গাড়িতে শয়তান, দুর্গন্ধে দম আটকে যায়!

নিউইয়র্কে সাংবাদিকতা জীবনের প্রায় ত্রিশ বছর। এ সময়ে ঘটেছে অনেক ঘটনা। বিচিত্র অভিজ্ঞতা। অনেক স্মৃতি। কোনোটা ভুলে গেছি, কোনোটা ভুলিনি। যা ভুলিনি তার দু-চারটে শেয়ার করতে চাই। কারও নাম মনে আছে, কারও নেই।
এক যুবক। শ্মশ্রুমণ্ডিত, ধর্মানুরাগী। পত্রিকা ডেলিভারি দিতেন। স্টোরে স্টোরে পৌঁছে দেওয়া, বিক্রি পত্রিকার পয়সা সংগ্রহ ও অবিক্রীতগুলো ফেরত এনে ডাম্প করতেন। খুব সময়নিষ্ঠ। কিন্তু প্রতি সপ্তাহেই তাঁর অভিযোগ থাকত। কী অভিযোগ? তাঁর গাড়ি দুর্গন্ধে ভরে গেছে। দুর্গন্ধ? পত্রিকা তো কাগজ, পচনশীল কিছু নয়। দুর্গন্ধ হলো কী করে? বলতেন, পত্রিকাগুলো ডাম্প না করা পর্যন্ত তাঁর স্বস্তি নেই। এরপর স্প্রে করে হাওয়া-বাতাস খাইয়ে গাড়িকে শুদ্ধ করতেন। এই অভিযোগ চলল কয়েক সপ্তাহ। একদিন এসে বললেন, আর পারি না। শয়তানে আমার গাড়ি ভরে গেছে। আমার দম আটকে যায়। প্লিজ, আমার অনুরোধ, এসব বন্ধ করুন। কী বন্ধ করব? পত্রিকার সিনেমার পাতা। মধ্যের দুই পাতা রঙিন হয়ে বের হতো সিনেমার খবর নিয়ে। তাঁর আপত্তি এ রঙিন ছবি নিয়ে। এগুলো তার গাড়িতে থাকলে শয়তান এসে ভর করে, দুর্গন্ধ হয়ে যায় গাড়ি। এ দুর্গন্ধ তার আর সইছে না।
অবশ্য তাঁকে আর সইতে হয়নি। কারণ, পত্রিকা ডেলিভারির কাজকে তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন। জানি না, এখন তিনি কোথায়, কী অবস্থায় আছেন।
আরেক পত্রিকা। অফিসে মালিক বসতেন না। বসতেন তাঁর এক প্রতিনিধি। এই প্রতিনিধি একদিন হুকুম জারি করলেন, পত্রিকায় অনেক ভুল থেকে যায়। প্রেসে যাওয়ার আগে পাতাগুলো যেন তাঁকে দেখিয়ে নেওয়া হয়। যেমন আদেশ তেমন কাজ। পাতাগুলো রেডি করে তাঁর টেবিলে রাখা হতো। তিনি দেখে দিতেন। অপ্রয়োজনে কলমের খোঁচা এখানে–সেখানে দিতেন। একদিন তাঁর দেখা এক পাতায় আমার চোখ আটকে গেল। কী ভয়াবহ কাণ্ড। একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল কথাসাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীর ওপর। মালিকের প্রতিনিধি প্রমথ চৌধুরীর ‘প্রমথ’ কেটে লিখলেন ‘প্রথম’। আমি অবশ্য তাঁকে কিছু না বলে তাঁর কাটাকে কেটে দিলাম।
আরেক পত্রিকা। আমার সহকর্মী এক কম্পোজিটর। নতুন এসেছেন দেশ থেকে। কাজে খুব আন্তরিক। পরিশ্রমী। ওই পত্রিকায় আমি প্রুফ রিডিংয়ের কাজও করতাম। খেলাধুলার একটি সংবাদ ছিল মাইকেল জর্ডানকে নিয়ে। মাইকেল জর্ডান বাস্কেটবলের সুপারস্টার। জগদ্বিখ্যাত। আমার সহকর্মী জর্ডানকে কম্পোজ করলেন ‘মডার্ণ’। আমি কেটে দিয়ে করলাম জর্ডান। দ্বিতীয়বারও একই ভুল। আমার সন্দেহ হলো, দেখি তৃতীয় দফায়ও ‘মডার্ণ’ রয়ে গেছে। জর্ডান হয়নি। আমি খানিকটা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করলাম। শুনলাম, আমার সেই কম্পোজিটর ভাইটি পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদকের কাছে গিয়ে বলছে, বুঝি না আপনারা কেন বলেন, মাহবুব ভাই ভালো প্রুফ দেখেন। তিনি সেরা। একটি সামান্য বানান বারবার তিনি ভুল করছেন। আমি শুদ্ধ করে দিলেও তিনি কেটে দিচ্ছেন। এই দেখুন, তিনি বারবার ‘মডার্ণ’ কেটে দিয়ে জর্ডান লিখছেন। ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হেসে তাঁকে বললেন, আপনি হেরে গেছেন। এটা জর্ডানই হবে। আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কম্পোজিটর ভাইটি নীরব হয়ে গেলেন।
দেশে পেশায় ছিলেন তিনি প্রকৌশলী। নিউইয়র্কে এসে এক পত্রিকায় কম্পোজের পার্টটাইম কাজ নিলেন। সরল সাধারণ জীবন তাঁর। নামাজ কাজা করেন না। মিথ্যা বলেন না। ভদ্র অমায়িক ব্যবহার। একদিন অফিসে ফোন বেজে উঠল। তিনি ফোন ধরলেন। সম্ভবত অপর প্রান্ত থেকে কেউ মালিককে চাইছিল। মালিক ইশারা দিয়ে তাঁকে বলছেন, আপনি বলুন, মালিক অফিসে নেই। কিন্তু প্রকৌশলী ভদ্রলোক তো মিথ্য বলতে পারেন না। তাঁর মুখমণ্ডল লাল হয়ে গেল। তাঁর সামনে জলজ্যান্ত মালিক বসে আছেন, আর তাঁকে নাকি বলতে হবে তিনি নেই। এত বড় মিথ্যা? এ কি সম্ভব? না, সম্ভব নয়। আবার মালিকের ইশারাও ফেলতে পারছেন না। ফোনে তিনি বললেন, এ বিষয়টি আমি বলতে পারব না। আমার এক সহকর্মীকে ফোন দিচ্ছি, তিনি বলবেন। এই বলে ফোনটি পাশে বসা আরেকজনকে দিয়ে তিনি স্থান ত্যাগ করলেন।
প্রকৌশলী ভদ্রলোকের লিগ্যাল স্ট্যাটাস ছিল না। বন্ধুদের অনুরোধে তাঁর নামে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন ফাইল করা হলো। যথারীতি সব নিয়ম সম্পন্ন হওয়ার পর তাঁর কেসটি উঠল ইমিগ্রেশন জাজের কাছে। পরে শুনেছি, শুনানির দিন তিনি জাজকে বলছেন, এই আবেদনে আমার সম্পর্কে যা বলা হয়েছে সবই মিথ্যা। কেসটা নাকি এভাবে সাজাতে হয়, তাই সাজানো হয়েছে। এ বিবরণ সত্য নয়।
অনুমান করুন, এই অবস্থায় জাজ কী আদেশ করতে পারেন।
পরে শুনেছি, প্রকৌশলী ভদ্রলোক কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন।

লেখক: নিউইয়র্কপ্রবাসী সাংবাদিক