নেই, তেমনি ভাষা শহীদ দিবস নিয়েও নিউইয়র্কে আয়োজন হয় নানা সমিতি-সংগঠনের প্রায় অর্ধশত অনুষ্ঠান। সম্মিলিত আয়োজনে নেই কারও মাথাব্যথা। 

দেশে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সবাই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেও প্রবাসে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় একসঙ্গে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ সীমিত। তাই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিচ্ছিন্নভাবে প্রতি বছর নানা জায়গায় ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন করে। নিউইয়র্কের প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রশ্ন তুলেছেন, ভাষার প্রশ্নেও কি আমরা পারি না এক হতে? বাংলাদেশের একমাত্র বিষয় যার জন্য একটি আন্তর্জাতিক দিবস পালিত হচ্ছে। সেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে নিজেদের গণ্ডিতে না রেখে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে হবে। আর এই কাজটি করা নিউইয়র্ক থেকেই সহজ হবে। তাই আমরা কী পারি না একত্রে একটি বড় আয়োজনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে আমাদের গৌরবের কথা জানাতে? সবাই মিলে একটি জায়গায় স্থায়ী অথবা অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করে তাতে ফুল দিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এই প্রতিবেদক নিউইয়র্কপ্রবাসী সাধারণ মানুষ, শহীদ দিবসের নিয়মিত আয়োজক বাংলাদেশ সোসাইটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ও নিউইয়র্কের বাংলাদেশ কনসাল জেনারেল শামীম আহসানের সঙ্গে কথা বলেন।
নিউইয়র্কে ১৯৭৭ সাল থেকে নিয়মিত অমর একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবস পালন করে আসছে ১৮ হাজার সদস্যের সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটি। বর্তমান সভাপতি কামাল আহমেদ বলেন, ‘সবাই মিলে একুশে ফেব্রুয়ারি আয়োজন করলে আমরা সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করব। আমরাও চাই একসঙ্গে আয়োজন করতে। আপনি জানেন ফেব্রুয়ারি মাসে নিউইয়র্কে প্রচণ্ড ঠান্ডা থাকে। তাই চাইলেও উন্মুক্ত জায়গায় আয়োজনটি করা সম্ভব নয়। দূর-দূরান্ত থেকে হাজারো মানুষ আসেন শ্রদ্ধা জানাতে। আমাদের সাধ্য ও আয়ত্তের মধ্যে এত বড় হল রুম পাওয়া দুষ্কর। তারপরও আমি মনে করি, একসঙ্গে আয়োজন করা সম্ভব এবং শোভন হবে। প্রতিবারই আমাদের আয়োজনে থাকে অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রতি বছর অন্তত ১২০টি সংগঠন আমাদের আয়োজনে ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। আমাদের এবারের আয়োজন করা হয়েছেন উডসাইডের গুলশান টেরেসে।’
বড় হলরুম ও দিবসটিকে স্থানীয় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নিয়ে যাওয়ার কথা ফুটে উঠেছে অ্যাকটিভিস্ট ও চিত্রশিল্পী টিপু আলমের কথায়। তিনি বলেন, এত বড় একটি বিষয়কে স্থানীয় পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। আমেরিকার কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় সরকার এবং বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে একসঙ্গে একটি বড় আয়োজন করে, আমি মনে করি সবাই এর সঙ্গে যুক্ত হবে। যেকোনো বড় আয়োজনেই সবাই যুক্ত থাকতে পারলে গর্ববোধ করে। সরকারের পক্ষ থেকে যদি নিরপেক্ষভাবে সবাইকে মূল্যায়ন করে তাহলে বিষয়টি আরও সহজ হয়ে যাবে। তখন অর্থনৈতিক বিষয়টিও বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না। টাইম বা ম্যাডিসন স্কয়ারে যদি বড় হলরুম নিয়ে দিবসটির আয়োজন করা হয়, তবে বিষয়টা মূলধারার গণমাধ্যমও গুরুত্ব দেবে। এতে দেশের ভাবমূর্তি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। যার ফল দেশের সরকার ও প্রবাসী সবাই ভোগ করবে।
কলাম লেখক হাসান ফেরদৌস বলেন, আমি মনে করি, যে যেভাবে আয়োজন করছে সেটাই ভালো। আমরা সব ক্ষেত্রে বিভক্ত। নেতৃত্বে বিভক্ত। জাতীয় সার্থে বিভক্ত। এখান থেকে কথা বলা মনে গাছের গোড়ায় পানি না দিয়ে ডগায় পানি দেওয়া। গোড়া থেকে যদি কোনো উদ্যোগ না নেওয়া হয় তবে তা কোনোভাবেই সফল হবে না।
