প্রতিটি প্রাণ বাঁচুক অনাবিল আনন্দে

ইউএস–বাংলার এই উড়জাহাজটি ৭১ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকা থেকে ছেড়ে নেপালের কাঠমান্ডু বিমানবন্দরের কাছে দুর্ঘটনায় পড়ে
ইউএস–বাংলার এই উড়জাহাজটি ৭১ জন যাত্রী নিয়ে ঢাকা থেকে ছেড়ে নেপালের কাঠমান্ডু বিমানবন্দরের কাছে দুর্ঘটনায় পড়ে

সূর্যাস্তের সময়টা কেন জানি কখনো ভালো লাগে না আমার। বিষণ্নতা পেয়ে বসে। মনে হয় চারপাশের সব আলো নিভে যাচ্ছে। অন্ধকার যেন চোখে আঙুল দিয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বলে যাচ্ছে, সারা দিনের যত আলো দেখেছ তার সবই ছিল মরীচিকা। মনের দেয়ালে ঝোলানো স্মৃতিরা উজ্জ্বল হয়ে উঠে। ভাবনার দোল চেয়ারে দুলতে দুলতে অচেনা কষ্টে কাতর আমি মন খারাপ করে বসে আছি।
ফুল, পাখি, প্রকৃতি, আকাশের মায়াবতী চাঁদ কোনো কিছুই মনকে স্থির হতে দিচ্ছে না। জীবনের অর্থ খুঁজে পাই না। মনে হয় জীবনের এত আয়োজনের সবকিছুই বুঝি বৃথা! মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে কত প্রিয় আপন মুখ যা আজ জীবন থেকে নাই হয়ে গেছে। নিজের সঙ্গে নিজেই যখন জীবনের গাণিতিক হিসাব-নিকাশ নিয়ে ব্যস্ত, মন খারাপের গল্পে মশগুল ঠিক তখনই কানে ভেসে এল অ্যাম্বুলেন্সের শব্দ। সংবিৎ ফিরে দেখি, অ্যাম্বুলেন্স আমাদের পাশের বাড়ির সামনে এসেই দাঁড়িয়েছে।
প্রায় প্রতিদিন মায়ের বয়সী যে মানুষটা আমার হাতে বিস্কুট তুলে দেয়, যাঁর হাসিখুশি মুখ আমাকে আন্দোলিত করে তিনিই অসুস্থ! তাঁর দুটো কিডনিই অচল হয়ে পড়েছে। সপ্তাহে দুদিন ডায়ালাইসিস করতে হয়। প্রায়ই শ্বাসকষ্টে ভোগেন। তাঁকে দেখতে অ্যাম্বুলেন্সের দরজায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই উনি আমাকে বিদ্যুৎ গতিতে দু’হাতে জাপটে ধরেন। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো অবস্থায় আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন আর দোয়া চাইছেন যেন সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরতে পারেন। যেন যমদূতের সঙ্গে লড়াই করে উনি নিশ্বাস নিচ্ছেন। বেঁচে থাকার আকুতি আপাদমস্তক জুড়ে। তাঁর বেঁচে থাকার প্রাণপণ এই যুদ্ধের দিকে তাকিয়ে নিমেষেই মন ভালো হয়ে গেছে আমার। মনে হলো এই যে সুস্থভাবে নিশ্বাস নিতে পারছি, বেঁচে আছি—এটাইতো জীবনের পরম সুখকর উপহার!
সভ্যতার চেয়ে দুনিয়াতে ক্ষুধার বয়স বেশি। ডিসেম্বর মাসে প্রচণ্ড শীতের রাতে বৃষ্টির মধ্যে ষাটোর্ধ্ব নিঃসন্তান নারীকে যখন দেখি রেইনকোট পরে আর্বজনার ব্যাগ থেকে ময়লা সরিয়ে জুস বা সোডার ক্যান সংগ্রহ করে পরদিন সকালে সেগুলো বিক্রি করে খাবার কিনে খান আর বেঁচে থাকেন আনন্দ মনে নিয়ে তখন নীরব দৃষ্টিতে শ্রদ্ধাবনত মস্তকে তাঁর বেঁচে থাকার সংগ্রামের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে যায় আলবার্ট আইনস্টাইনের সেই কথাটি, ‘জীবনটা বাইসাইকেলের মতো, জীবনে ততক্ষণই ভারসাম্য থাকে যতক্ষণ চলতে থাকে।’
বয়োবৃদ্ধ সে নারীর মুখের প্রতিটি ভাঁজে স্পষ্ট দেখতে পাই বেঁচে থাকার, সুস্থভাবে নিশ্বাস নিতে পারার অপার তৃপ্তি। পৃথিবীতে যত না পাওয়া থাকুক, যত কষ্টই থাকুক বুকে, মালিন্যহীন হৃদয়ে বেঁচে থাকাটাই সুখ, আনন্দ।
ইউএস-বাংলা ফ্লাইটে নেপালে কেউ গিয়েছিলেন বেড়াতে, কেউ ঘুরতে, কেউবা মধুচন্দ্রিমায়। সবার বুকেই ছিল প্রিয় হাতটি আরও শক্ত করে হাতের মুঠোয় জড়িয়ে ধরে বেঁচে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, জীবনকে প্রিয়জনের সঙ্গে উপভোগ করার বাঁধভাঙা আনন্দ-উচ্ছ্বাস। সুন্দরের সান্নিধ্যে পাখির মতো উড়ে উড়ে যাপিত জীবনের অবসাদ, ক্লান্তি কাটিয়ে নতুন উদ্যমে আবারও ভালোবাসায় বেঁচে থাকার আশা।
নিয়তির কাছে সব মানুষ অসহায়। তাঁদের কেউ-ই জানত না এটিই ছিল জীবনের শেষ যাত্রা। মৃত্যু মানেই থেমে যাওয়া, চারদিকে ঘন অন্ধকার। সবাই অপেক্ষায় থাকে মৃত্যুর। যখন যার ডাক আসবে তাকেই চলে যেতে হবে জাগতিক সব হিসাব-নিকাশ ছেড়ে।
মানুষ তাঁর ভবিষ্যৎ জানে না। দুনিয়াতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকাটাই সুখ। প্রাণ থাকলেই স্পন্দন আছে। যে জীবনে স্পন্দন আছে সে জীবনে আকাঙ্ক্ষারা ডানা মেলে উড়তে পারে ভালোবাসার আকাশজুড়ে।
অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানকে ভালোবেসে যার জীবনে যতটুকু আছে তা নিয়ে বেঁচে থাকাতেই পূর্ণ সুখ, সন্তুষ্টি নিহিত। প্রতিটি প্রাণ বাঁচার মতো বেঁচে থাকুক অনাবিল আনন্দে।