ঢাকার জন্য এক নিউইয়র্কবাসীর শুভকামনা

ঢাকার সবচেয়ে ভয়াবহ দুটো ব্যাপার হলো—একটি যানজট, অন্যটি মশা। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে তোলা
ঢাকার সবচেয়ে ভয়াবহ দুটো ব্যাপার হলো—একটি যানজট, অন্যটি মশা। রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে তোলা

প্রত্যেক ধর্মানুসারীর একটি সহজ-সরল বিশ্বাস আছে। ইহজগৎ ছেড়ে যাওয়ার পর আরও একটি জীবনকাল তাদের অনন্তকাল ধরে কাটাতে হবে। বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের প্রত্যেক জীবিত প্রাণীকে নিতে হবে মৃত্যুর স্বাদ; তা যেমন অনিবার্য তেমনি আরও একটি প্রধান বিষয় হলো এই বিশাল জগতের যিনি একচ্ছত্র মালিক ও অধিপতি, সেই মালিকের দুনিয়ার হাতেই নির্ধারিত হবে পরের জীবনের সব ফয়সালা। যেখানে বিবেচিত হবে না গাত্রবর্ণ কিংবা বংশমর্যাদা অথবা কোনো দলীয় পদবি। সরকারদলীয় হোক বা বিরোধীদলীয় হোক, সৃষ্টিকর্তার সামনে দাঁড়িয়ে বিগত দিনের সব কর্মকাণ্ডের চুলচেরা হিসাব চুকিয়ে তবেই যেতে হবে স্বর্গে কিংবা নরকে।

এবার আমার বাংলাদেশ সফরের পর বারবার প্রশ্ন জাগছে মনে, সৃষ্টিকর্তার এই অমোঘ বিধানে কি কোনো ব্যতিক্রমের সুযোগ আছে? মনে হচ্ছে, থাকলে থাকতেও পারে। ধরাধামের প্রতিটি ধর্মে সব প্রতিপালককে বড়ই দয়ালু ও ক্ষমাশীল বলে নিজ নিজ পবিত্র গ্রন্থে উল্লেখ আছে। যা আমরা সবাই দৃঢ়চিত্তে বিশ্বাসও করি। সেই বাসনা ও বিশ্বাসকে ধারণ করে আমার মনে একটি চিত্রকল্পের সৃষ্টি হয়েছে, যার উৎস এবার আমার বাংলাদেশে ছুটিতে কয়েক দিন ঢাকায় কাটানোর অভিজ্ঞতা!
ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী। কোটি মানুষের বসবাস। দেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিকসহ সব গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের সূতিকাগার ঢাকা। সারা দেশের সার্বিক কর্মযজ্ঞের সব ভালো-মন্দ সিদ্ধান্ত এই ঢাকা শহরে বসে কর্তাব্যক্তিরা নেন। কিন্তু এই ঢাকা শহরকে দেখে মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে অস্বাস্থ্যকর শহর, নিয়ম না মানার শহর, কষ্টের শহর—যার যার নিজ নিজ খুশিমতো চলার শহর এই ঢাকা। সবচেয়ে ভয়াবহ হলো এর দুটো ব্যাপার—একটি যানজট, অন্যটি মশা।
ঢাকা শহর রাত-দিনের সিংহভাগ সময় বলতে গেলে স্থবিরই থাকে। পুরো শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা হলো আদিম যুগের মতো। যার যার ইচ্ছেমতো গাড়ি হাঁকিয়ে চলা। কোনো নিয়ম না মানা। পদবি আর ফ্ল্যাগের যথেচ্ছ ব্যবহার করে উল্টোপথে চলা। প্রতিনিয়ত নিয়ম ভাঙা। কিন্তু এর জন্য মোটেও লজ্জিত না হওয়া, এটাকেই খুব স্বাভাবিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা বেশ গর্বের বিষয় বলে মনে হওয়া! এগুলোই হচ্ছে ঢাকার ঢিঢিক্কার!
