বাংলাদেশ, তুমি ভালো আছো?

বাংলাদেশ থেকে মোট কতসংখ্যক মানুষ নতুন জীবনের সন্ধানে ‘প্রবাসী’ নাম ধারণ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জীবন যাপন করছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান আমার জানা নেই। তবে একজন প্রবাসী হিসেবে আমার জানা আছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রত্যেক প্রবাসীর ছোট্ট বুকে সারাক্ষণ পতপত করে উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা। বাংলাদেশকে বুকে ধারণ করে এই প্রবাসীরা প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠেন, আবার এই দেশটাকে পরম ভালোবাসায় বুকে স্থান দিয়ে তাঁরা আবার ঘুমাতে যান। বাংলাদেশের মানুষের মতোই আমাদের এই প্রবাসীদের জীবনেরও শ্রেষ্ঠ সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’।
২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবসকে ঘিরে আমাদের নিউইয়র্কের চারপাশে শুরু হয়েছে স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপনের ওপর নানা রকম বর্ণাঢ্য আয়োজন। দেখতে পাই শহরের অলিতে-গলিতে আমেরিকার পতাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকাও পতপত করে উড়ে বেড়াচ্ছে। এই দৃশ্য দেখলে বুকটা আনন্দে ভরে ওঠে। দেখতে পাই নিউইয়র্কের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দল, সংগঠনগুলো স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে রং-বেরঙের অনুষ্ঠান নিয়ে তৎপর হয়ে আছে। বেশ জানি আমাদের পত্রপত্রিকার বিশেষ পাতায় স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হবে, কবিকুল তাঁদের কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কবিতা পড়বেন, বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন সেমিনারে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের গুরুগম্ভীর ভাষণ দেবেন। এসব কিছুকেই ধারণ করে আমার প্রিয় বাংলাদেশ নীরবে তার পথ হাঁটছে দীর্ঘ ৪৭ বছর ধরে। কেমন আছ বাংলাদেশ?
স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৭ বছর পর বাংলাদেশ অনেক দূর পথ হেঁটে এসেছে। সেই পথ যে মসৃণ ছিল, তা বলা যাবে না। সেই আঁকাবাঁকা দুর্গম পথ হেঁটে হেঁটে বাংলাদেশকে আজকের এই অবস্থানে আসতে হয়েছে এবং সে জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। দেখা যায়, সাফল্যের ঝুলিতে বাংলাদেশের অনেক বড় বড় অর্জনও যোগ হয়েছে। কিন্তু সেই সাফল্যের পাশাপাশি আমরা সুদূর নিউইয়র্ক থেকে যখন পত্রিকার পাতায় দেখি হত্যা, গুম, জমি দখল, ধর্ষণ, সংখ্যালঘুদের জমি দখল ইত্যাদি ঘটনা বাংলাদেশেই বেড়েই চলছে, তখন আমদের প্রবাসীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। বাংলাদেশের যেকোনো খারাপ খবর শুনে আমরা দূর থেকে উৎকণ্ঠার সময় কাটাই। আমরা যখন জানতে পারি দেশে আইনের শাসন উপেক্ষিত, দেশের নাগরিক বলুন আর প্রবাসী বলুন, তাদের সবার জানমালের কোনো নিরাপত্তা নেই, তখন আমাদের ভাবনার দীর্ঘশ্বাস বাড়তে থাকে। সেদিন নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইট্‌সে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্কের (বেন) সভা হলো। সেখানে ‘বাংলাদেশের পরিবেশ ও পরিবেশ আন্দোলনের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি’ শীর্ষক আলোচনায় বাংলাদেশের পরিবেশ আন্দোলনের নেতা শরীফ জামিল অসাধারণ বক্তৃতা করলেন। তিনি যখন বক্তব্যে রাখছিলেন তখন গোটা বাংলাদেশের পরিবেশের ওপর একটি ভয়াবহ ছবি যেন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। দেশের নদী-নালা, খাল-বিল উপযুক্ত বিচক্ষণ চিন্তা-ভাবনার অভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, নদীর বুকে পানি নেই। তার পরিবর্তে সেখানে কিছু ব্যবসায়ী নামধারীরা রাজনৈতিক যোগসাজশে নানা কলকারখানা বানাতে মহাব্যস্ত। ভয়াবহ খবর হলো, সবকিছুই হচ্ছে সরকারের মন্ত্রী-আমলাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায়। আলোচনার একপর্যায়ে শরীফ জামিল বলেন, ‘বাংলাদেশ এখনো আন্তর্জাতিক নদী আইনে স্বাক্ষর করেনি। এভাবে যদি চলতে থাকে আগামী ৩০ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ নদীশূন্য হয়ে যাবে।’
