'মা' বলে চিৎকার করে কলেমা পাঠ করে নিলেন

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

মাথার ওপর আমেরিকার পতাকাবাহী হেলিকপ্টার ঘুরছে। পলিথিনের ব্যাগে কাপড় আর কিছু ডলার নিয়ে নদীতে ভাসছেন সাইফুল আলম। কচুরিপানা না হলেও এমন কিছু ঝোপের আড়াল থেকে বন্দুকধারী পুলিশ দেখা যাচ্ছে। সামনে পুলিশ, পেছনে মেক্সিকোর সীমান্তরক্ষী, ওপরে ঘুরছে হেলিকপ্টার। আট মাসের অভিযাত্রায় বাংলাদেশের এক মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান সাইফুল এবার জীবনের মায়া ছেড়ে দিলেন। ‘মা’ বলে চিৎকার করে কলেমা পাঠ করে নিলেন। ঠিক জানেন না কী হয়েছিল, জ্ঞান ফিরলে দেখেন এক ডোবার মতো জায়গায় পড়ে আছেন। কেউ একজন উদ্ধার করল। ঘোড়ার আস্তাবলে আটকে রেখে জানাল, আমেরিকায় চলে এসেছ। কাউকে খবর দাও ডলার পাঠানোর জন্য।
১১ জন সহযাত্রী নিয়ে দালালের মাধ্যমে স্বপ্নের দেশ আমেরিকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছিলেন। টেক্সাস সীমান্তে যখন নদীতে ভাসছিলেন, তখন একা। ছয় মাস জেল খেটেছেন মেক্সিকোতে। এর আগে আটটি দেশ ঘুরেছেন। এক দালাল থেকে অন্য দালালের হাতবদলের শিকার হয়েছেন। ১১ জনের মধ্যে অন্যদের কেউ বেঁচে আছেন কি না, জানেন না। তবে দুরূহ এই যাত্রায় সাইফুল জেনে গেছেন পদে পদে মৃত্যুভয়ের কথা। পদে পদে দালালদের নানা ছক। এসব পেরিয়ে স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় এসে এখনো পালিয়ে বেড়ান অবৈধ অভিবাসী। সিলেটের এক সম্পন্ন ঘরের যুবক সাইফুলের এই অভিযাত্রায় ব্যয় হয়েছে ২৫ লাখ টাকা। অর্থ আর জীবন বাজি রেখে এই অভিযাত্রায় বেরিয়ে পড়া কি ঠিক ছিল? এমন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে শূন্যে চেয়ে থাকেন সাইফুল। একসময় হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন।

