এক রোববারের গল্প

তা যে এমন কাজটা করবে ভাবতেও পারিনি, বলতে বলতে রহীম চাচা উঠে দাঁড়ালেন। বাইরে তখন ফাগুনের নিস্তব্ধ আকাশ। সন্ধ্যা নেমেছে। টুং টাং রিকশার শব্দ। হয়তো আকাশে গোটা কয় তারাও উঠেছে। কিন্তু দেখতে যাবে কে? সবাই যে ড্রয়িংরুমে গুম হয়ে বসে আছে। আম্মা কিছুক্ষণ আগে সবাইকে চা দিয়ে গেলেন। বাতিটা পর্যন্ত জ্বালানো হয়নি। তাহলে গল্পটা হয়তো গোড়া থেকেই শুরু করতে হয়।
আজ রোববার, ফাগুনের রোববার। শীত কেটে গেছে তো সেই জানুয়ারি মাসেই। তবু এখন শেষ হিমেল হাওয়াটা ভোরবেলায় অবগুণ্ঠন খোলার জন্য একটা শেষ দোলা দিয়ে যায়। তাই ভোরবেলাটা থেকে শীতের আমেজ মাখা। আর সেই সঙ্গে হালকা রোদ—একঝাঁক পাখির মতো। কিন্তু আজ সকালে পাখি ডেকেছিল কি মনে নেই। আমাদের বাসার সামনেই কৃষ্ণচূড়ার গাছ রয়েছে কয়েকটা। অবশ্য নীলক্ষেতের প্রায় সব বাড়িরই আনাচে-কানাচে এমনি গাছের কমতি নেই। আর ফুটে থাকা রক্তিম পলাশের পাশাপাশি কৃষ্ণকায় কোকিল একদম বেমানান নয়। কিন্তু আজ সকালে তো কোনো কুহু কুহু ডাক শুনিনি। তবে একটা উস্ উস্ আওয়াজ শুনেছিলাম। তারপর রীতা আপার কথা, আম্মার মৃদু স্বর এরপরই সব চুপচাপ। তবে ওই আওয়াজটা ছিল যে মোটরগাড়ির তখন বুঝতে পারিনি। অবশ্য জেনেছি অনেক পরে যে ওই গাড়িতে চড়ে রীতা আপা বাইরে গেলেন, সঙ্গে তশফীক ভাই। কিন্তু কেন এত সাতসকালে বেরিয়ে গেলেন, কোথায় গেলেন এগুলো প্রশ্ন তখুনি করা যেত যদি না কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে পড়তাম। সকালের ঘুম যে বড় প্রিয়।
আসলে কাল আমাদের রিহার্সাল ছিল। একুশ উপলক্ষে কলেজের ফাংশন। একুশ আসছে বলে সবখানেই প্রস্তুতি। এ যেন বাংলার মানুষের আনন্দ-বেদনার সঘন দিন। রাস্তায় আলপনা। বুকে কালো ব্যাজ। কণ্ঠে একুশের গান। এক উৎসর্গকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য আত্মনিবেদনের পালা। রিহার্সাল শেষে বাড়ি ফিরেছি রাত প্রায় দুটো। তাই আজ একটু দেরি হয়ে গেল। হাতমুখ ধুয়ে যখন খাবার টেবিলে এলাম তখন আম্মাও এলেন। ঠান্ডা রুটি খেতে হবে এটা বলেই আম্মা চা বানাতে লাগলেন। এমনিতেই উনি কথা বলেন কম। তবে আজ কেন যে একটু বড্ড বেশি রাশভারী মনে হলো। রাতে দেরি করে এসেছি বলে রাগ করেননি তো।
ঠিক আছে বলে আমি যখন রুটি মুখে দিয়েছি তখন দুকাপ চা নিয়ে আম্মা টেবিলে এসে বসলেন। দুজন মুখোমুখি। আমি চোখ তুলে তাকালাম। পেছনের জানালা দিয়ে ফাগুনের ভোরের রোদ আম্মার কাঁচা-পাকা চুলে আলতো ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে যেন। আমাকে মনে হলো যেন কোনো আলোর দিগন্ত থেকে ভেসে আসা শুভ্র কপোত।
