দ্বিতীয় অন্তর

ট্রেনে বসে ভালো করে লক্ষ্য করেন তিনি কত মুখ। কত মানুষ।
আপটাউন ব্রঙ্কসগামী ডি ট্রেন। আগের চেয়ে অনেক উন্নত ও পরিষ্কার। ট্রেন থেকে নেমে কামাল উদ্দিন ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসে। বহু বছর পর কিংস ব্রিজে আসতে হলো। ম্যাডাম উইলিয়াম বাড়িটি বিক্রি করে দেয়নি। ঠিকানাটা স্পষ্ট মনে নেই। কিন্তু সাদা রঙের দোতলা বাড়ি মনে দাগ কেটে আছে। কত স্মৃতি! কত রঙিন দিন কেটেছে।
কামাল উদ্দিন আজ বয়সের ভারে প্রায় কুঁজো হয়ে গেছে। মন বিষণ্ন। হঠাৎ উইলিয়ামের সামনে দাঁড়াতে সংকোচ হচ্ছে। কিন্তু দেশে চলে যাবার আগে শেষ দেখাটি করার প্রবল ইচ্ছা মনে। ব্রিগস অ্যাভিনিউতে অনেকগুলো সাদা বাড়ি। একই ডিজাইনের। নিউইয়র্কে প্রতিটি পাড়ায় কেন যে বাড়ি অ্যাপার্টমেন্ট ফ্ল্যাট একটার চেয়ে অন্যটিকে আলাদা করা যায় না! অদ্ভুত ব্যাপার। অচেনা ভিনদেশি কত মানুষ বসত করে এখানে। হাঁটতে হাঁটতে কয়েকজন বাঙালির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বাড়ির সামনে বাগানে কাজ করছে এক যুবক। কামালের সামান্য গর্ব বোধ হলো। এরা সব বাড়ির মালিক! অল্পবয়সী বাঙালি ভদ্রলোক গোলাপ গাছ থেকে একগুচ্ছ গোলাপ ফুল পেড়ে বলে, আংকেল কোন বাসায় যাবেন। আপনাকে আগে কখনো দেখিনি। নিন এই ফুলগুলো নিয়ে যান। দেখেন ফুলের ভারে গাছটি কেমন নুয়ে পড়েছে। আমার হাতে লাগানো গাছ। আমাকে আনন্দ দেয়!
জুনের সোনালি রৌদ্র আলোকিত একটি প্রসন্ন বিকেল। কামাল উদ্দিন হাত বাড়িয়ে ফুলের তোড়াটি নেয়।
— বাহ চমৎকার গোলাপ, কিন্তু গন্ধ নেই।
—তাতে কি আংকেল, গোলাপ তো গোলাপই। রংটা দেখেন কেমন টকটকে লাল! একেই রক্ত গোলাপ বলে তাই না?
—হ্যাঁ, তাইতো দেখছি। আমি যাব মিস উইলিয়ামের বাড়িতে।
যুবক উৎসাহ ভরা কণ্ঠে বলে, বারুক কলেজের বায়োলজির অধ্যাপিকা। আর একটু এগিয়ে যান। মৃত্তিকা বাড়িটির পরেরটিই। বদরাগী মহিলা।
—বাড়ির নাম বুঝি মৃত্তিকা? নিশ্চয় বাঙালির বাড়ি।
—হ্যাঁ। আমি ঠিক করেছি আমার বাড়ির নাম রাখব দখিন হাওয়া। জানেন তো হুমায়ূন আহমেদের ঢাকায় ফ্ল্যাটের নাম দখিন হাওয়া।
কামাল উদ্দিন হেসে ফেলে, অন্য নাম রাখুন। আপনি বোধ হয় হ‌ুমায়ূন ভক্ত।
—খু-উ-ব। ওনার প্রায় সব বইই পড়েছি। স্যারের আরও অনেক বছর বেঁচে থাকা উচিত ছিল। আংকেল আসুন না একটু চা খাবেন। আর আমার লাইব্রেরি ও ব্যাকইয়ার্ডের সবজি বাগান দেখবেন। আপনি থাকেন কোথায়?
—কুইন্সে। হাতে সময় নেই। আপনাকে ধন্যবাদ। যে বই পড়ে সে বাগানও করে। প্রকৃতি তাদের প্রিয় আমি জানি। ভালো থাকুন ইয়ংম্যান। আপনার বাড়ির নাম রাখবেন স্বপ্ননীড়। আসি, কেমন!
লম্বা লম্বা পা ফেলে কামাল উদ্দিন হাঁটে। অবাক বিস্ময়ে জাহিদ চেয়ে থাকে। ভদ্রলোকের দেওয়া নামটি তার খুবই পছন্দ হয়েছে। স্বপ্নে ছিল বাড়িটি। জাহিদ সব সময় মনে মনে কল্পনা করেছিল নিউইয়র্ক শহরে তার একটি বাড়ি হবে। সামনে পেছনে বিস্তর জায়গা থাকবে। মানুষ যা ভাবে, আসলে তা হয়। প্রভাতি দৌড়ে আসে, আব্বু লেটস গো। লাইব্রেরিতে যাব।
সেকেন্ড গ্রেডে পড়ুয়া প্রভাতিকে পরির মতো সুন্দর লাগছে। জাহিদ মুগ্ধ নয়নে প্রভাতির দিকে চেয়ে থাকে। মোহনা যখন প্রথম কনসিভ করেছিল, তখন জাহিদের কেবলই মনে হতো, একটি পুতুল মেয়ে সারা বাড়ি উড়ে বেড়াচ্ছে। হাসছে, কলকল কথা বলছে। গান গাইছে। তখন তো অ্যাপার্টমেন্ট ফ্ল্যাটে মোহনাকে নিয়ে সংসার শুরু। স্বপ্নে ছিল প্রভাতি। বাড়িও ছিল স্বপ্নেই। আজ সবাই বাস্তব।
—হ্যাঁ, মামনি যাব লাইব্রেরিতে। আমারও বই জমা দেওয়া ডিউ হয়েছে। একটু হাতমুখ ধুয়ে তোমার মতো তৈরি হয়ে নাও।
যাবার বেলায় দেখা করে যাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় ছুটে এসেছে সে। মন বলছে মুগ্ধ হবে বান্ধবী। কামাল উদ্দিন বহু দিনের চেনা বাড়ির সামনে অনেক বছর পর দাঁড়িয়েছে। কলিং বেলে টিপ দেওয়ার আগে অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ভাবে, মিস উইলিয়াম কী তাকে চিনবে? কেন নয়! মন ছুঁয়ে ছিল তো। সেই কবে দুজনে স্বামী-স্ত্রীর মতো এই বাড়িতে থেকেছিল। একে অপরকে ভালোবেসেছিল। উপর নিচ মিলিয়ে আটটি রুম। খলখল কলকল কত কথা-হাসি, লং ড্রাইভে শহর থেকে অনেক দূরে চলে যাওয়া। পরিচয় হয়েছিল কনি আইল্যান্ড বিচে। সমুদ্রের সান্নিধ্যে।
ঢাকায় নুরজাহানকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের ডলার পাঠিয়ে প্রতি মাসে দু-চারটি গভীর প্রেমের ভাষা মিশ্রিত চিঠি লিখে স্বামীর দায়িত্ব পালনে কুণ্ঠা করেনি কামাল উদ্দিন। হৃদয় তখন দুই নারীতে গচ্ছিত। ভালোই দিন গেছে। ছেলে মেয়েদের নিয়ে নুরজাহান সচ্ছল সংসার করেছে। অভাব নেই। অভিযোগ বলতে একটাই কবে আসবে, বৈধ কাগজ হতে আর কত দেরি। আমাদেরকে তোমাদের কাছে নিয়ে যাও। কবে যাব স্বর্গ সুখের আমেরিকায়। কামাল উদ্দিনের ভীষণ কষ্ট হতো। নুরজাহান কেন একবারও বলে না। অনেক হলো, এবার চলে এসো। দেশে আমরা ভালোই থাকব। সাগর, সৈকত তোমার দুই ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে ফেলল প্রায়। তুমি আমেরিকায় আছ বলেই আমরা ভালো আছি। নুরজাহানের একই সুর, ফ্ল্যাটের কিস্তির টাকা দেওয়া হলেই তোমার ছুটি। ধানমন্ডিতে আঠারো শ স্কয়ারফিটের ফ্ল্যাট হচ্ছে! তুমি আমেরিকায় আছ বলেই তো! লক্ষ্মী কামাল আরও একটু কষ্ট করো। তারপর সুখ আর সুখ।
আহ্ কষ্ট! কামাল উদ্দিনের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। নুরজাহানের কথা ভেবেই উইলিয়ামকে বিয়ে করা হয়নি। বিয়ের ব্যাপারে উইলিয়ামেরও কোনো আগ্রহ ছিল না।
যত দিন ভালো লাগে থাকো। বিতৃষ্ণা লাগলে চলে যেও।
এর মধ্যেই উইলিয়াম মা হলো। কামাল উদ্দিন ছেলের নাম রেখেছে নোবেল। লাস্ট নেইম পিটার। নোবেল পিটার।
নোবেল আর্মিতে যোগদান করেছিল। ইরাকে যুদ্ধ করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরে আসে। কামাল উদ্দিনের বুকের ভেতরটা কে যেন খামচে ধরে। নিশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে।
নোবেল বেঁচে থাকলে আজ জীবনটা অন্যরকম হতো। দেশে চলে যাবার সময় বাবাকে এয়ারপোর্ট নিয়ে যেত। কামাল উদ্দিন নোবেলকে বলত, ইউ হ্যাভ টু কাম মাই কান্ট্রি বাংলাদেশ। ইটস আ ওয়ান্ডারফুল বিউটিফুল গ্রিন কান্ট্রি। আই বর্ন ওভার দেওয়ার। আই পুট মাই হার্ট ইন বাংলাদেশ। মনের অজান্তে আঙুল কলিং বেলে চাপ দেয়।
ভেতর থেকে কর্কশ কণ্ঠ শোনা যায়। হু ইজ দিস?
মি!
মি হু!
কামাল উদ্দিন!
প্রচণ্ড শব্দে ধুপধাপ পা ফেলে কে যেন এগিয়ে আসে।
দরজা খুলে যায়।
উইলিয়ামের মতোই অসম্ভব কুচকুচে কালো রং কোঁকড়া চুলের বেঁটে মোটা নারী, বয়স অনেক কম। কামাল উদ্দিনের হঠাৎ মনে হয় ভুল বাসায় সে ঢুকে পড়তে চাচ্ছে নাকি।
আই অ্যাম কামাল উদ্দিন। মাই গার্লফ্রেন্ড উইলিয়াম লিভ ইন দিস হাউস। হোয়ার ইজ শি।
শি ডাইড মোর দ্যান থ্রি ইয়ারস। আই অ্যাম হার গডডটার।
ইউ ক্যান গো মি. কামাল, আই অ্যাম সরি। মুখের ওপর দরজা বন্ধ হলো।
কামাল উদ্দিন হকচকিয়ে যায়, মনে হয় সে যা বলছে, তা সত্যি নয়!
পকেটে বাংলাদেশে যাওয়ার প্লেনের টিকিটটি আছে কিনা, সে তা বের করে দেখে। এ দেশ তাকে কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে অনেক ডলার দিলেও দেয়নি স্বস্তি। সে পায়নি শান্তি। উইলিয়াম একদিন বলল, গুড বাই! এই ব্রিগস অ্যাভিনিউতে তখন কোনো বাঙালির বসত ছিল না।
ফেরার পথে আরও কয়েকজন বাঙালির সঙ্গে কামাল উদ্দিনের দেখা হয়। সে মনে মনে বলে তোমরা সবাই ভালো থেকো।
এত বছরের চেনা জীবনকে পেছনে ফেলে নীরবে চলে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলেও সেটি হলো না। ওয়ার্ল্ড ফেয়ার মেরিনায় তার জন্য বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করেছে প্রবাসী তরুণ প্রজন্ম ও তার বন্ধুরা। এখনই তাকে যেতে হবে নোবেলের কবরের কাছে। কিন্তু পায়ে যেন তিলমাত্র শক্তি নেই। মনে আবার জ্বলে ওঠে হাজার পাওয়ারের বাতি। দেশে ফেরার আগে তার করণীয় কাজ গুলো করতেই হবে। সে সৃষ্টিকর্তাকে মনে মনে ধন্যবাদ দেয়, অন্তত তাকে লাশ হয়ে দেশে প্রিয় স্বজনদের কাছে ফিরতে হচ্ছে না। সে সুস্থভাবেই যাচ্ছে! দুঃখ, বৈধ কাগজ হলো না।
পকেটে সেলফোন বেজে ওঠে। ফোনটি হাতে নিয়ে সে দেখে শাহানার নাম্বার। হাসি খুশি চমৎকার মেয়ে শাহানা, পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার জন্য ভাবনা যার। ডুইন ড্রিতে কামাল উদ্দিনের স্টোরেই কাজ করে।
আংকেল আপনি কোথায়?
অনেক দূরে মা। ব্রঙ্কসে।
কার কাছে গেছেন। কোথায় যে ঘুরে বেড়ান, আর আমরা আতঙ্কে থাকি।
দ্বিতীয় অন্তরের কাছে গিয়েছিলাম। সেখানে আমার অনেক ঋণ। প্রেম।
মানুষের তো অন্তর একটাই থাকে! হাসতে হাসতে শাহানা চৌধুরী বলে।
তুমি বুঝবে না মেয়ে। তোমরা আনবে নতুন কিছু। এসব বুঝবে না গো।
আমার বুঝে কাজ নেই আংকেল। আপনি এখনই জ্যাকসন হাইটসে চলে আসুন। আমি আপনাকে আমার গাড়িতে ওয়ার্ল্ড ফেয়ার মেরিনায় নিয়ে যাব। ম্যানেজার আংকেলের জন্য আমি এতটুকু করব না?
আমি তো কবেই কাজ ছেড়ে দিয়েছি মা। আমি ছন্নছাড়া যাযাবর। ভাসছি শূন্যে।
শাহানা হাসে, আপনি আমাকে ডুইন ড্রিতে কাজটি দিয়েছিলেন। আপনার জন্য আমার অনেক কিছু করতে ইচ্ছা করে আংকেল।
প্রাণ ভরে তো তাই করছ মেয়ে! আচ্ছা আমি এখন ট্রেনে চড়ব।
সাবধানে আসবেন। আবার যেন পড়ে না যান। বুড়োদের নিয়ে সমস্যা! দুদিন পর আপনার ফ্লাইট। দেশ আপনাকে ডাকছে- আয় আয়!
কামাল উদ্দিন শূন্য দৃষ্টি মেলে আকাশে চোখ রাখে। এই পৃথিবীতে তার আপন বলতে কে আছে চিন্তা করে কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। সাগর আর সৈকত বিয়ে করেছে। সবকিছু বদলে গেছে। নুরজাহান কি তেমনই আছে অপেক্ষায়? কে জানে। আমি চব্বিশটি বছরে প্রতিনিয়ত ভেঙে টুকরো টুকরো হইনি কি? কামাল উদ্দিন নিজেকে প্রশ্ন করে। তার কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। তবুও তাকে যেতে হচ্ছে। পঞ্চাশ বছর বয়সে এ দেশে এসেছিল সে। সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন কত কাল!