বাংলাদেশ থেকে স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় আসার এমন মরণপণ অভিযাত্রা থামেনি। সাইফুলের মতো এমন বহু অভিযাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে। ১৮ এপ্রিল মঙ্গলবার আরও চারজন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে টেক্সাস সীমান্তের লারেডো এলাকা থেকে। তাঁরা চারজনই অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ডার পেট্রল বা সীমান্ত টহল দপ্তর। এই নিয়ে গত বছরের অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ১৭৯ জন বাংলাদেশি অভিবাসীকে গ্রেপ্তার করা হলো। আমেরিকার বোর্ডার পেট্রল দপ্তর জানিয়েছে, এই লারেডো সেক্টর দিয়ে গত বছর থেকে এ পর্যন্ত অবৈধভাবে সীমান্ত পার হওয়ার সময় আটকদের মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।
এর আগে ওই একই সীমান্ত থেকে ২০১৭ সালে ১৮০ জন বাংলাদেশি আটক হয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তের বাইরে বাংলাদেশিদের আটকের সংখ্যা প্রতিবছর কম-বেশি দেখা যায়। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৩ থেকে এই সীমান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের হার বেড়েছে কয়েক গুণ। ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন প্রত্যাশী ১৪৯ জন বাংলাদেশি লাতিন আমেরিকা, বিশেষ করে মেক্সিকোয় আটক হয়েছেন। ২০১২ সালে আটকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬৭। পরের বছরগুলোয়ও মেক্সিকোর কারাগারগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ পথে গমনের দায়ে আটক অভিবাসন প্রত্যাশীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ২০১৩ সালে আটক হয়েছিলেন ৩২৮ জন, ২০১৪ সালে ৬৯০, ২০১৫ সালে ৬৪৮ ও ২০১৬ সালে ৬৯৭ জন।
অভিবাসন প্রত্যাশীদের যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে পাচারকারীরা সাধারণত জনবহুল এলাকা এড়িয়ে মরুভূমি, পাহাড় কিংবা জঙ্গলপথ বেছে নেন। কারণ এসব স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি কম। দুর্গম এসব পথ পাড়ি দিতে গিয়ে মারা যান অনেকেই। কেউ কেউ অসুস্থও হয়ে পড়েন। ১৯৯০ সালের পর থেকে শুধু মেক্সিকোর সীমান্ত এলাকায়ই ছয় হাজারের বেশি মরদেহ উদ্ধার করেছে মার্কিন সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এর মধ্যে কতজন বাংলাদেশি, তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যানও নেই।
যুক্তরাষ্ট্রে বৈধ বাংলাদেশিদের সংখ্যা ২০১০ সালের শুমারি অনুযায়ী প্রায় ২ লাখ ৭৭ হাজার। এখন সেটা বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। আর বৈধ যত নাগরিক আছেন, অবৈধ বা কাগজপত্রহীনদের সংখ্যাও তার কাছাকাছি বলে মনে করা হয়। অভিবাসনের এই হার বাড়তে থাকে মূলত ২০০০ সাল থেকে ডিভি লটারির মধ্য দিয়ে। এখন ডিভি লটারি না থাকলেও পারিবারিক ভিসায় গ্রিন কার্ড নিয়ে প্রতিবছর ঢুকছেন হাজার হাজার বাংলাদেশি। পিউ রিসার্চের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০০ সালের পরে শুধু পারিবারিক অভিবাসনে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছেন দেড় লাখের বেশি বাংলাদেশি। এর বাইরে এমন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আসা বা টুরিস্ট ভিসায় এসে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করা বাংলাদেশির সংখ্যাই বেশি। সীমান্ত দিয়ে এসে অনেকেই রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আটককৃতদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর হার অনেক বেশি।
স্বাধীনতার অল্প কিছুদিন পর থেকেই বাংলাদেশের মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিতে শুরু করেন। শুরুর দিকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের পাশাপাশি শিক্ষাগত কারণে কিছু মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ পান। এরপর ১৯৯০ সালের দিকে এসে ডাইভার্সিটি ভিসা তথা ডিভি লটারির সূত্র ধরেও অনেকে আমেরিকায় আসার সুযোগ পান। ডিভি লটারি প্রোগ্রামের আওতায় গ্রিন কার্ড পেয়ে নাগরিকত্বও পেয়েছেন অনেকে। যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারি অনুযায়ী, ১৯৮০ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি জনসংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৮০০। ২০০০ সালের দিকে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ হাজার ৪১২ জনে। আর এখন সেটা ধারণা করা হয় সাড়ে ৩ থেকে ৫ লাখের মতো। লটারি ভিসায় যাঁরা এসেছিলেন, নাগরিকত্ব পাওয়ার পর তাঁদের পরিবারের অন্যরাও আসছেন। পারিবারিক অভিবাসনে নিত্য আসা বাংলাদেশিরা ঠাঁই করে নিচ্ছেন যে যাঁর মতো করে।
আমেরিকার অভিবাসন কড়াকড়ির চলমান এই সময়ে যেসব বেপরোয়া বাংলাদেশি দেশ থেকে দালাল চক্রের মাধ্যমে মরণকামড় অভিযাত্রায় প্রতিদিন যোগ দিচ্ছেন, তাঁদের ঠেকানোর কেউ নেই। সরকারি-বেসরকারি কোনো উদ্যোগ নেই, প্রবাস মন্ত্রণালয়েরও কোনো কর্মসূচি নেই দালালের মাধ্যমে আমেরিকায় আসার চেষ্টা রোধ করার জন্য।
সাইফুলের মতো অভিযাত্রী, যাঁরা বেঁচে থাকবেন, তাঁদের জীবন-যৌবন যাবে স্বপ্নের দেশে পৌঁছানোর পেছনে ছুটতে গিয়ে। সীমান্ত পার হতে গিয়ে যাঁদের প্রাণহানি ঘটে, যাঁরা কারাবাসে থাকেন মাসের পর মাস এমনকি বছরের পর বছর, এমন অভিযাত্রীর অনেক কাহিনি অজানাই থেকে যায়।
সাইফুল আলম তাঁর দীর্ঘ অভিযাত্রার কাহিনি বলে খানিকটা ধাতস্থ হলেন। বললেন, ‘আমাদের দেশটা নাকি উন্নত দেশ হয়ে যাবে? কবে হবে? আমি দেশে চলে যাব।’