পামুকের সঙ্গে এক সন্ধ্যা

ওরহান পামুক
ওরহান পামুক

ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যার ঠিক সাতটা ছুঁতে না ছুঁতেই ঘোষিকা মাইক্রোফোনে লেখকের আগমন বার্তা জানিয়ে দিলেন। ততক্ষণে বার্নস অ্যান্ড নোবেলের পঞ্চম তলার সেমিনার কক্ষটি কানায় কানায় ভর্তি। ঠোঁটের এক কোণে আলতো হাসি ফুটিয়ে সহিত্যে নোবেল জয়ী লেখক ওরহান পামুক যখন মূল মিলনায়তনে এলেন তখন চারপাশে মুহুর্মুহু করতালির শব্দে কানে তালা লাগার মতো অবস্থা। বক্তৃতার শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিলেন তাঁর মিনিট দুই অনভিপ্রেত বিলম্বের জন্য। তারপর পড়তে শুরু করলেন তাঁর সদ্য প্রকাশিত বই ‘দা মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স’ এর বিভিন্ন অধ্যায় থেকে তাঁর নির্বাচিত অংশ বিশেষ। ৫৩২ পৃষ্ঠার এই বিশাল আয়তনের বই থেকে শুধুমাত্র বাছাই করা কিছু অংশগুলো পড়ে উপস্থিত দর্শদের পাতে পরিবেশন করা নিশ্চয়ই কোনো সহজ কাজ ছিল না। ওরহান পামুক ধীরে ধীরে কথা বলা শুরু করলেন। মনে হচ্ছিল তিনি যেন তাঁর বিশাল বইয়ের অলিগলির দুর্গম পথে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন। আমরা দর্শককুল তন্ময় হয়ে তাই শুনছিলাম।
‘দা মিউজিয়াম অব ইনোসেন্স’ মোট ৮৩টি অধ্যায়ের প্রায় সবকটা অধ্যায়ই তুরস্কের বিভিন্ন সুখ-দুঃখের গল্পে ঠাসা। অনেকেই মনে করেন এই অধ্যায়ের প্রতিটি ছোট ছোট গল্প সত্যিকার অর্থে খোদ লেখকেরই জীবন কাহিনি। লেখক তাঁর জীবনের এই গল্পগুলো বলেছেন কল্পনার রূপকথায় ভর করে, নিজের নামকে আড়াল করে ছদ্ম নাম নিয়ে অথবা কখনো কখনো প্রকাশ্যে খোলামেলা আলোচনায়। তাঁর জনপ্রিয় বই ‘ইস্তাম্বুল’-এর একটি অধ্যায়ের নাম “হুজুন”। ‘‘হুজুন’’ একটি তুর্কি শব্দ যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘মিষ্টি বিস্বাদ’। লেখকের ছেলেবেলায় দেখা ধূসর বসফরাস নদী, সেই নদী উপচানো দুপারের মানুষের স্বপ্ন, ছোট্ট শহর শিহাঙ্গির, ভাঙা পরিত্যক্ত জাহাজের মাস্তুল, প্রথম প্রেম, রাস্তার দুপাশে দরবেশদের আস্তানা—এর সবকিছুই এখন লেখকের কাছে মিষ্টি বিস্বাদে ভরা স্মৃতি (হুজুন) ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু তুরস্ক এখন বদলে গেছে। দরবেশ আস্তানায় হোটেল হিলটনের সাইনবোর্ড ঝুলছে, বসফরাসের দুই কোলের মানুষের চোখে এখন শুধু পশ্চিমা ঝলমলে জীবনের আকুল হাতছানি! লেখকের সদ্য প্রসূত এই পুস্তকেও দেখি ঠিক তারই যেন হুবহু অনুরণন। প্রতিটি অধ্যায়ে স্থান পেয়েছে সেই স্মৃতি থেকে নেওয়া ৮৩টি ছোট গল্প যা লেখক গল্পের ছলেই পাঠকের পাতে তুলে দিতে চেষ্টা করেছেন।
