টু সারভাইভ?

“মাছে-ভাতে বাঙালি।” এ নিউইয়র্কেও টেবিলে মাছ না থাকলে মনে হবে খাবার পূর্ণ হলো না। অতৃপ্তি নিয়ে উঠতে হয়। আবার অন্য চিত্রও আছে। এ দেশে বেড়ে ওঠা আমাদের অধিকাংশ ছেলেমেয়ের কাছে মাছ অতটা প্রিয় নয়। কাঁটাবিহীন স্যালমন ফিশের কথা আলাদা। আমার নিজ ঘরের কথা জানি। চারজনের চার রকমের পছন্দ। এক. পছন্দ কাঁটাওয়ালা মাছ, দুই. পছন্দ কাঁটাবিহীন মাছ, তিন. কোনো মাছই পছন্দ নয়, চার. সব নয় ইলিশসহ কিছু মাছ পছন্দ। এই পছন্দের সমন্বয় করা খুবই কঠিন। আমার স্ত্রী এ কঠিন কাজটি করে যাচ্ছেন বিনা প্রতিবাদে। তাঁর অবশ্য পছন্দ কাঁটাওয়ালা মাছ। বলেন, যত স্বাদ সব তো কাঁটাওয়ালা মাছেই। এ জন্য তাঁর গ্রোসারিতে ইলিশ, পলি, মলা, আর কেচকির প্রাধান্য।
সে দিন টেলিভিশনে দেখলাম, দুই শ্বেতাঙ্গ যুবক লস অ্যাঞ্জেলেসের লিটল বাংলাদেশে এক রেস্তোরাঁয় খেতে বসেছে। মাছ-মাংসের প্রায় দেড় ডজন আইটেম। একটার পর একটার স্বাদ নিচ্ছিল। ইলিশে এসে ওরা আটকে গেল। কাঁটা। একটার পর একটা কাঁটা বের করছিল মুখ থেকে। কোনোটা দেড় ইঞ্চি লম্বা। চেহারায় একরাশ বিরক্তি। আমার পাশের দর্শকের মন্তব্য কাঁটা জেনেও খাবে কেন? প্রেসার কুকারে বিশেষ পদ্ধতিতে পুরো ইলিশের কাঁটা গায়েব করা যায়। এমন রান্না আমি খেয়েছি। চমৎকার। বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় বিশেষ পদ্ধতিতে পুরো মাছ রান্না করা হয় কাঁটাবিহীন করে। থাইল্যান্ড নাকি কাঁটা ছাড়িয়ে মাছ রপ্তানি করে ভালো উপার্জন করছে। সেদিন টিভি খবরে দেখলাম, বাংলাদেশে কাঁটাবিহীন ইলিশ রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। খবর শুনে আমার বউমা মন্তব্য করল, এটা মোটেই সুখবর নয়। এখন যা দু’চারটে ইলিশ পাই, তখন তাও পাব না।
আজকের লেখার মূল বিষয় মাছ নয়। অন্য কিছু। ওই দুই শ্বেতাঙ্গ যুবক এক ইয়েলো ট্যাক্সিতে যাচ্ছিল লিটল বাংলাদেশে। যাত্রায় ট্যাক্সির বাংলাদেশি চালককে ওরা জিজ্ঞেস করল, কেন সে এ দেশে এসেছে? চালকের উত্তর, টু সারভাইভ। খানিকটা ধাক্কা খেলাম। আরেক এক দর্শক সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন, ওহ্ নো। টু সারভাইভ বলবে কেন? সে তো সোমালিয়া-ইথিওপিয়া থেকে আসেনি। বাংলাদেশে কী মানুষ খেতে পায় না? বাঁচতে পারে না? সে বলতে পারতো “বেটার লাইফের” জন্য। এটাই সংগত। উন্নততর জীবন কে না চায়?
আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। “টু সারভাইভ” ওই ট্যাক্সিচালক যে প্রথম বলেছেন, তা নয়। অনেকেই বলেন, বিশেষ করে ইমিগ্রেশনে। রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনে ওসব অনেক কথা আসে। জীবনের নিরাপত্তা, নির্যাতন, হুমকি, অগ্নিসংযোগ, মামলা, গুম, গায়েব কত কিছু। সংখ্যালঘুদের জন্য কেস উপস্থাপনা কিছুটা সহজ। সব না হলেও কিছু তো বটে। সত্তরের দশকে জার্মানিতে জাসদ এবং নব্বইয়ের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় পার্টির কদর ছিল বেশি। বোঝা যায়, তা কেন?
ওই ট্যাক্সি চালক ইমিগ্রেশন সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছেন, তা নয়। দুজন ভোজন রসিকের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত কথোপকথনই বলা যায়।
কত বছর ধরে আছেন?
পনেরো বছর।
দেশে যান?
প্রতি বছরই যাই।
এতে পরিষ্কার, তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীও নন। হয়তো অনবধানতাবশত বলে ফেলেছেন। তিনি হয়তো জানেন না, তার এ কথা অন্যদের মনে আঘাত দেবে। যারা বাংলাদেশকে ভালোবাসেন, হৃদয়ে সর্বক্ষণ জন্মভূমিকে ঠাঁই দেন তারা বাংলাদেশের এমন চিত্র আঁকতে চান না। বড় কথা, আমেরিকায় বাংলাদেশিদের এক অতি ক্ষুদ্র অংশ রাজনৈতিক আশ্রয়গ্রহণকারী। বেশির ভাগই ফ্যামিলি ভিসা, স্টুডেন্ট ভিসা, স্কলারশিপ, চাকরি, ওপি, ডিভিসহ বৈবাহিক সূত্রে অভিবাসী হয়েছেন। “বেটার লাইফ” সবাই খোঁজেন। তার মানে এই নয়, বাংলাদেশ কিসিঞ্জারের “তলাবিহীন ঝুড়ি”র যুগে পড়ে রয়েছে। ষোলো কোটি মানুষের খাবার আসে এখন দেশ থেকেই। স্থিতিশীল জিডিপি বাংলাদেশকে শিগগিরই নিয়ে যাবে মধ্যম আয়ের দেশে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। এমন সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতিও নেই যাতে বলা যাবে এ দেশ সোমালিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন বা আফগানিস্তানের মতো। প্রাইভেট সেক্টর দিনে দিনে প্রসারিত হচ্ছে। আইটি, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প ছাড়াও শিক্ষিত যুবকেরা নিজেদের যুক্ত করেছেন কৃষিতে। না দেখলে বিশ্বাস হয় না, গ্রাম-গ্রামান্তরে শিক্ষিত যুবকেরা গড়ে তুলছেন কৃষি খামার। ফল-মূল, শাক-সবজি, মাছ, হাঁস-মুরগিসহ কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন করে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করছেন। না খেয়ে মানুষ মারা যায়, এখন অতীত ঘটনা মাত্র। সুশাসনের কিছু ঘাটতি আছে, এ জন্য “টু সারভাইভ” বলা যাবে না।
ভারতের বেঙ্গালুরুসহ বিভিন্ন স্থানে আইটি শিল্পের এত সমৃদ্ধি ঘটেছে, শোনা যায় প্রবাসী ভারতীয়রা আমেরিকা ছেড়ে ফিরে যাচ্ছে স্বদেশে। ভারতেই তারা খুঁজছে “বেটার লাইফ”। আমার স্বপ্ন, বাংলাদেশও উন্নতির এমন একপর্যায়ে পৌঁছাবে, যখন আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশিরা স্বদেশেই খুঁজবেন “বেটার লাইফ”। ট্যাক্সিচালক ভাইকে অনুরোধ করব, নেতিবাচক চিন্তা থেকে সরে আসুন, স্বপ্ন দেখুন, সম্ভব হলে আমার মতো।

লেখক প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক।