আজও তোমার মাঝে দেখি বুকভরা ভালোবাসা

স্ট্যাচু অব লিবার্টি
স্ট্যাচু অব লিবার্টি

অভিবাসন শুরুর সময় নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন, প্রায় ২৫ হাজার বছর আগে আমেরিকা মহাদেশের আলাস্কাতে পাওয়া পদচিহ্নে অভিবাসনের শুরুর শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়। কেউ বলেন, সান নদীর তীরে পাওয়া সূর্যোদয়ের বালিকা নামে খ্যাত এক বালিকার মাথার খুলির হিসাবে অভিবাসনের সূচনার হিসাব ধরা হয় সাড়ে ১১ হাজার বছর আগে।

অভিবাসনের এই তাত্ত্বিক হিসাব-নিকাশ করার মূল কারণ কিন্তু ইতিহাসচর্চা নয়। সেই শুরু থেকে আজ অবধি চলে আসা অভিবাসন ও আদিবাসীদের জিজ্ঞাসা আর কৌতূহলের যে কী পরিমাণ মিল আছে, তা সত্যি অবিশ্বাস্য ও চমকপ্রদ বটে।
এবার দেশ থেকে নিউইয়র্কে ফেরার পথে দুবাইয়ে দেখা হলো বাংলাদেশের তিনজন বয়স্ক অভিবাসীর সঙ্গে। তিনজনেরই বয়স সত্তরের কাছাকাছি। দুজন স্বামী-স্ত্রী। অন্যজন তাঁদের মেয়ের শাশুড়ি। মেয়ের আবেদনে যখন আমেরিকা যাওয়ার ভিসা পেলেন, তার কিছুদিনের মধ্যে ছেলের আবেদনে ভিসা পেয়ে গেলেন তাঁদের বেয়াইন। অর্থাৎ মেয়ের শাশুড়ি।
মেয়ে নিজের পিতা-মাতার সঙ্গে শাশুড়িকেও আমেরিকায় আনার ব্যবস্থা করলেন। তাই বেয়াইনকে নিয়ে এক বর্ষীয়ান দম্পতির শুরু হলো স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় অভিবাসী হিসেবে প্রারম্ভিক যাত্রা। খুবই সাদাসিধে চালচলনের এই বয়োজ্যেষ্ঠ দম্পতি। সংগত কারণেই হুইলচেয়ারধারী। ঢাকায় এর পুরো সুবিধা নিতে পারলেও দুবাইয়ে এসে একটু দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লেন বলে মনে হলো। সময়মতো তা ম্যানেজ করে কর্তৃপক্ষ যে জায়গায় হুইলচেয়ার সুবিধাপ্রাপ্তদের জড়ো করে, সেখানে পৌঁছেও গেলেন। বসলেন আমাদের লাগোয়া চেয়ার তিনটিতে। খেয়াল করে দেখলাম নিচু স্বরে নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করছেন তাঁরা। তাকাতেই মনে হলো আমাকে কী যেন বলতে চান। এগোতেই মুরব্বি দাঁড়িয়ে গেলেন। হাতে ধরা অনেকগুলো এক ডলারের নোট। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিছু বলবেন?’ উত্তরে আস্তে করে বলছেন, ‘খিদে পেয়েছে, কিছু খেতে চাই।’ সামনের একটি কফি কাম পেস্ট্রি শপ দেখিয়ে বললেন, ‘ওখানে তাকের ওপর রাখা কেকগুলো কি হালাল? বা কত দাম তা–ও জানি না। ভাবছি আপনাকে বলব সাহায্য করতে।’ শুনে বললাম, কোনো অসুবিধা নেই, আসুন জিজ্ঞেস করে দেখি ওরা কী বলে।
পেস্ট্রির দোকানের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মনে হলো হাজার হাজার বছর ধরে অভিবাসীদের পৃথিবীজুড়ে ছুটে চলার চিত্র বুঝি এমনই ছিল। শত প্রতিকূলতাকে জয় করেই চলছে এক দেশ থেকে অন্য দেশে কিংবা এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে অভিবাসীদের নিরন্তর পথচলা। তা কখনো পালবাহী নৌকায়, নয়তো বাষ্পীয় শক্তিতে চলা স্টিমারে চলেছে। হাজার মাইল পেরোতে যেখানে লেগেছে বছরের পর বছর, আজ সেই পথ পেরোতে লাগছে হাতে গোনা মাত্র দু–তিন দিন।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলি। ১৯৮৮ সালে প্রায় ৩০ বছর পূর্বে আমার পিতা–মাতা দুজন আমেরিকায় আসেন অভিবাসী হিসেবে। মাত্র পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সের আমার মা-বাবা দুজনেই ছিলেন চিন্তাগ্রস্ত ও ভীত। কেননা, তাঁরা জেনেছিলেন আমেরিকা অনেক অনেক দূরের পথ। বিমানে এলেও সপ্তাহখানেক লেগে যাবে। অথচ আজ দেশ থেকে ভালোবাসার নিউইয়র্ক শহরে ফেরার সময় তিনজন সত্তরোর্ধ্ব অভিবাসীকে খুবই স্বাভাবিকভাবে নিশ্চিন্তে ভ্রমণ করতে দেখে মনে হলো বিজ্ঞান আমাদের ছোট্ট কুটিরের আঙিনায় বুঝি অনেক সাহস আর উদ্যমকে জড়ো করতে সক্ষম। যার অনেক বিষয় আপন মনে সদাই খেলা করে যাচ্ছে যত্রতত্র।
তবে সব স্বাভাবিকের মধ্যেও কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল। যার একটি হলো খাবার ও পানীয় গ্রহণের শুরুতে হালালের নিশ্চয়তা জেনে নেওয়া। তাই হয়তো আমাকে নিজ দেশের একজন ভেবে সবকিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলেন। যা আমার কাছে ছিল মেঘ না চাইতে বৃষ্টি। আমিও মনে মনে চাইছিলাম তাঁদের সঙ্গে গল্প জুড়ে জেনে নেব পড়ন্ত বয়সে সুদূর আমেরিকা ভ্রমণের অনুভূতি বা কারণ। সেটাই ঘটে গেল। অত্যন্ত ধীরস্থির প্রচুর অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এক সংগ্রামী অভিভাবকের কাছ থেকে জানলাম বাংলার এক স্নেহবৎসল বাবার কাহিনি।
গ্রামের আবহ নিয়ে গড়ে ওঠা ছোট্ট মফস্বল শহরে চার চারটি সন্তান নিয়ে গড়ে তোলেন সুখের সংসার। শহরের পাশে নিজ গ্রামের কয়েক গন্ডা ফসলি জমির সামান্য আয় দিয়েই সংসার চলত। জীবনে সৎভাবে আয়–রোজগারের নানা পথে হেঁটে আর্থিকভাবে বেশি লাভবান হননি। তবে মূল্যবোধের যুদ্ধে বরাবর জয়ী হয়েছেন। সংসার চালানোর গল্প বলার সময় অনেক সময় কণ্ঠ ভারী হয়েছে পরিবারের অনেক আবদার না মেটানোর স্মৃতিচারণায়। তবে সেই কণ্ঠে আবার ফিরে এসেছে সফল সন্তানদের এক পিতার গর্বিত সুখস্বর।
বারবার তাকাচ্ছিলাম চিরায়ত শ্যামল বাংলার একজন বয়স্ক অভিভাবকের দিকে। যিনি বিনা সংকোচে সাতপাঁচ না ভেবেই একজন অপরিচিত সহযাত্রীর কাছে বলে যাচ্ছেন তাঁরই জীবনসংগ্রামের নানা সুখের অধ্যায়। যতই শুনছি ততই অবাক হচ্ছি। কতই না ত্যাগ–তিতিক্ষায় নিজেই গড়ে তুলেছেন একটি সুখী পরিবার। মাত্র একটি সহজ দর্শনকে আরও সহজতর করে নিজের জীবনকে পরিচালিত করলেন অত্যন্ত সহজভাবে।
সর্বশেষ শুধু এই বলেই আল্লাহর কাছে শোকর গুজার করলেন, এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন একজন শিক্ষিত প্রবাসীর সঙ্গে, যে তিলে তিলে অনেক পরিশ্রম করে গড়ে তুলেছে সুন্দর একটি সংসার। ধীরে ধীরে সন্তানদের ভালো স্কুল-কলেজে রেখে পড়াশোনা করাচ্ছে। সন্তানের এ সফলতার খবর শুনে মনে মনে ভাবতেন, যদি দেখে আসতে পারতেন, কেমন আছে তারা!
আজ সুদূর আমেরিকায় যাওয়ার দীর্ঘ এ ভ্রমণের মাঝপথে আমার দুটো হাত চেপে ধরে অশ্রুসিক্ত চোখে শুধু এতটুকুই বলতে পারলেন, আমার মেয়েটি আমার মনের খবর জানতে পেরেই বুঝি আমাকে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করল। শুধু কি তাই, আমার সৎ ও বিবেচক সন্তান, ওর মা-বাবার সঙ্গে তার বিধবা শাশুড়িকেও নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করল। তাই আজ বারবার আমার মনে হচ্ছে আমার সৎপথে উপার্জনের প্রতিটি পয়সা বুঝি আমারই সামনে সততা ও বিবেচনার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পাশেই বসা তিনজন বয়স্ক আত্মবিশ্বাসী অভিবাসীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম হাজার বছর ধরে ছুটে আসা লাখ কোটি অভিবাসীর সেই আশার স্বপ্ন আর ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা।
জয়তু ভালোবাসা। জয়তু নিউইয়র্ক। আজও ধারণ করে আছ বুকভরা ভালোবাসা আর অন্তরে শুধুই প্রিয়জনকে দেখার আনন্দ।