প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন কাদের কাছে যাবেন?

আমেরিকার ইমিগ্রেশন নিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিলাষ ভেঙে দিলেন তাঁর দলের ১৪ জন সিনেটর। খোদ হোয়াইট হাউস থেকে শুরু করে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগ অভিবাসন নিয়ে নতুন আইন প্রণয়নে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। নিজের দল রিপাবলিকান সিনেটরদেরই ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। প্রায় এক চতুর্থাংশ রিপাবলিকান আইন প্রণেতার বেঁকে বসার কারণে আপাতত ভেস্তে গেছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিবাসন সংস্কারের নামে অভিবাসন আইন প্রস্তাবের উদ্যোগ। যে উদ্যোগে তিনি ডাকা কর্মসূচির অভিবাসীদের সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে সংকুচিত করতে চেয়েছিলেন পারিবারিক অভিবাসন। সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের অর্থ প্রাপ্তিসহ ডিভি লটারি ভিসায় অভিবাসন বন্ধের উদ্যোগ ছিল তাঁর প্রস্তাবে।
ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প বহু অভিবাসীর দেশ আমেরিকার অভিবাসন নিয়ে চরম পন্থার অবস্থান নেন। নির্বাচনের আগে এবং ক্ষমতা গ্রহণের পরে তাঁর দেওয়া সব বক্তব্য বিবৃতিতে অভিবাসন বিরোধিতার অবস্থান নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। এ নিয়ে তাঁরও কোনো রাখ ঢাক নেই। আমেরিকায় একসময় ইউরোপের দেশ থেকে অভিবাসন ঘটেছে ব্যাপক হারে, ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীরাই এ দেশের মূল ধারা এখন। গত অর্ধ শতাব্দীতে আমেরিকার অভিবাসন জনারণ্য বদলে গেছে। এশিয়া থেকে, আফ্রিকা থেকে অভিবাসীদের আসার হিড়িক পড়ে। ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ঘটার পর সেসব দেশ থেকে আমেরিকায় অভিবাসনের হার কমতে থাকে। এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো থেকে অভিবাসনের প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব ইউরোপের দেশ থেকে অভিবাসন প্রবাহ অব্যাহত থাকে। এখনো অভিবাসীদের স্বর্গ রাজ্য হিসেবে মনে করা হয় আমেরিকাকেই। এ অবস্থাটি পালতে দেওয়ার মানসিকতা এখন আমেরিকার সমাজে প্রবল। আমেরিকায় জেগে ওঠা রক্ষণশীলতাকে উসকে দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রাজনৈতিক ভাবে চমক দিতে চান। এ চমকে তাঁর রাজনৈতিক উত্থান ঘটেছে। দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় আসার জন্যও তাঁর এ অবস্থান তিনি ধরে রাখবেন, বিষয়টি এখন পরিষ্কার।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মুসলমানদের আগমন নিয়ন্ত্রণ করতে চান। অভিবাসনের নামে আফ্রিকার দেশগুলো থেকেও লোকজনের আসা তাঁর পছন্দ নয়। মেক্সিকো থেকে অভীবাসী আসা বন্ধে তিনি তিনি দেয়াল নির্মাণ করতে চান। তাঁর এসব পরিকল্পনা নিয়ে নিজের দলের লোকজনই ঐক্যবদ্ধ নয়। রিপাবলিকান আইন প্রণেতাদের অনেকেই অভিবাসন নিয়ে এখন আরও শক্ত অবস্থানের পক্ষে। গত সপ্তাহে সিনেটে ভেস্তে যাওয়া অভিবাসন সংস্কার প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে গিয়ে রিপাবলিকান দলের অতি রক্ষণশীল ঘরানার সিনেটেরদের বিরোধিতা অভিবাসন নিয়ে জটিল অবস্থার নতুন ইঙ্গিত করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ওয়ামি থেকে নির্বাচিত সিনেটর জন বেরাসো। ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে আবার প্রার্থী হচ্ছেন তিনি। একদিন আগে বলেছেন, সিনেটে উপস্থাপিত অভিবাসন সংস্কার প্রস্তাবটি অনেকটাই উদার। একদিন পর সিনেটে এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি চাই সীমান্ত নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাক, অভিবাসন আইনের প্রয়োগ হোক এবং নাগরিকেরা নিরাপদে থাকুক।’ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে আমেরিকা আসা লোকজনকে বিতাড়ন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন। জন বেরোসা মনে করেন, শিশু অবস্থায় যারা এসেছে, তাদের বৈধতা দেওয়াটা ঠিক হবে না। অতি রক্ষণশীল এ আইন প্রণেতা এ কারণেই বেঁকে বসেন।
