বিপদে আমেরিকার কফিহাউস

আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় কফি চেইন স্টারবাকস বেশ ভালো বিপদেই পড়েছে। দুই কৃষ্ণাঙ্গ ক্রেতার সঙ্গে স্টারবাকসের এক শাখা ব্যবস্থাপকের দুর্ব্যবহারের সূত্র ধরে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে উঠেছে বর্ণবাদের অভিযোগ। তীব্র সমালোচনার মুখে বারবার ক্ষমা চেয়েও পার পাচ্ছে না আমেরিকার এই ‘কফিহাউস’। এই অবস্থায় আগামী ২৯ মে বিকেলে আমেরিকায় স্টারবাকসের সব শাখা বন্ধ রেখে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে স্টারবাকস কর্তৃপক্ষ।
আমেরিকার মানুষের নিত্যদিনের জীবনে কিছু নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

স্টারবাকস তার একটি। সকাল-বিকেল কফি পানই শুধু নয়, স্টারবাকসের স্টোরে বসে ল্যাপটপে জরুরি মেইল আদান-প্রদান সারাসহ অনেকভাবেই এই প্রতিষ্ঠানটি আমেরিকানদের জীবনের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এই কফি হাউসের বিরুদ্ধে এখন বর্ণবাদ উসকে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এর কয়েক দিন আগেই ক্যালিফোর্নিয়ার আদালতের নির্দেশে কফির মগে ‘ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান রয়েছে’ বলে সতর্কতা জুড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। সব মিলিয়ে বড় ধরনের ইমেজ সংকটে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

ঘটনার সূত্রপাত ১২ এপ্রিলে। ফিলাডেলফিয়ার একটি স্টারবাকস কফি শপে দুজন আফ্রিকান আমেরিকান বসে ছিলেন। তারা কোনো কিছুর অর্ডার না দেওয়ায় দোকানটির ব্যবস্থাপক বেশ কয়েকবার করে এসে তাদের বসে থাকার কারণ জানতে চান। জবাবে ওই দু জন, আরেকজন বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছেন বলে জানান। বন্ধু এলেই অর্ডার করা হবে বলেও তাঁরা বলেন। কিন্তু শাখা ব্যবস্থাপক এই দুজনকে সন্দেহভাজন বলে অভিযোগ দিলে দুই ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়ে। এতে দেখা যায়, ওই দুই ব্যক্তি অর্ডার না দেওয়ার কারণে তাদের শৌচাগার ব্যবহার করতে দেওয়া হয়নি। পুলিশ যখন তাদের আটক করে নিয়ে যাচ্ছে, তখন তাদের বন্ধুও সেখানে প্রবেশ করে। অর্থাৎ ওই দুই ব্যক্তি সত্যিই তাদের বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিল। এই ঘটনা জানাজানি হলে আমেরিকাজুড়ে স্টারবাকসের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়।
স্টারবাকসের সামনে গিয়ে আন্দোলনকারীরা অবিলম্বে ওই ব্যবস্থাপককে চাকরিচ্যুত করার দাবি তোলে। পরে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কেভিন জনসন, প্রকাশ্যে ওই ব্যক্তিকে বরখাস্ত করেন এবং করজোড়ে ক্ষমা চান। কিন্তু তাতেও ক্ষোভ যায়নি। স্টারবাকস বয়কটের ডাকও দেওয়া হয় আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে, যা পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
এই অবস্থায় ১৭ এপ্রিল স্টারবাকসের পক্ষ থেকে আগামী ২৯ মে বিকেলে প্রতিষ্ঠানটির ৮ হাজার বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির ১ লাখ ৭৫ হাজার কর্মীকে বর্ণবাদ বিষয়ে সচেতনতা, সুব্যবহার ও গ্রাহক সন্তোষের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া ঘোষণায় আরও বলা হয়, শুধু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত কর্মীদেরই নয়, স্টারবাকসের সনদ নেওয়া ৬ হাজার ক্যাফের কর্মীদের জন্যও প্রশিক্ষণ সরঞ্জাম পাঠানো হবে। বিভিন্ন বন্দর ও গ্রোসারি শপে থাকা এই সব বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ থাকবে না ওই দিন। তবে স্টারবাকসের সনদপ্রাপ্ত এই সব ক্যাফের কর্মীদের ব্যবহারও যেন কোনো গ্রাহককে আহত না করে সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বর্তমান পরিস্থিতি স্টারবাকসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) কেভিন জনসনের জন্য বড় পরীক্ষাই বলা যায়। মাত্র এক বছর আগে তিনি প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নিয়েছেন। এরই মধ্যে বেশ কিছু ধকল গিয়েছে তাঁর ওপর দিয়ে। তার মধ্যেও অন্য প্রতিযোগী কোম্পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজের গ্রাহক বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ করে ফিলাডেলফিয়ার ঘটনা তাঁকে ভীষণ বিপাকে ফেলেছে। যদিও হাল ছাড়ছেন না তিনি।
এই বিষয়ে কেভিন জনসন রয়টার্সকে বলেন, ‘এটা (বর্ণবাদী আচরণ) শুধু স্টারবাকসের মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নয়। আমরা এর সমাধানে আন্তরিকভাবে কাজ করব।’
স্টারবাকসের বিক্রয়কেন্দ্রগুলো ঠিক কত ঘণ্টার জন্য বন্ধ রাখা হবে, তা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়নি। তবে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই কফি চেইনের বিক্রয়কেন্দ্রগুলো যত ঘণ্টার জন্যই বন্ধ করা হোক না কেন, এর বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে এর বিক্রিতে। যদিও বিকেলের সময়ে প্রতিষ্ঠানটিতে গ্রাহকসংখ্যা এমনিতেই কম থাকে। কিন্তু প্রশ্নটি এর ভাবমূর্তির।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকায় বর্ণবাদের সংকট মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে এরই মধ্যে। ফলে স্টারবাকসের শাখা ব্যবস্থাপকের দুই কৃষ্ণাঙ্গের সঙ্গে ব্যবহার খুব বেশি আলোড়ন তুলেছে। অথচ এই প্রতিষ্ঠানেরই রয়েছে বর্ণবাদ নিয়ে সংবেদনশীল আচরণের ইতিহাস। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের একটি বড় অংশই কৃষ্ণাঙ্গ। সাধারণ কর্মীদের মধ্যে ১৮ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গ। রয়েছে ব্যবস্থাপনার উচ্চ পর্যায়েও প্রতিনিধিত্ব। ২০১৫ সালে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের গুলিতে কৃষ্ণাঙ্গ মৃত্যুর ঘটনার পর এই স্টারবাকসই ‘রেস টুগেদার’ নামে বর্ণবাদ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা শুরু করেছিল। ফলে স্টারবাকসের দিক থেকে বর্ণবাদী কোনো আচরণ আমেরিকানদের প্রত্যাশিত নয়। আর এটিই স্টারবাকসের বিরুদ্ধে এই ব্যাপক বিক্ষোভের পেছনে কাজ করছে।
এর আগে স্টারবাকস বিক্রীত কফির কাপের গায়ে ক্যানসার সচেতনতা লিখতে নির্দেশ দেয় ক্যালিফোর্নিয়ার একটি আদালত। ওই নির্দেশে বলা হয়, ক্যালিফোর্নিয়ায় পণ্য বিক্রি করতে গেলে ‘ক্যানসার-সতর্কতা’ থাকতে হবে, যদি সেসব পণ্যে ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান থাকে। কফিতে থাকা এক্রিলামাইড মানুষের শরীরে ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে। এ কারণে স্টারবাকসসহ সব কফির কাপে ‘ক্যানসার সতর্কতা” লেখার নির্দেশ দেন লস অ্যাঞ্জেলস সুপিরিয়র কোর্টের এক বিচারক। এ সম্পর্কিত মামলাটি সরাসরি স্টারবাকসের বিরুদ্ধে না হলেও শীর্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্টারবাকসের নামই এসেছে সবখানে। আর এখন যুক্ত হয়েছে ‘বর্ণবাদী’ তকমা। এসব নিয়ে সত্যিই ঘোর বিপদে পড়েছে আমেরিকানদের ভালোবাসার কফি হাউস।