ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়...

ধ্রুবর (আসল নামটা গোপন থাকল) বয়স আট, জন্ম হয়েছে ঢাকায় এবং পড়ছে সেখানকার ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে। বেশ প্রাণচঞ্চল আর অত্যন্ত মেধাবী এই ছোট্ট শিশুর চোখে-মুখে অনেক আশাবাদী স্বপ্নের ছোঁয়া লেগে আছে। ধ্রুব বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে ওর মা-বাবা আর চারপাশের চেনাপরিচিত লোকদের সঙ্গে তার ভাষাগত যোগাযোগ রক্ষা করে যাচ্ছে। কিন্তু গত পরশু একটা ছোট্ট ঘটনা ওর পরিবারের সবাইকে একটা বিপদে ফেলে দিল।
ধ্রুব কম্পিউটারে ভিডিও গেম খেলছে আর অনর্গল হিন্দিতে নিজের সঙ্গেই কথা বলে যাচ্ছে। অবাক কাণ্ড! বিশুদ্ধ হিন্দি জবান এই আট বছরের শিশুর মুখে! সবাই খুব অবাক হলেও ওর মা কিন্তু মোটেও ততটা অবাক হলেন না। ওর মায়ের দাবি, এ জন্য দায়ী টিভি মিডিয়া, অর্থাৎ হিন্দি চ্যানেল। বাচ্চাগুলো কার্টুন নেটওয়ার্কের ওপর প্রায় সারাক্ষণই হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকে। আর এই কার্টুনগুলো ইংরেজি ভাষা থেকে হিন্দিতে রূপান্তরিত। বোঝা গেল, এই কচি কণ্ঠে বিশুদ্ধ হিন্দির জায়গা করে নেওয়ার পেছনের রহস্যটা কী? এবার সত্যি ভয় পেতে হলো!
বাংলা ভাষাটা অদূর ভবিষ্যতে বাংলা ভাষাতে থাকবে তো? যে ভাষার জন্য আমাদের এত প্রাণ, এত রক্ত ক্ষয়, সেই প্রিয় ভাষাটি ধীরে ধীরে হিন্দি-ইংরেজি সংমিশ্রণে এক কিম্ভূতকিমাকার ভাষায় পরিণত হয়ে যাবে, এটা ভাবতেই গা শিউরে উঠল। শুধু ভাবছিলাম, বুদ্ধদেব বসু যে অর্থে আধুনিক নগরসভ্যতাকে ‘সভ্যতার চণ্ডালবৃত্তি’ বলে গাল দিয়েছিলেন। মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের ভাষার বারোটা বাজানোর জন্য আমরা কি এই প্রক্রিয়াকে’ মিডিয়ার চণ্ডালবৃত্তি’ বলতে পারি না? কার্টুনগুলো বাংলায় রূপান্তর করে আমাদের জাতীয় চ্যানেলগুলোতে সহজ বাংলায় শিশুদের পাতে তুলে দেওয়া হয়তো প্রাথমিকভাবে খুব ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু চেষ্টা করতে অসুবিধা কোথায়? বলার অপেক্ষা রাখে না যে এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতিগত অবস্থান একটা অতি জরুরি বিষয়। যেসব টিভি চ্যানেল আমাদের নতুন প্রজন্মের বাংলা ভাষা ও শিল্প-সংস্কৃতির পথে অন্তরায়, সেসব চ্যানেলকে কি বিদায় করা যায় না? তাতে কিন্তু উপকার হতো আমাদের নতুন প্রজন্মের, যারা তিলতিল করে তাদের ছোট্ট ধমনিতে লালন করছে তাদের প্রিয় ভাষা আর হাজার বছরের গর্বিত ঐতিহ্য। জাতিগত কারণেই বাংলা ভাষার উপযুক্ত চাষবাস এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশি বাঙালিদের একটা বাড়তি সুবিধা আছে।