অসহায় ট্রাফিক ভাইয়েরা এক হাতে ছাতা অন্য হাতে লাঠিসদৃশ কিছু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তবে তাঁদের কথা কেউই শুনছে না অথবা কেয়ারও করছে না। বিশেষ করে ঢাকা শহরে চলাচলকারী বাসচালকদের দেখে মনে হলো, তাঁরা শুধু মানব অবয়ব নিয়েই চলাচল করছেন। তা ছাড়া অন্য কিছুই তাঁদের মাঝে নেই। ওরা বেপরোয়া, কোনো আইন মানে না, একেবারে তোয়াক্কাহীন। ন্যূনতম মানবিক বিষয় ওদের মধ্যে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তারা যেকোনো সময় রাস্তার পাশে বা রাস্তার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে যাবে, কেউ কিছু বলতে পারবেন না। পেছন থেকে হর্ন বাজিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে গেলে সাইড থেকে চাপা দেওয়ার ভঙ্গি করে ভয় দেখাবে। ‍সঙ্গে অশালীন ভাষায় গালাগাল। কেউ দেখার নেই। পুরো শহরের সব রাস্তা-সড়ক—সব ওদের দখলে। তাদের দখলে আরও কিছু স্থান আছে, যা এখানে বলা সহজ নয়।
পুরো রাজধানীর অধিকাংশ গলি-উপগলিসহ প্রধান সড়ক এবং সব গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা দিনরাত সারাক্ষণ জ্যাম নামক দৈতের অধীনে। এরই মধ্যে শহরের মূল সড়ক বিমানবন্দর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রায়শ বন্ধ হয়ে যায় ভিআইপিদের চলাচলের সময়। ভিআইপিদের নিরাপদে চলার অজুহাতে সারা রাস্তার দুপাশে শত শত কার, ট্যাক্সি, বাস এমনকি রোগীসহ অ্যাম্বুলেন্স ঘণ্টার পর ঘণ্টা পর দাঁড়িয়ে থাকে। সঙ্গে আছে হাজার হাজার রিকশা। অথচ মজার ব্যাপার হলো, কেউ কিছু বলছে না! দেখে মনে হলো, সবাই এই বলে মেনে নিয়ে নিয়েছে, ‘জ্যামেই যাদের দিন চলা/ তাদের আবার জ্যাম কী?’
ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট বঙ্গভবনে আসবেন। তাই আমাকে মহাখালী ডিওএইচএসের ক্রসিংয়ে এক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। এটা কোনো অবস্থায় কাম্য নয়। অতিথিদের সম্মান দেখাতে হবে এবং নিরাপত্তা দিতে হবে, তা যেমন সত্যি; পাশাপাশি ইঁদুরের ফাঁদে আটকে থাকা ঢাকাবাসীদের কথাও মনে রাখতে হবে।
মাত্র একজন বিদেশি অতিথির আনুষ্ঠানিকতার জন্য পুরো ঢাকা শহর অচল হয়ে গেল। অথচ নিউইয়র্ক নগরে প্রতি সেপ্টেম্বর মাসে শখানেক রাষ্ট্রনায়ক ও সরকারপ্রধান জাতিসংঘে ভাষণ দিতে আসেন। পুরো শহরের ৯৯% ভাগ লোক টেরই পান না কে এলেন আর কেই-বা গেলেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় যখন কোনো ভিআইপি আসেন তখন ছোট্ট স্কুলের শিশু থেকে অসুস্থ বয়োবৃদ্ধরা ভালো করে টের পান, কে এলেন আর কখন গেলেন। কতটুকু যন্ত্রণা দিয়ে গেলেন।
এবার আসুন মশার ব্যাপারে কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলি। মশাকে নিয়ে বসবাস আমার নিকট নতুন কিছু নয়। জীবনের বড়ই অংশই কেটেছে এই ক্ষুদ্র অথচ বিধ্বংসী প্রাণীটির সঙ্গে। রাজধানীতে এবারের মশার আক্রমণ নাকি সব সময়ের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। রাজধানীবাসীর অভিমত হলো, এই ব্যাপারে কারও যেমন মাথাব্যথা নেই, তেমনি নেই মশা নিধনের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ। বিশেষ করে দিনের শেষে রাজধানীর অভিজাত পাড়াসহ পুরো ঢাকা চলে যায় মশাদের দখলে।
সন্ধ্যা নামামাত্র ঝাঁকে ঝাঁকে মশা সদলবলে আক্রমণ করতে শুরু করে সর্বত্র। আবালবৃদ্ধবনিতাসহ সব স্তরের নাগরিক মশার কামড়ে অস্থির! শুধু লাভবান হচ্ছেন মশারি প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতা, মশার কয়েল উৎপাদনকারী ও বিক্রেতারা সমান তালে ভালো মুনাফা অর্জন করে চলছে। তবে আশার কথা, মাত্র কদিন হলো ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সীমিত পর্যায়ে মশক নিধন কার্যক্রম শুরু করেছেন।
ঢাকাবাসীর এসব অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট আর দুঃসহ যাতনা দেখে আমার বারবার কেন জানি মনে হচ্ছে, নিশ্চয় বিশ্ববিধাতা এই জাগতিক জীবনে এসব কষ্টের অবসান না ঘটালেও পরজনমে হয়তো-বা তাঁদের জন্য বিশেষ কিছু বিবেচনা করবেন।
আমার কল্পনা এই যে যখন পুরো মানবজাতি বিধাতার মুখোমুখি হবেন, তখন সবাই থাকবেন পেরেশান। ঢাকাবাসীও নিশ্চয়ই বাদ যাবেন না সেই পেরেশানি থেকে। তখন হয়তো দয়ালু বিধাতা সব ঢাকাবাসীকে নিশ্চিন্ত করে এমন এক সিদ্ধান্তে আসবেন, যা হবে ঢাকাবাসীর যুগ যুগ ধরে জীবনভর কষ্টের বিনিময়ে পাওয়া এক অনন্য উপহার!
সঠিক এক শুভ সময়ে সৃষ্টিকর্তা সহাস্যে পুরো ঢাকাবাসীর উদ্দেশে এক ঘোষণায় বলে দেবেন, ‘হে ঢাকাবাসী, মন দিয়ে শোনো! সারা জীবন নরকযন্ত্রণার চাইতেও বেশি কষ্টময় জীবন তোমরা ঢাকা শহরে বসবাস করে পার করেছ; আমি তোমাদের আর নরকে পাঠাতে পারি না! তাই আমি আদেশ করছি, তোমরা সকল ঢাকাবাসী হাসতে হাসতে পরম সুখের জায়গা স্বর্গে চলে যাও! হয়তো তখন দেখা যাবে সারা জীবন নরকসম কষ্টকর ঢাকা শহরে বসবাসকারী ঢাকাবাসী খুশিতে চিৎকার করে বলছেন, ‘প্রতিপালক তুমি দয়ালু, সত্যি তুমি দয়ালু। আমরা ঢাকাবাসী কৃতজ্ঞ থাকলাম বাকি অনন্ত জীবনের জন্য!’
পরম ত্রাতা-বিধাতার ওপর সব বিশ্বাস রেখে আমি এক পাপী এ স্বপ্ন নিশ্চয়ই দেখতে পারি! দায়িত্ব আর কর্তব্যবোধের তাড়নায় ভালোবাসার নিউইয়র্ক নগরে ফিরে এসেছি! তবু আমার প্রিয় মাতৃভূমির একসময়ের তিলোত্তমা রাজধানী নগরের সর্বাঙ্গে দগদগে ঘা আর দুর্গন্ধযুক্ত পচন দেখেছি, তারই বেদনা আর কষ্ট আমাকে না ছুঁয়ে যেতে পারে না। এই লেখা আমার ব্যক্তিগত সেই দুঃখবোধ ও কষ্ট থেকেই উৎসারিত। ঢাকাবাসী সবার জন্য তাই নিউইয়র্কবাসীর পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভকামনা রইল!