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান বাংলাদেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে কথা বলবেন বলে জানান। তিনি আরও বলেন, ‘আমি চাই ম্যানহাটনে বড় একটি হল রুম ভাড়া করে সম্মিলিতভাবে মহান একুশে উদ্‌যাপন করা হোক। বাংলাদেশ সোসাইটি, ঢাবি অ্যালামনাই ও মুক্তধারা দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত এই আয়োজন করে আসছে। তাঁরা যদি সত্যিকার অর্থে দেশের জন্য বড় কিছু করতে একমত হন তাহলেই বিষয়টি সফল হবে। আমি দলের নামও চাই না, নিজের নামও চাই না। দেশের সুনাম ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বব্যাপী। আমি চাই সবাইকে নিয়ে সম্মিলিতভাবে কাজটি করতে। এ বিষয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, কনস্যুলেট অফিস ও জাতিসংঘে স্থায়ী মিশনকেও আমাদের সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করব।’
ঢাবি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ২০০৬ সাল থেকে নিয়মিত শহীদ দিবসের আয়োজন করছে। বাংলাদেশ সোসাইটি দীর্ঘদিন ধরে এই আয়োজন করছে। আপনারা তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হয়ে নিজেরা পৃথক আয়োজন করছেন কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে সংগঠনের সভাপতি তাজুল ইসলাম বলেন, ‘দেশে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক দেওয়ার আয়োজক থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই নিরিখে এখানে আমরা চাই, শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার আয়োজনটি আমরা করব। অন্য সব আয়োজন যেমন আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অন্যরা করুক। আমরা অনেক আগে এ প্রস্তাব দিয়ে সোসাইটির সঙ্গে আলাপ করেছিলাম, কিন্তু তারা রাজি হয়নি। আমরা এখন যে আয়োজন করি তাতে আমাদের সংগঠনের নামও ব্যবহার করি না। আমরা ‘সম্মিলিত মহান একুশ উদ্‌যাপন’ এই ব্যানারে কাজ করে থাকি।’
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের তালিকাভুক্ত ৪৫টি সংগঠন ছাড়া আরও ৫০টির মতো সংগঠন এখানে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে। সবাই মিলে বড় আয়োজন করতে চাইলে আমরা সবার সঙ্গে থেকে সহযোগিতা করব। আমাদের এবারের আয়োজন উডসাইডের কুইন্স প্যালেসে। শিশু-কিশোর-কিশোরীদের জন্য তিনটি বিভাগে কবিতা আবৃত্তি, হাতের লেখা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছি।’
কনসাল জেনারেল শামীম আহসান বলেন, ‘নিউইয়র্কে সম্মিলিতভাবে শহীদ দিবস পালন একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হতে পারে। বাংলাদেশ কনস্যুলেট এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। নিউইয়র্কের বিভিন্ন এলাকায় বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বসবাস করেন। রয়েছে অসংখ্য সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন। সবাইকে না হোক বড় একটি অংশকে সঙ্গে নিয়ে আয়োজন করা কঠিন ব্যাপার। শহীদ দিবস একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সেই আলোকে অন্যান্য ভাষার মানুষকেও সম্পৃক্ত করার তাগিদ আছে। সেই কাজটি কনস্যুলেট ও মিশন নিয়মিত আয়োজন করছে। আমাদের এবারের আয়োজনটি করা হয়েছে ২৩ ফেব্রুয়ারি কনস্যুলেট কার্যালয়ে। একটি স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য আমরা চেষ্টা করছি। কুইন্স ব্যুরো প্রেসিডেন্ট মিলিন্ডা কাট্জের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তিনি আশার কথা শুনিয়েছেন। স্থায়ী শহীদ মিনার হলে সম্মিলিত ভাবে আয়োজন করাটি সহজ হবে।’
মুক্তধারা ফাউন্ডেশন ২৬ বছর ধরে ভাষা শহীদ দিবস পালন করে আসছে। শহীদদের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য শীত উপেক্ষা করেও শত শত মানুষ প্রতিবার জাতিসংঘ ভবনের সামনে রাত ১২টায় উপস্থিত হয়। মুক্তধারার প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বজিত সাহা আমেরিকার বাইরে থাকায় বিষয়টি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।