বাংলাদেশ একটা স্বাধীন দেশ আর সে দেশের মানুষের ভাষা হলো বাংলা। কিন্তু সত্যিই কি আমাদের সবার ভাষা বাংলা? যদি তা-ই হয়, তাহলে আমাদের আদিবাসীদের যে ভাষা আছে, তার অস্তিত্বটা কোথায়? যে সাঁওতাল অথবা কোচ শিশুটি ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, সেই শিশুটি রক্তে তার নিজস্ব সংস্কৃতির শিকড়টি কতটুকু গাঁথতে পেরেছে! এ ক্ষেত্রে বাংলার পাশাপাশি অন্যান্য উপজাতীয় সব ভাষাকে জাতীয় ভাষার মর্যাদা দিয়ে এদের রক্ষণাবেক্ষণে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়াটা খুবই জরুরি। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপজাতীয় ভাষা একটি বিষয় হিসেবে রাখা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ছাত্রদের বিষয় নির্বাচনে একটা স্বাধীনতা থাকতে পারে। ভারত বহু ভাষাভাষীর দেশ বলেই হয়তো লোকসভায় এক বক্তৃতায় সে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জহওরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘There is no question of any one language being more a national language than the other; Bengali or Tamil or any other regional language is as much the Indian national language as Hindi.’ একটা রাষ্ট্রে বিভিন্ন ভাষা থাকতেই পারে। বাংলা আমাদের প্রধানতম ভাষা। কিন্তু বাংলার পাশাপাশি অন্যান্য আদিবাসী ভাষার অস্তিত্বও এই ছোট্ট ভূখণ্ডে জায়গা করে নেওয়া উচিত। আমেরিকার প্রধান ভাষা ইংরেজি। কিন্তু ইংরেজির পাশাপাশি জনসংখ্যানুপাতে স্প্যানিশ, চায়নিজ, হিন্দি, ফরাসি ইত্যাদি সমানভাবেই আদৃত। কোনো আমেরিকান যদি মনে করেন তিনি ইংরেজি ভাষার পরিবর্তে স্প্যানিশ অথবা হিন্দি ভাষায় কথা বলে তাঁর জীবন কাটাবেন, তাতে কারও কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। আমেরিকার যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করতে হলেও কোনো একটি বিদেশি ভাষার ওপর অল্পবিস্তর দখল থাকা চাই। আমাদের জাতীয় ভাষাগুলো সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। রাষ্ট্রের প্রতিটি সচেতন নাগরিক এই ভূখণ্ডের অন্যান্য ভাষাভাষীর ভাষা নিয়েও সমানভাবে চিন্তা করবে, ভাববে এমনটাই কি স্বাভাবিক নয়?
শেষ কথা হলো, বাংলা ভাষা কোনো রকম হুমকি ছাড়াই আমাদের নতুন প্রজন্মের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াক, এটাই আমাদের প্রাণের দাবি। আর সেই সঙ্গে বাংলাদেশে অন্য যে প্রাচীনতম ভাষাগুলো রয়েছে, সেই ভাষাগুলোকেও সংরক্ষণ করা চাই। নিউইয়র্কেও সেই একই চিত্র। বাঙালি রক্তের শিশু ভাষার ডাকাতদের কবলে পড়ে দিশেহারা। এখানকার ইউটিউব থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইংরেজি মিডিয়াতে ছেলেমেয়েরা সারাক্ষণ হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকে। তাতে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। নিজের সংস্কৃতি, ভাষা থেকে আমাদের প্রজন্ম দূরে সরে যাচ্ছে। আমরা দৃঢ়ভাবে চাই যে আমাদের ভাষা মিডিয়ার ডাকাতদের কালো হাত থেকে রক্ষা পাক। আজ যে কারণে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, সেই দায় থেকেই আমাদের অন্যান্য অপেক্ষাকৃত দুর্বল ভাষাভাষীর মুখের ভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় নত হতে হবে। আর এই মহৎ কাজটি করার মানেই হলো প্রকারান্তরে আমাদের ভাষা আর সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া, ভালোবাসায় নত হওয়া। বাংলা ভাষার জয় হোক।