প্রবাসে বাঙালি অনুষ্ঠানে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ নেই

আমেরিকায় জন্ম নেওয়া বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেশীয় সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যায় না। বাঙালি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ৫-২০ বছর বয়সীদের সাধারণত অভিভাবকেরা নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যান। এর চেয়ে বেশি বয়সীদের অনুষ্ঠানস্থলে নেওয়াটা বেশ কঠিন। আর যারা যায়, তারাও দেখা যায় অধিকাংশ সময় বিভিন্ন গ্যাজেটেই মুখ বুজে পড়ে থাকে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিবিমুখ নতুন প্রজন্মকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন অভিভাবকেরা।
আমেরিকা প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটির বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন জাতীয় দিবস ছাড়াও রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী বেশ বড় পরিসরে উদ্‌যাপন করা হয়। দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে পরিচয় করিয়ে দিতে প্রবাসীরা তাঁদের সন্তানদের অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে আসেন। এসব অনুষ্ঠানে ২০ বছরের কম বয়সীরা মা-বাবার হাত ধরে অনুষ্ঠানে এলেও তাদের মধ্যে এ নিয়ে কোনো উৎসাহ কাজ করে না। আর এর চেয়ে বেশি বয়সীদের অনুষ্ঠানে নেওয়াটাই বেশ কঠিন। অনেকেই মা-বাবাকে সাফ জানিয়ে দেয়, ‘আমি অনুষ্ঠানে যাব না’।
জাতিসংঘে সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে আসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংবর্ধনা সভায়ও এই অনাগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। অনেকেই তাদের বাচ্চাদের সঙ্গে করে নিয়ে এলেও নতুন প্রজন্ম বুঁদ হয়ে ছিল সঙ্গে থাকা আইপ্যাড, স্মার্টফোন ও গেমে। ছেলে-মেয়েদের এমন আচরণে অনেক অভিভাবককে রাগ প্রকাশ করতে দেখা গেলেও তাদের মধ্যে কোনো ভাবান্তর হয়নি।
বাংলাদেশি অভিভাবকদের অনেকের প্রশ্ন, ‘বাঙালি অনুষ্ঠানে বাচ্চাদের কেন আগ্রহ নেই?’ কেউ কেউ এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে পেয়েছেন, ভাষার ব্যবধান, শিকড় থেকে দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্ন থাকাসহ আরও নানা কারণ।
কিছুদিন আগে লাকসাম সোসাইটির এক অনুষ্ঠানেও একই অবস্থা দেখা গেছে। ওই অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতা আবদুল লতিফ সম্রাট, মোস্তফা কামাল পাশা বাবুলসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকলেও নতুন প্রজন্মের কারও মধ্যেই কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। এমনকি সাংস্কৃতিক পর্বেও তারা অমনোযোগী ছিল। অতিথিদের বক্তব্যের সময় বাচ্চাদের দেখা গেছে ইংরেজিতে পরস্পরের সঙ্গে গল্প করতে। গত নভেম্বরে মানিকগঞ্জের এক অভিষেক অনুষ্ঠানে মন মাতানো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলাকালে অধিকাংশ বাচ্চাদের ফোনে গেম খেলায় ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। এই একই অবস্থা দেখে গেছে একাধিক অনুষ্ঠানস্থলে। সমবয়সী অন্যদের নিয়ে খেলায় মগ্ন এই বাচ্চাদের কারও মধ্যেই দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রবাসী সংগঠনগুলো অনেক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেও, এসব অনুষ্ঠানের একটি অংশজুড়ে থাকে বক্তব্য বা আলোচনা। এই অংশটি কম বয়সী যে কারও জন্যই আকর্ষণীয় নয়। এ ছাড়া প্রবাসে জন্ম নেওয়া এই প্রজন্মের অনেকেই কখনো দেশ দেখেনি। ফলে এই আমেরিকাই তাদের কাছে নিজ দেশ হয়ে উঠেছে। রয়েছে ভাষার দূরত্বও। এদের অনেকেই ইংরেজিতে যতটা অভ্যস্ত, ততটা বাংলায় নয়। ফলে বাংলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তাদের আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। তাদের উপযোগী করে কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহ বাড়তে পারে তাদের।
এর প্রমাণও পাওয়া গেল সম্প্রতি। মিরসরাই সমিতির এক বৈশাখী অনুষ্ঠানে বাচ্চাদের জন্য বাংলায় নিজের নাম লেখার প্রতিযোগিতা হয়েছিল। সেখানে গুটিকয়েক বাংলায় নিজ নাম লিখতে পেরেছিল। এদের সবাইকে পুরস্কৃত করা হয়। পরে আবারও এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করলে দেখা যায়, অধিকাংশ বাচ্চাই এখন নিজের নাম লিখতে পারছে। এভাবে বাচ্চাদের জন্য উৎসাহজনক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে তাদের মধ্যে সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আগ্রহ বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এখানকার অভিভাবকদের আন্তরিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তবে প্রশ্ন আছে উপায় নিয়ে। অধিকাংশ অভিভাবকই বাইরের অনুষ্ঠানকেই দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সন্তানদের পরিচয়ের মূল ক্ষেত্র বলে চিহ্নিত করেন। এখানেই ভুল। এই কাজটি হতে হবে ঘরে। পরিবারের মধ্যে সবার সঙ্গে বাংলা ভাষায় বাংলাদেশের সংস্কৃতি নিয়ে নিয়মিত চর্চা হলে সন্তানরা আর এই ক্ষেত্রটি থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করবে না। তাদের মনে একটি যোগসূত্র তৈরি হবে, যা বাইরের বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে আরও দৃঢ় হবে।