নিউইয়র্কের বাংলা চর্চা

ডিসেম্বর-জানুয়ারির হাড় কাঁপানো শীত। জ্যামাইকার এক রেস্তোরাঁয় মুক্তিযোদ্ধারা সংবর্ধনা দেবেন ড. নুরুন্নবীকে। বাংলা একাডেমির ফেলোশিপ পেয়েছেন তিনি। সরাফ সরকারের আমন্ত্রণে সংবর্ধনায় যোগ দিয়ে বিজ্ঞানী ও মুক্তিযোদ্ধা ড. নবীকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেওয়ার দাবি জানিয়ে বক্তব্যও দিলাম। অনুষ্ঠান শেষে সরাফ সরকার বলেন, চলুন পৌষের পিঠা উৎসবে যাব। খুব দূরে নয়, কাছেই লিবার্টি অ্যাভিনিউর ওপর। দেখবেন, ভালো লাগবে। শীতের কাঁপুনিতে ইতস্তত করছিলাম। সরাফ সরকার নাছোড়বান্দা। চলুন, চলুন, বাসায় আমি পৌঁছে দেব। পিঠা উৎসবে গিয়ে মনটা ভরে গেল। রকমারি পিঠার সমাহার। বহুদিন হলো এত পিঠা দেখিওনি, খাইওনি। তৃপ্তির ষোলো আনা পূরণ করলাম।
শুরুতে আয়োজক কর্তার তরুণী কন্যা, এক দামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, আমাদের হালকা পানীয় পরিবেশন করছিল। অতিথিদের একে একে জিজ্ঞেস করছিল, ‘তুমি কী খাবে?’ পেপসি, কোক, ডায়েট? চাচার বয়সীদের বারবার ‘তুমি’ সম্বোধনে পিতা হয়তো বিব্রত বোধ করছিলেন। একসময় বলেই ফেললেন, কিছু মনে করবেন না, এখানে বড় হওয়া মেয়ে ‘আপনি’ আর ‘তুমি’র পার্থক্যটা বুঝে উঠতে পারেনি। অথচ তার আন্তরিকতার ছোঁয়া ছিল অধিক প্রাণস্পর্শী। আর যে কিনা বাঙালির ঐতিহ্যের এত প্রিয় পিঠা তৈরি ও পরিবেশনে নিবেদিত।
মনে মনে ভাবলাম, এ তো অনেক ভালো। অন্তত বাংলায় কথা বলছে। নতুন প্রজন্মের এক বড় অংশ তো এই চর্চা থেকে দূরে, বহু দূরে। ঘরে-বাইরে অনেকে আছে, ইংরেজির পাশাপাশি পিতা-মাতার কথ্য (আঞ্চলিক) ভাষায় কথা বলে। এখানে অনুপস্থিত শুদ্ধ বাংলা। এর বড় দায় অভিভাবকদের।
অবশ্য সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমেরিকায়, বিশেষ করে এই নিউইয়র্কে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা বেশ বেগবান। বিভিন্ন স্কুলে সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে আছে বাংলা। লং আইল্যান্ড সিটি হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক আবুল কালাম আজাদের কথা জানি। বাংলা শেখানোর জন্য তাঁর ব্যক্তিগত চেষ্টা ও আন্তরিকতা সবার দৃষ্টি কাড়ে। এখানের হাসপাতাল, সাবওয়েসহ বিভিন্ন জনসেবাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষা স্বীকৃতি পেয়েছে। বাঙালিদের বিভিন্ন সংগঠন যেমন বিপা, উদীচী, সংগীত পরিষদ, বহ্নিশিখা, সাহিত্য একাডেমি, থিয়েটার, ড্রামা সার্কেলসহ অন্যরা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চায় নিবেদিত। ব্যক্তি ও পারিবারিক উদ্যোগে বাংলার চর্চা চোখে পড়ে। নতুন প্রজন্মের অনেকের সাহিত্য রচনা, গান, কবিতা আবৃত্তি, নৃত্য মন ছুঁয়ে যায়। মনেই হয় না আমেরিকায় আছি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে এখানের সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অবদান অসামান্য। অবদান আছে সামাজিক সংগঠনগুলোরও। তবে অভাব আছে সুসমন্বিত কার্যক্রমের। বাংলাদেশ দূতাবাস ও কনস্যুলেটের এ ব্যাপারে ভূমিকা কখনো চোখে পড়েনি। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশে তাদের কি কিছু করার নেই?
একশ্রেণির অভিভাবকসহ নতুন প্রজন্মের একাংশের ধারণা ও বিশ্বাস, এখানে বাংলা শেখা অনর্থক—অনাবশ্যক। শিখে কী লাভ? এতে কি আর্থিক স্বাবলম্বী হওয়া যায়? বা চাকরি, পদ, পদবি? এই বিশ্বাস খুব আত্মঘাতী। নিজের শিকড় কেটে ফেলার শামিল। এই আমেরিকায় চার শ বছর পরও আইরিশ, ইতালিয়ান, গ্রিক, চায়নিজ, স্প্যানিশরা নিজ ভাষা ও আত্মপরিচয় নিয়ে গর্ববোধ করে। মোজাইক সংস্কৃতির মাঝে হারিয়ে যায়নি। গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করছে তাদের অস্তিত্ব। তবে বাঙালিরা হারিয়ে যাবে কেন? কেন মুছে যাবে আত্মমর্যাদা?
সম্প্রতি হাতে আসা এক চিঠির কথা উল্লেখ করে এই লেখা শেষ করব। নিউইয়র্কে ‘মেট্রো প্লাস’ একটি পরিচিত নাম। বিশেষ করে মেডিকেইড ও মেডিকেল ইনস্যুরেন্স যাদের আছে, তাদের কাছে এই নাম প্রিয় এবং প্রয়োজনীয়। সম্প্রতি ‘ল্যাংগুয়েজ অ্যাসিস্ট্যান্স’-সংক্রান্ত এক চিঠিতে মেট্রো প্লাস ইংরেজিতে লিখে: অ্যাটেনশন: ল্যাংগুয়েজ অ্যাসিস্ট্যান্স সার্ভিস, ফ্রি অব চার্জ আর এভেয়লেবল টু ইউ-কল ১-৮০০-৩০৩-৯৬২৬। এই কথাগুলো বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে পত্রস্থ করা হয়। এখানে ইংরেজির পাশাপাশি স্প্যানিশ, চায়নিজ, আরবি, কোরীয়, গ্রিক, রাশিয়ান, ইতালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, উর্দু, পোলিশ, আলবেনিয়ান, বাংলাসহ আরও কয়েকটি ভাষা রয়েছে। বাংলায় যা লেখা হয় তা নিচে উল্লেখ করলাম:
‘লক্ষ্য করুন: যদি আপনি বাংলা কথা বলতে পারেন, তাহলে নিখরচায় ভাষা সহায়তা পরিষেবা উপলক্ষ আছে: ফোন করুন…।
আমি এই বাংলার মর্ম উদ্ধারে ব্যর্থ হই। যতটুকু জানি, অনেক বাঙালি মেট্রো প্লাসে চাকরি করেন। শুদ্ধ সঠিক বাংলা অনুবাদের ব্যাপারে তাঁরা আশা করি মেট্রো প্লাসকে সাহায্য করবেন।

লেখক নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক।