ভালোবাসা এরে কয়!

জানা কিংবা শোনা নয়, একেবারে নিজের চোখে দেখা ঘটনা। বছর চারেক আগে এবারের মতো ভয়াবহ তুষারঝড় বয়ে যায় নিউইয়র্কে। হিমশীতল ঠান্ডায় মিনিট দশেকের পথ হাঁটু পর্যন্ত বরফ মাড়িয়ে কাজে গেলাম। ডাউন টাউনে তখন বিকেল। চারদিক সুনসান নীরবতা। মাঝে মাঝে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে তুষারঝড় পুরো ম্যানহাটনে শাসন করছে নির্মমভাবে।

কাজে যাওয়ার আগেই ম্যাসেজ পেলাম ম্যানেজার বিলির। অনেক পুরোনো নিউইয়র্কার। আদি বাড়ি আমাদের পাশের দেশের একটিতে। ম্যাসেজে সে বলেছে, তুমি কাজে যাও! আমার আসতে দেরি হবে। তবে অবশ্যই আসব। দেখা হবে যথাসময়ে। বাইরে প্রচণ্ড বাতাসের সঙ্গে তুষার ঝরছে বিরামহীনভাবে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলছে, আজ সারা রাত এই তুষারঝড়ের তাণ্ডব চলবে। আগামীকাল দিন শেষে সব স্বাভাবিক হতে পারে বলে আশা। ট্রেনে চড়ে দেখি পুরো কামরা খালি। একান্ত যাঁদের কাজে যেতেই হবে, শুধু তাঁদের কয়জন কামরাতে বসে আছেন।
বিরূপ আবহাওয়া উপেক্ষা করে সাবওয়ে স্টেশন থেকে তুষারমাখা বৃষ্টিকে ছাতা দিয়ে ঠেকাতে ঠেকাতে গিয়ে ঢুকলাম কাজের জায়গায়। কাঁধের সাইড ব্যাগ ও হাতের ছাতা সামলিয়ে এক দৌড়ে লকার রুমে। সেখান থেকে রেডি হয়ে ডেস্কে বসতে না–বসতে শুরু হয়ে গেল ইন্টারকমে ক্রিং ক্রিং আওয়াজ। সব রেসিডেন্টসহ নামকরা ট্রেডিং হাউস থেকে আসছে উৎকণ্ঠিত নানা প্রশ্নসহ ফোন। সবাই একযোগে জানতে চাইছে, বিল্ডিংয়ের হিটিং ব্যবস্থা পুরোপুরি সচল আছে কি না। ইলেকট্রিসিটি চালু থাকবে কি না। এ ছাড়া বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলায় পর্যাপ্ত লোকবল তৈরি আছে কি না। নানা সতর্কতামূলক প্রশ্ন। কেউ আবার নিচে নেমে এসে সরাসরি জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে চাইছেন সবকিছু। সবার মাঝে উৎকণ্ঠার স্পষ্ট চিহ্ন। যার প্রভাব আমাদের মাঝেও এসে ভর করছে ধীরে ধীরে। বাইরে তুষারঝড়ের গতি যেমন বাড়ছে, তেমনি চারদিক ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসছে ভীতিকর চিত্র নিয়ে।
সংশয় আর ভয় নিয়ে বসের অপেক্ষা করছি। কারণ, অতীত অভিজ্ঞতায় জানা হয়ে গেছে, এ ধরনের বিরূপ পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে নানা উটকো ঝামেলা এসে উপস্থিত হয়। বসে সহকর্মীর সঙ্গে টুকটাক কথা বলে চাইছি খানিক চাপমুক্ত থাকতে। ঠিক তখন দেখি দরজার ওপাশে বিলি। আমাদের বস। পরনে লং কোট। পুরো শরীর তুষারে ঢাকা। দুই হাত লং কোটের ভেতর ঢোকানো। বাইরের দরজা পিঠ দিয়ে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে আসতে চাইছে বিলি। চোখে মুখে অস্বাভাবিক তাড়া। ভেতরে এসে অনেকটা ধমকের স্বরে আমাদের বলল, কী দেখছ হাঁ করে? তাড়াতাড়ি বক্স হিটার বের করে জলদি অন করো। বিলিকে ওভাবে সর্বাঙ্গে বরফ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ভাবলাম, হয়তো সে নিজেই ঠান্ডায় কাবু হয়ে আছে। কিন্তু আমাদের দুজনকে অবাক করে লং কোটের ভেতর থেকে বিলি বের করল দুটো ছোট ছোট বিড়ালছানা। যাদের বলা হয় কিটেন। লবির মেঝেতে দামি পুরু কার্পেটে হাঁটু মুড়ে বিলি খুব সাবধানে রাখল ওই বিড়ালছানাদের। ঠান্ডায় প্রায় জমে যাওয়া বিড়ালছানা দুটোর একটি নিঃসাড় হয়ে পড়ে আছে; অন্যটি কাঁপুনির চোটে দাঁড়াতেই পারছে না।
বক্স হিটার অন করে বিলির হাতে দিতেই সে কার্পেটে নিঃসাড় হয়ে পড়ে থাকা এবং পাশে টলমল করা দুটো বিড়ালছানার পাশে সাবধানে রেখে দিল। হিটার থেকে বের হতে থাকা গরম হাওয়াকে বারবার হাত দিয়ে পরখ করছে আর স্থির দৃষ্টিতে বিড়ালছানা দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখেমুখে যারপরনাই উদ্বেগ। তার আগে ডেস্কের কেবিনেট থেকে বের করে নিয়ে এল এক বান্ডিল সাদা রঙের তোয়ালে।
কতক্ষণ পরপর হাতের ছোট তোয়ালে হিটারের তাপে গরম করে পরম মমতায় বারবার মুছে দিচ্ছে ছানা দুটোকে। এভাবে মিনিট তিরিশেক কাটবার পর বিড়ালছানাগুলো আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসতে শুরু করল। বাইরে বিরামহীনভাবে চলছে তুষারপাত। সঙ্গে শোঁ শোঁ করে আওয়াজ দিয়ে ঝোড়ো বাতাস বইছে। হঠাৎ করে বিলি চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকাল। দেখে মনে হলো তার উৎকণ্ঠার রেশ অনেকটা কমে সে নিজেও স্বাভাবিক হয়ে আসছে। মিনিটখানেক কী যেন ভেবে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের বলছে, তোমরা খানিকক্ষণ ওদের দেখবে, আমি আসি। আমরা কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই বিলি ঝড়ের বেগে দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। কাউকে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করবার সুযোগ না দিয়ে। মিনিট পনেরো পর আবার ফিরে এল হাতে ডুয়েনরিড নামের দোকানের একটি সাদা ব্যাগ হাতে।
আবার মেঝেতে বিছানো কার্পেটে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। বিলি কিছুটা চেতনা ফিরে পাওয়া বিড়ালছানাদের পাশে। সবাই বিস্ময় করে ব্যাগ থেকে রের করল ছোট ছোট মিল্ক ফিডার সঙ্গে ছানাদের উপযোগী প্রোটিন মিল্ক, যা ছোট ছোট বোতলে থাকে। দু–চারজন রেসিডেন্টসহ আমি ও আমার সহকর্মী পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম, বিলি কী পরম মমতায় আর স্নেহের পরশ দিয়ে হৃদয়ের উষ্ণতা দিয়ে বিড়ালছানা দুটোকে সেই দুধ পান করিয়ে যাচ্ছে। আর ছানাগুলোর গলায় আগের মতো কষ্টের আর বেদনার কোনো আওয়াজ নেই। কতক্ষণ পরপর মৃদু আওয়াজ তুলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। কী অদ্ভুত সেই দৃশ্য। বিলির এই মহানুভবতা আমার চশমার কাচ ঝাপসা করে দিল।
ফিরে এলাম ডেস্কে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যরা ধীরে ধীরে নিজ নিজ অ্যাপার্টমেন্টমুখী হচ্ছেন। পাশে লবির দিকে চোখ পড়তেই দেখি ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত বিলি ছানা দুটোকে আবার পরম মমতায় সদ্য কেনা শিশুদের ব্ল্যাংকেট দিয়ে জড়িয়ে বুকের ওপর রেখে সোফায় হেলান দিয়ে গভীর ঘুমে। যতটুকু বললাম তা শুনে যদি পাঠকেরা ভাবেন বিলি একজন সত্যিকারের জীব আর প্রকৃতিপ্রেমিক, তাহলে বাকিটা শুনলে আপনারা কী বলবেন তা আমার জানা নেই। কয়েক সপ্তাহ পর কোনো এক কারণে বিলির বাসায় যেতে হলো। তার পারিবারিক কোনো কিছু এত জানা না থাকলেও এটা জানতাম, তাদের বিবাহিত জীবনে কোনো সন্তানের মুখ দেখেনি বিলি ও তাঁর স্ত্রী।
তবে তার বিড়ালপ্রীতির কথা ভালো করেই জানতাম। বসার ঘরের দেয়াল বিরাট পোস্টার আকারের এক বিড়ালের ছবি। আশপাশে আরও দু–চারটি ফ্রেমে বাঁধানো ছবি, যার সবটাতে বিলি ও তাঁর পরিবার মানে তিনটি বা চারটি করে বিড়াল। মিনিট চারেক পর আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখি, বাইরে যাওয়ার দরজার ওপাশ থেকে বিলি আমায় ডাকছে। দরজা খুলে বাইরে পা রেখে ডানদিকে তাকিয়ে আমি একেবারে হতভম্ব। আমি এসব কী দেখছি? বাইরের এই পাকা করা জায়গাতে শুধু বিড়াল আর বিড়াল। নানা রঙের, নানা আকারের, নানা বয়সের অনেক বিড়াল। আমাকে এভাবে আশ্চর্য হয়ে তাকাতে দেখে মুচকি হেসে শুধু এইটুকুই বলল, এই মুহূর্তে আমার পালিত বিড়ালের মোট সংখ্যা মাত্র ২৬, যার অর্ধেকেরও বেশি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে আনা। আমি জিজ্ঞেস করতে যাওয়ার আগেই একটি বাক্স এনে দেখাল। ওই দেখো, তুষারঝড়ের রাতে কুড়িয়ে আনা বিড়ালছানা দুটি এখন কেমন আছে। তাকিয়ে দেখি ওই দুটোকে একদম চেনাই যায় না।
এই কয়দিনেই দুটো ছানা বেশ নাদুসনুদুস হয়ে গেছে। সব দেখে ভাবছি, কীভাবে সামলায় বিলি এতগুলো বিড়াল! ভাবতে ভাবতে দুজনে প্রবেশ করলাম আবার তার বসার ঘরে। চলে যেতে যেতে দেয়ালে টাঙানো বিড়ালের ছবির বিষয়ে জানতে গিয়ে সব শুনে মনে হলো, আমি এক মানবসন্তানের পাশে নয়, পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ মানব সন্তানের পাশাপাশি দাঁড়ানো। পলকহীন দৃষ্টিতে ছবির দিকে তাকিয়ে বলল, পিলু নামের এই বিড়ালটিও কুড়িয়ে পাওয়া। তার সঙ্গে ছিল ভীষণ মিল। সারাক্ষণ বিলির সঙ্গে সঙ্গে থাকত। হঠাৎ করে অসুস্থ হলে ডাক্তার সব দেখে জানাল, ওর পেটে জটিল টাইপের টিউমার ধরা পড়েছে। আর সেটা অপারেশন করাতে হবে বোস্টনে উন্নত অ্যানিমেল হসপিটালে। দেরি না করে সব প্রস্তুতি নেওয়া হলো। বোস্টনে অসুস্থ পিলু (বিড়াল)কে নিয়ে যেতে শুধু অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া সাত হাজার ডলারের কাছাকাছি। সব মিলিয়ে বিল এল প্রায় পনেরো হাজার ডলার। সামান্যতম দ্বিধা না করে পিলুর জন্য বিলি ব্যয় করল এতগুলো ডলার।
তারপরও শেষরক্ষা হলো না। মাস ছয়েক পর পিলু স্থায়ীভাবে বিলিকে ছেড়ে চলে গেল অন্য জগতে। আনুষ্ঠানিকভাবে শেষকৃত্যসহ সব আচার পালন করে রেখে এল প্যাট সিমেট্রিতে (পশুদের কবরখানা), এখনো ভুলে যায়নি তার প্রিয় বিড়াল পিলুকে। প্রতিবছর পিলুর মৃত্যু দিবসে বিলি ওর কবরে যায়। ফুল দিয়ে পুরো কবরটা ঢেকে দেয়। অনেকক্ষণ বসে থেকে চোখের জল মুছতে মুছতে প্যাট সিমেট্রির গেট দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে বেরিয়ে আসে।