পামুক সন্ধ্যার শেষ প্রান্তে এসে উপস্থিত দর্শকের সঙ্গে লেখক ওরহান পামুকের প্রশ্ন-উত্তর পর্বটি ছিল গোটা অনুষ্ঠানটির প্রাণ। তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার এক ফাঁকে বলে দিলাম বাঙালির আত্মায়ও তিনি সমান জনপ্রিয় এক লেখক। কথাটা শুনে তিনি যেন বিশ্বাস করতে চান না। বাংলা ভাষাভাষী অনেক আমার পাঠক আছে? আমাকে চেনে? বিনয় কাকে বলে? বললাম ‘গোটা দুনিয়ার মানুষ যদি আপনাকে চেনে তাহলে বাংলাদেশ চিনবে না কেন? তারপরই আসল কথায় আসি। ‘আপনার গ্রন্থগুলি আমার মোটামুটি সবই পড়া। এদিকে আপনাকে নিয়ে এবং আপনার গ্রন্থ নিয়ে আমার অনেক কথা জমে হয়ে আছে। আপনার সঙ্গে কথা বলার কোনো সুযোগ পাওয়া যাবে কী? ভেবেছিলাম বিষয়টা যত কঠিন কিন্তু পরে দেখা গেল আসলে তা নয়। তিনি কাজটি আরও সহজ করে দিলেন। শুধু বললেন প্রশ্নগুলো যদি তাঁকে আগেই পাঠিয়ে দিই তাহলে আমাদের সময় অনেকটাই বেঁচে যাবে। আমি আর সময় নষ্ট না করে তার ইমেইল বার্তায় ত্বরিত কিছু প্রশ্ন পাঠিয়ে দিলাম এবং কিছুদিন পরই ফিরতি মেলে তাঁর উত্তরও পেলাম। পামুকের সঙ্গে সেদিনের আমার কথোপকথনটি হুবহু তুলে ধরলাম।
প্রশ্ন: আপনার জনপ্রিয় বই ‘ইস্তাম্বুল’-এর “হুজুন” অধ্যায়ে আপনার ছেলেবেলার অনেক স্মৃতি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। ধরা যাক যদি সুযোগ পান আপনি কি আপনার সেই সোনালি অতীতে আবার ফিরে যাবেন?
পামুক: ছেলেবেলার স্মৃতি সব সময়ই আনন্দের, ভালো লাগার। সেই স্মৃতি আছে বলেই আমি সেখানে বারবার যেতে পারি সেখান থেকে কিছু ভালো লাগার গল্প নিয়ে এই বর্তমানে ফিরে আসতে পারি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি যদি সুযোগ পাই তাহলে আবার সেই ছেলেবেলায় ফিরে যাব। না, আমি বরং বর্তমানকে নিয়েই থাকতে চাই, বাঁচতে চাই। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো যে প্রতিটি সময়েরই আলাদা একটা আনন্দ আছে, গুরুত্ব আছে। আমি বর্তমান এই সময়টাকে যথেষ্ট সুন্দরভাবে উপভোগ করছি।
প্রশ্ন: আপনার লেখার জন্য সময় কি আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে? অর্থাৎ বলতে চাইছি আপনি কি লেখার ক্ষেত্রে আগে থেকেই কি আট-ঘাট বেঁধে নামেন?
পামুক: লেখার জন্য আলাদা একটা সময় তৈরি করতে হয় বৈকি? তবে আট-ঘাট বেঁধে অনেক চেষ্টা করেও কখনো কখনো লেখা সম্ভব হয় না যদি না সেখানে লেখার ক্ষেত্র, পরিবেশ এবং মানসিক প্রস্তুতি থাকে।
প্রশ্ন: আপনার লেখার চরিত্রগুলো কি আগের থেকেই নির্ধারিত নাকি লেখার সময় হঠাৎ করেই আপনার উপন্যাসের চরিত্রগুলো ফুটে ওঠে এবং নতুন কোনো চরিত্র ধীরে ধীরে জেগে ওঠে?