শুধু চা খাচ্ছো যে আমিই নীরবতা ভাঙালাম। আমার খাওয়া হয়ে গিয়েছে, আম্মার চোখ দুটো চশমার মাঝ দিয়েও কাঁপছিল। তোমাকে আজ বেশ বিষণ্ন লাগছে, শরীর খারাপ করেনি তো। না, আচ্ছা বল তো তোদের এই একুশে কবে শেষ হবে। যেন আম্মা এই তো আর মাত্র দুদিন, তাই বুঝি রীতা এত সকালে বেরিয়ে গেল? আম্মার বিষণ্নতার কারণ বুঝলাম। একুশের ব্যস্ততার মাঝে যখন আমি আর রীতা আপা মগ্ন, তখন আম্মাকে বিব্রত করে রাখছি বৈকি। আসছি রাত করে। বেরিয়ে যাই সকালে। দৈনন্দিন রুটিন এই কয়েক দিন বড় এলোমেলো কিন্তু আজকের সকালটা মনে হচ্ছে আরও বেশি অনিয়মের মধ্যে চলছে।
তশফীক হঠাৎ গাড়ি নিয়ে এল কেন, বাবা এসে ঘরে ঢুকলেন। হাতে ভোরের কাগজ। তার আগে হয়তো কোরআন শরিফ পড়ছিলেন। টুপিটা এখনো মাথায় দেওয়া। বাবা ভূগোলের অধ্যাপক, ঢাকা কলেজের। রিটায়ার করার সময় প্রায় হয়ে গেল। ফুলার রোডের এই নতুন ফ্ল্যাটে এসেছি প্রায় এক বছর। রহীম চাচাই নিয়ে এসেছেন। ইতিহাসের অধ্যাপনা করেছেন বিভিন্ন কলেজে, এখন রিটায়ার করে প্রকাশনা ব্যবসায় জড়িত হয়েছেন। একসময় বাবার স্কুল সহপাঠী ছিলেন। সেই সখ্য এখনো আছে। বিপদে-আপদে উনিই আমাদের গাইড করেন। সেই রাজারবাগ থেকে কলেজে আসা আপার ইউনিভার্সিটির ক্লাস এসব অসুবিধা দেখে রহীম চাচাই ফ্ল্যাটটার খোঁজ দিয়েছিলেন।
তশফীক ভাই গাড়ি নিয়ে এসেছেন, কথাটা আমাকেও ভাবিয়ে তুলেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিস্ট্রি বিভাগের নামকরা ছাত্র তিনি। অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছেন। মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছেন। রেজাল্ট বের হয়নি। ধর্মঘটের জন্য সবকিছুই পিছিয়ে পড়ে আছে। ভালো ছাত্রদের বাবা খুব পছন্দ করেন। তাই রীতা আপা যখন কেমিস্ট্রিটা আরও একটু ঝালাই করার জন্য বাবাকে অনুরোধ করলেন তারপর থেকেই তশফীক ভাই যেন আমাদের শিক্ষক। পরিচয়ের সূত্রটা সেখান থেকেই। যদিও আসতেন সপ্তাহে এক দিন বা দুই দিন। আমিও সুযোগ পেলে বসে যেতাম জৈব রসায়ন নামক আমার জন্য পিলে চমকানো বিষয়টি নিয়ে। কেন জানি ওটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢুকতে চায় না। বাবাকে এই জন্য বলেছিলাম, আর্টসের কোনো বিষয় নিয়ে পড়ি। কিন্তু ‘বিজ্ঞান বিনে উন্নতি হবিনে’ এই গুরুবাক্যের কাছে সব তর্কই কুপোকাত।
তবে যেটা বলেছিলাম পরিচয় আর পড়াশোনার মাঝেই কি রীতা আপারা মন দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটা সেরে ফেলেছেন কি না সেটা বোঝার মতো বয়স হলেও ভাবিনি কখনো। ভদ্রলোক দেখতে শুনতে যেমন তেমন, হবে অত্যন্ত শৈল্পিক। পড়াশোনায় বরাবরই প্রথম। আবার ভালো কবিতা লেখেন ও আবৃত্তি করেন। কবিতার প্রতি আপারও নেশা আছে। গল্পটা মন্দ নয়। অনেকটা মিইয়ে যাওয়া সেতারের সুরে। ইউনিভার্সিটির ফাংশনে দুজনেই শুনলাম অংশগ্রহণ করেছেন। রিহার্সাল শেষে তশফীক ভাই আপাকে পৌঁছিয়ে দিয়ে যান। তবে কোনো দিন আম্মা না খাইয়ে ছাড়েন না। থাকতেন মুহসীন হলে। হোস্টেলে একই রান্নায় কার না অরুচি। আম্মা বোধ হয় সেটা আঁচ করেছিলেন। তবে কী আম্মা তশফীক ভাইকে পছন্দ করেছিলেন?
তো রীতা কখন ফিরবে জানা আছে কি? বাবার গলাটা যে এখন মোলায়েম নয় বুঝতে পারছি। আম্মারও ভাবনায় ছন্দপতন মনে হচ্ছে যেন একটা রহস্যের সূত্রপাত হতে যাচ্ছে। সত্যসন্ধানী আমার গুরু কিরীটী রায়ের কথা মনে হলো। ওই যে ড. নীহাররঞ্জন গুপ্তের রহস্য উপন্যাসের নায়ক। মনে মনে তাকে স্মরণ করে এবং অবশ্যি দুরু দুরু বক্ষে বাবাকে বললাম এমনও তো হতে পারে যে ফাইনাল রিহার্সাল চলছে। ফিরতেও দেরি হতে পারে। তাই রিকশার ঝামেলায় না গিয়ে গাড়ির জোগাড় করেছে।
কথাটা বাবা কেমনভাবে নিলেন জানি না। তবে মনঃপূত যে হয়নি সেটা বুঝলাম ওনার প্রথমত, অগ্নিদৃষ্টি এবং দ্বিতীয়ত, তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখ্যান দেখে। অবশ্য হাঁদারাম আমিও। এটা মগজে এল না যে মফস্বল শহরের ছেলে এবং থাকে হোস্টেলে, গাড়ি পাবে কোথা থেকে।
বিপদ থেকে উদ্ধার করল মিনু। আমার ছোট বোন। বকশীবাজার গার্লস স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ছে দুবছর ধরে। একদম আমার মতোই ডাম। মিনুর পরনে সাদা-লাল পাড়ের শাড়ি। একুশ এলেই এই শাড়ির ছড়াছড়ি। যেন ওই শুভ্রতার সঙ্গে লেগে আছে বরকত-সালাম-রফিক-জব্বারের রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি। দেখ তো ভাইয়া কেমন লাগছে। মিনুর কথায় এতক্ষণে বাবার সামনাসামনি থাকার ভয়টা কেটে গেল। কিন্তু এই শাড়ি এল কোথা থেকে? কেন, তশফীক ভাই সকালে দিয়ে গেলেন। বললেন, এটা পরে প্রভাতফেরিতে যাবে, কেমন? আবার তশফীক—
ভাবতে ভাবতেই দুপুর হয়ে গেল। রোদটা এখন তেতে উঠেছে। ফুলার রোডের পিচঢালা পথ চিকচিক করছে পলাশের রঙ্গে মিশে রক্তিম মরীচিকার মতো। ভাবছিলাম আজ রিহার্সালে না গিয়ে বরং বাংলা একাডেমির বইমেলাটা ঘুরে আসি। কয়েক দিন যাওয়া হয়নি। কিন্তু ওই যে রহস্যের ব্যাপারটা, এর জট না খোলা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না। সারা বাড়ি নিঝুম। একটা অদ্ভুত রোববারের নিস্তব্ধতা, মত পাল্টে থেকেই গেলাম বাড়িতে। দেখি আম্মার সঙ্গে একটু গল্প করা যায় কি না। সবাইকে খাইয়ে আম্মা বিকেলের চায়ের জোগাড় দিতে রান্নাঘরে যান। ওখানেই গেলাম। আম্মা সুজির হালুয়া বানিয়েছেন। উনানের আঁচে মার মুখটা আরও রক্তিম মনে হলো।
আম্মা, রীতা আপা তোমাকে কিছু বলে যায়নি? আমিই কথা শুরু করলাম। বলেছে। আজ ফাইনাল রিহার্সাল, ফিরতে দেরি হবে।
কিন্তু তোমরা এত উদ্বিগ্ন কেন? উদ্বিগ্ন কেন? আম্মা যেন চমকে উঠলেন।
না দেখছি, তুমি আর বাবা কেন ভাবছ ব্যাপার কী বলতে তো? একুশ আসবে বলেই কি সব নিয়ম ভেঙে যায়?
হাত থেকে চায়ের পেয়ালা পড়ে যেমন খান খান হয়ে যায়, আম্মার এই মেজাজি কণ্ঠ শুনে হনে হলো তেমনি কিছু। কোথায় যেন একটু গোলমাল হচ্ছে। ব্যস আর যায় কোথায়। রহস্য ভেদ করতে গিয়ে মাথাটাই ধরে এল যে। আহা এই সময়ে রীতা আপাটা থাকলে মন্দ হতো না। মনে আছে, কদিন আগেই প্রচণ্ড মাথাব্যথা নিয়ে যখন বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছি, আপা সারাক্ষণ মাথায় হাত বুলিয়েছেন। মাথা ধুইয়ে দিয়েছেন। আত্মজনের অদ্ভুত এই এক সেতুবন্ধন। তবে কেন জানি আপাকে মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। তবে পার্থক্য একটাই, আপার গায়ের রং শ্যামলা। বাংলার মাটির রঙেই রাঙানো। তবু একটা আভা আছে। চোখ দুটোতে সাগরের গভীরতা।
মাথা ধরা নিয়েই তন্দ্রার মতো এসে গিয়েছিল। তবে ঘুমাতে পারিনি। আবারও বুঝতে পারিনি বেলা যে শেষ হয়ে এল। ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। সাঁঝের আঁধার নামছে। ফুরফুরে বাতাস বইছে। কাঁপছে লতিয়ে ওঠা মাধবীলতা। মিনু এসে বলল, বাবা ডাকছেন। চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বসার ঘরে এলাম। দেখলাম রহীম চাচা এসেছেন এবং বেশ উত্তেজিত কিন্তু চাপা স্বরে কথা বলছেন বাবার সঙ্গে। অদূরে আম্মা বসে আছেন। চোখ দুটো ভাবলেশহীন। বুঝলাম দুপুর থেকে বিকেলের মাঝেই অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। আমার গোয়েন্দা চোখগুলোকে তাহলে আরও সতর্ক করে রাখার প্রয়োজন ছিল।
রহীম চাচা তাঁর স্বভাবসুলভ ময়মনসিংহের ভাষায় বাবাকে যেন ওঝার ঝাড়া দিচ্ছেন, ‘তোমাকে আগেই কইছিলাম রশীদ মিয়া, যার তার সাথে রীতা মাকে পড়াইও না, বয়স ওইছে না।’ রহীম চাচা আপাকে সব সময়ই রীতা মা বলে ডাকেন। তার কারণও আছে। ওনার একমাত্র পুত্র আমেরিকা থেকে ফিরছে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নিয়ে। মনে মনে ইচ্ছা, তার সঙ্গে রীতা আপার বিয়ে দেবেন। যদিও কেন জানি এই সংযোগটা আমার পছন্দ হয়নি। লোকটি বেজায় বেরসিক। আবার টমেটোর মতো গোলগাল চেহারা। সেই সঙ্গে আমেরিকার ডিম-মাখন-পাউরুটি দিয়ে ইয়া বড় এক পেট। আপা এখনো ফেরেনি, প্রশ্নটা আমার করার কথা নয়। তবে ফস করে বেরিয়ে গেল মুখ থেকে। সবাই যেন আমার উপস্থিতি অনুভব করল। তাহলে কি পাশের বাড়ি থেকে ওর বান্ধবী তাসনীমকে একটু ফোন করে আসব?
সেটার আর প্রয়োজন হবে না। এবারে রহীম চাচা সুর পাল্টিয়েছেন, বড্ড গম্ভীর এই কণ্ঠ। পকেটে হাত দিলেন। বের করলেন একটা ছোট্ট চিঠি। আমার হাতে দিয়ে বললেন, জোরে পড়ো। প্রথমে উঁচু স্বরেই শুরু করছিলাম। তারপর থেমে গেলাম। রীতা আপার চিঠি। রহীম চাচা মারফত পাঠিয়েছেন। ব্যাপারটা তাহলে খুলেই বলি। গত পরশু মাস্টার্সের রেজাল্ট বেরিয়েছে। বলাবাহুল্য, তশফীক ভাই প্রথম বিভাগে প্রথম। একই সঙ্গে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মোটা অঙ্কের বৃত্তি। মনে হচ্ছে এগুলো আগে থেকেই জোগাড় করে রেখেছিলেন। আপাকে যেহেতু তাঁর খুব পছন্দ, তাই রাজি করিয়েছেন একসঙ্গে যেতে। গোপনে বিয়ের পর্বটা সেরে ফেলেছেন আজ সকালেই। আপার ভয়, যদি বাবা-আম্মা এই বিয়েতে সম্মতি না দেয়, সকালের গাড়ির ধারাটা এবার স্পষ্ট হলো। পুরো ব্যাপারটা মনে হয় উল্কার মতো ঘটে গেলে। রীতা আপা নেই। রীতা আপা বিয়ে করেছেন। কদিনের মধ্যেই চলে যাবেন। অথচ এত ঢেকে রাখার কী প্রয়োজন ছিল। কী জানি বাবা।
আমি চললাম। খবরটা দিতে অনুরোধ করল অনেক করে, তাই দিয়ে গেলাম। বলতে বলতে রহীম চাচা উঠে দাঁড়ালেন। তবু দরজায় পা বাড়ানোর আগে আরেকবার একই রেকর্ডটা চালালেন, রীতা যে এমন করবে ভাবতেও পারিনি। ছি, ছি ইত্যাদি।
মিনু ঘরে বাতিটা জ্বালিয়ে দে তো। আমি আবার চা করে আনছি। এই বলে মা চলে গেলেন। মিনুর চোখে একটা বিষণ্ন মলিনতা। চোখ দুটো থেকে যেকোনো মুহূর্তে গড়িয়ে পড়তে পারে বাঁধভাঙা জোয়ার। যার মূল্য এখন অত্যন্ত সামান্য। নামাজের সময় পার হয়ে যাচ্ছে। বাবা চলে গেলেন। মিনুও গেল পিছু পিছু। বসার ঘরে আমি একা। যেন একটা নিস্তেজ পাথরের মূর্তি। দেয়াল বাড়িতে ঢং ঢং করে বেজে উঠল ঘণ্টা ছয়টার ঘোষণা।
একসময় অজান্তে আমিও এসে দাঁড়ালাম বারান্দায়। চোখ পড়ল কৃষ্ণচূড়াগাছটির দিকে। থোকা থোকা রক্তিম পলাশে এখনো লেগে আছে শেষ সূর্যের আভা, রীতাপার ভালোবাসার মতো। বাইরে আরও অন্ধকার নেমে আসছে। আর বসন্ত সুরের মতোই ভেসে আসছে সেই সুর, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো।’
ভুলে যেতে পারব না রীতা আপাকেও। আমার জীবনে একটা রোববার রক্তাক্ত হয়ে গেল। শহীদ মিনারের নিস্তব্ধ ভাস্কর্যের মতো।

আমিনুর রশিদ পিন্টু: কবি ও প্রাবন্ধিক।