মেইন থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান সিনেটর সুজান কলিনস অভিবাসন সংস্কার নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে সমঝোতার একজন। প্রস্তাবটি সিনেটে উপস্থাপনেও ভূমিকা রাখেন এ সিনেটর। কিন্তু ভোটের সময় দেখা যায়, ভোট দিয়েছেন বিপক্ষে। সুজান কলিনস অভিযোগ করেছেন, হোয়াইট হাউসের চাপে সিনেটে উপস্থাপিত প্রস্তাবে ডিভি লটারি সম্পূর্ণ বাতিল করার কথা নেই। এ ছাড়া পারিবারিক অভিবাসনে মৃদু পরিবর্তনের কথা লেখা আছে বলে তিনি মনে করেন। অভিবাসন নিয়ে আরও কঠোর উদ্যোগ চান এ সিনেটর।
সিনেটর টেড ক্রুজ (টেক্সাস) মধ্যবর্তী নির্বাচনে আবার প্রার্থী। তিনি বেঁকে বসেছেন, ডাকা কর্মসূচির প্রায় ১৮ লাখ অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতা দেওয়াকে সাধারণ ক্ষমা করা হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। যারা আইন লঙ্ঘন করে আমেরিকায় অবস্থান করছে, তাদের সাধারণ ক্ষমতায় বৈধতা দেওয়ার বিপক্ষে চরম রক্ষণশীল এ সিনেটর।
মনটানা থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান সিনেটর স্টিভ সায়েনস ভোট দিয়েছেন বিপক্ষে। তিনিও মনে করেন, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নির্বাহী আদেশ দিয়ে ডাকা কর্মসূচির লোকজনকে অনুকম্পা দেখিয়ে সংবিধানে দেওয়া তাঁর ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। ডাকা কর্মসূচির লোকজনকে বৈধতা দেওয়ার কোনো প্রস্তাবে তিনি নেই। ওয়াইওমি থেকে নির্বাচিত সিনেটর মাইক এনজি বলেছেন, দেশের নাগরিকদের প্রতি ন্যায় বিচার করতে হবে। আইন লঙ্ঘন করে আসাদের কোনো অনুকম্পা দেখানোর পক্ষে তিনি নেই। তিনি অভিবাসন সমস্যাকে ভাগ ভাগ করে সমাধানের পক্ষে। সমন্বিত আকারে নয়। অ্যারিজোনা থেকে নির্বাচিত জেফ ফ্লেইক নিয়মিত অভিবাসনও নিয়ন্ত্রণের পক্ষে। তিনিও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সংস্কার প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেননি। ওকলাহোমা থেকে নির্বাচিত জিম ইনহোফি বলেছেন, অবৈধভাবে আমেরিকায় আসা লোকজনকে পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাবে তিনি নেই। যারা আইন মেনে আমেরিকার নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করছে, তিনি তাদের পক্ষে। ভোট দেননি নিজের দলের প্রেসিডেন্টের অভিবাসন সংস্কার প্রস্তাবে। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান সিনেটর জন কেনেডি বলেছেন, অভিবাসন সংস্কার প্রস্তাবে সীমান্ত রক্ষার যথেষ্ট উপাদান নেই বলেই তিনি বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। ইউটা থেকে নির্বাচিত সিনেটর মাইক লী বলেছেন, ভবিষ্যতে আমেরিকায় অবৈধদের উৎসাহিত করে, এমন কোনো প্রস্তাবে তিনি নেই। জেরি মোরান (ক্যানসাস), লিসা মারকোউস্কি (আলাস্কা), রেন্ড পল (কেনটাকি), বেঙ সাসি (নেব্রাস্কা) ও জন থাউন (সাউথ ডাকোটা) ভোট দিয়েছেন নিজের দল রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিবাসন সংস্কার উদ্যোগের বিপক্ষে।
মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অভিবাসী গ্রুপগুলোর মধ্যে উৎকণ্ঠা বাড়ছে। এর মধ্যে ডাকা কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হবে। অপ্রাপ্ত বয়স্ক হিসেবে আমেরিকায় আসা লোকজনের ভবিষ্যৎ কি হবে—এমন চিন্তার পাশাপাশি আমেরিকার অভিবাসন আইনের কি পরিবর্তন হচ্ছে। এ নিয়ে উদ্বেগ বিরাজ করছে। আমেরিকায় অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অভিবাসীরা এখন সর্বত্র ঝুঁকির মুখে। অভিবাসীদের নিয়ে ডেমোক্র্যাট দলের রাজনীতি আছে, কিন্তু ১৪ জন প্রভাবশালী রিপাবলিকান সিনেটরের ভোটদানের চিত্র থেকে যে চিত্র দেখা গেছে, তাঁর বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাটদের স্পষ্ট ঐক্যবদ্ধ কোনো অবস্থান নেই।
সব মিলিয়ে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আম ও ছালা—দুইই হারিয়েছেন। এত দিন নিজ দলের কট্টরপন্থীরা অন্তত তাঁর দিকে ছিলেন। কিন্তু সিনেটে বিল পাস করাতে ডেমোক্র্যাট ও উদারপন্থী রিপাবলিকানদের সমর্থন আদায়ে সমঝোতা করে কট্টরপন্থীদের হারিয়েছেন। রিপাবলিকান পার্টির কট্টরপন্থীরা যে নির্বাচনে জেতার সহজ রাস্তা চিনে গেছেন। আর ‘অভিবাসী’ বিরোধিতার সেই সহজ রাস্তাটাই ট্রাম্প নিজেই তাঁদের চিনিয়েছেন। এখন তাঁদের ফেরাবেন কীভাবে? নির্বাচনে জেতা যে বড় বালাই।