আগেই বলেছি, আমরা যারা দূর পরবাসে আছি, এই বাংলাদেশ নিয়ে এই ভয়াবহ খবরগুলো আমাদের দারুণভাবে ভাবায়, বিচলিত করে এবং এর উত্তরণের পথ কী হতে পারে, সেদিকে তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকি। আমার মতো অনেক প্রবাসীই চান তিনি দেশে চলে যাবেন। প্রবাস জীবন আর কত? কিন্তু বিষয়টা ভাবা যতটুকু সহজ বাস্তবে তা রূপ দেওয়া কী তত সোজা? কিন্তু কেন এত কঠিন? কেন আমি আমার অর্জিত মেধাকে পুঁজি করে বাংলাদেশে জীবনযাপন করতে পারব না? এসব শুনে আমার এক বন্ধু ফিক করে হেসে দিলেন। তিনি তিন তিনবার বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে থাকার চেষ্টা করে কৃতিত্বের সঙ্গে ব্যর্থ হয়ে এখন আবার সেই নিউইয়র্কেই বসবাস করছেন। তাঁর ভাষায়, ‘ওই রাস্তায় হাঁটার চিন্তা কইরেন না। কারণ? প্রধান কারণ একটাই। নিরাপত্তার অভাব। কবে কখন আপনি গুম হবেন জানেন না। কবে কখন খুন হবেন তাও জানেন না। এ নিয়ে সরকারেরও তেমন কোনো মাথা ব্যথা নাই। সরকার কোনো নিরাপত্তাও দিতে পারবে না। দেশে আইন কাগজে-কলমে আছে বটে তবে এর প্রায়োগিক দিক নেই বললেই চলে। তবে যদি মন্ত্রী-এমপি বা পুলিশের বড় কর্মকর্তার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকে তাহলে ভিন্ন কথা।’ আমি ওই বন্ধুর কথায় আরও ভীত হয়ে পড়ি এবং কল্পনায় ভিন্ন আরেক বাংলাদেশকে দেখতে পাই।
১৯৭১ সালের কোনো এক রাত। মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দল কোনো এক অভিযানে যাচ্ছে। যাত্রাপথে একটি বাড়িতে এক রাত তাদের আশ্রয় নিতে হলো। বাড়িতে আছেন একজন বৃদ্ধ মা আর তাঁর একমাত্র মেয়ে। হতদরিদ্র এই মহিলা তাঁর বাড়িতে এক ঝাঁক মুক্তি সেনার উপস্থিতি দেখে চোখে আনন্দাশ্রু ধরে রাখতে পারেননি। কিন্তু মাথায় একটাই চিন্তা। এত রাতে ছেলেপেলেদের খেতে দেবেন কী? তখন তার মনে হলো বাড়িতে দুটো মুরগি আছে। তাই দিয়েই এই সোনার ছেলেদের খানাপিনার একটা ব্যবস্থার চিন্তা করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই পাশে বসে থাকা মেয়েটাকে বললেন, ‘মুরগি দুটো এখনই জবাই করার ব্যবস্থা কর। আমরা ছেলেদের জন্য রান্না করব।’ মায়ের কথা শুনেতো মেয়ের চোখে বিস্ময়ের চিহ্ন! মেয়ে বলল, ‘মা, তুমি বলছ কী? এই দুটো মুরগির ডিম বিক্রি করে আমাদের গরিবের সংসার চলে। আর তুমি কিনা এদের জবাই করার কথা বলছ? এদের জবাই করলে আমরা খাব কী?’ মেয়ের কথা শুনে বৃদ্ধারর গলায় আগুনের ঝংকার। মেয়েকে বললেন, ‘ওরে বোকা, আমাদের জীবন বড় নাকি এই মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বড়! আমাদের এই মুক্তিসেনারা তাদের জীবনবাজি রেখে দেশের জন্য কত বড় কাজ করতে যাচ্ছে, আর তুই কিনা ভাবছিস আমাদের কথা?’
নাহ, এটি কোনো গল্প নয়। মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ের একটা সত্য ঘটনা এটি। নিউইয়র্কে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে ঘটনাটি বলেছিলেন লেখক হাসান ফেরদৌস। হতদরিদ্র এই মায়ের মতো হয়তো হাজার নাম না-জানা মুক্তিযোদ্ধারা হারিয়ে গেছেন ইতিহাসের পাতা থেকে। কিন্তু তাঁদের ভালোবাসায় মোড়ানো বাংলাদেশটি অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছিলাম। স্বাধীনতা দিবসের ৪৭তম বছরে খুব ব্যাকুল হয়ে জানতে ইচ্ছে করে, বাংলাদেশ তুমি সত্যি ভালো আছো তো?