পামুক: দুটোই। সাধারণত যা হয়, লেখার জন্য একটা প্রস্তুতিতো থাকতে হবেই। বিশেষ করে কোনো চরিত্রকে সেখানে ফুটিয়ে তুলতে হলে। তবে এটাও ঠিক যে অনেক সময়ই পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়া যায় না। চরিত্রটি হয়তো ভিন্নমাত্রা পায়, নতুন করে আমার সামনে ধরা দেয়।
প্রশ্ন: আপনি বর্তমান সময়ে কি লিখছেন? তুরস্কের ঘটনার বাইরে আপনি অন্য কোনো লেখায় কি হাত দিয়েছেন?
পামুক: ভালো কথা। আপনারা হয়তো জানেন যে, আমি বর্তমানে নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াই। আমার এক ছাত্র ঠিক এ রকমই একটা প্রশ্ন করেছিলেন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জীবন, এখানকার ঘটনা প্রবাহ, নিউইয়র্ক এই সবকিছু মিলিয়ে আমি ভবিষ্যতে কোনো বই লিখব কিনা? আমি তাদের কে বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলাম যে ‘না’। আমি যে জীবনের গভীরে এখনো যেতে পারেনি, দেখিনি এবং সবচেয়ে বড় কথা আমাকে যা আকর্ষণ করেনি সেই বিষয় নিয়ে আমার পক্ষে লেখা কঠিন।
প্রশ্ন: সুফিবাদের ওপর কিছু বলবেন কি?
পামুক: আমার বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই রুমি পড়তেন। রুমির ওপর পাঠ চলতো এবং ইসলামের আধ্যাত্মবাদ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলতো। কিন্তু তারপরও এ সবই ছিল এক ধরনের উদারপন্থী ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা ছাড়া আর কিছুই না। তবে তুরস্কের রক্ষণশীল অন্ধ ধর্মীয় মুখোশের বাইরে এই উদারচেতা সুফিবাদ আমাকে অবশ্যই অনেক বেশি আকর্ষণ করেছে। আমি এখনো মনে করি যেকোনো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান ছাড়া কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত হওয়া মোটেও নিরাপদ নয়।
প্রশ্ন: ইউরোপে আপনার ওপর যথেষ্ট লেখালেখি হয়েছে এবং হচ্ছে? কেউ কেউ বলছেন যে তুরস্কে আপনিই একমাত্র ইউরোপমুখী একজন লেখক। এই বিষয়ে আপনার অবস্থান কোথায়? জানতে পারি?
পামুক: আপনি তুরস্কের জনগণের সঙ্গে আলাপ করে দেখবেন যে এদের বেশির ভাগ মানুষই তুরস্ককে ইউরোপীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে দেখতে চান। এখন বিষয়টা হলো অর্থনীতি। মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর পরিবর্তন হয়েছে এবং শুধু ইউরোপ না গোটা দুনিয়াই এখন পশ্চিমের দিকে তাকাতে চেষ্টা করছে। আমি আমার আগের বই ইস্তাম্বুলে পরিষ্কার করে আমাদের তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের সেই গৌরব গাঁথা তুলে আনার চেষ্টা করেছি এবং পাশাপাশি বলতে চেয়েছি যে সেই সময়ে তুরস্ক জনগণ কীভাবে পশ্চিমের সভ্যতার দিকে ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকানোর চেষ্টা করছিল। আমি তুরস্কের উচ্চবিত্ত এক পরিবারের সন্তান। আমাকে বলা হতো ‘অ্যাপার্টমেন্ট বয়’। কিন্তু সে জন্য আমিই একমাত্র তুরস্কের ইউরোপমুখী লেখক সে কথা আমি মানতে রাজি নই।