আপনার মাকে কল করুন

মা কি শালিক পাখি?
খয়েরি শাড়িতে তাঁর
হলুদের ছোপ
তারপর একদিন তিনি
শুভ্র কাফন পরে
শেফালির ফুল।

আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর বা তারও আগের কথা। ময়মনসিংহে একবার একটি অনুষ্ঠানে কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর আবেগ জড়িত কণ্ঠে কবিতাটির আবৃত্তি শুনেছিলাম। যত দূর মনে পড়ে কবি বলেছিলেন, তাঁর বাবা ময়মনসিংহে কর্মরত থাকাকালে মা ইন্তেকাল করেন, তাঁকে নিয়েই তাঁর এই কবিতা। কবিতাটি সেদিন আমাকেও কাঁদিয়েছিল। তখন কল্পনাও করতে পারিনি আমার মা-ও সত্যই একদিন আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন।
সব সন্তানেরই তাঁর মাকে নিয়ে একটা গল্প আছে। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। আমার গল্পটি পরে বলি, তার আগে বলি মাতৃত্ব নিয়ে লেখা বিশিষ্ট মনোরোগ বিজ্ঞানী ডেনিয়েল স্ট্রেনের দুটি বই মাতৃত্বের তারার ঝাঁক এবং একটি মায়ের জন্ম বই থেকে কিছু কথা।
ডেনিয়েল দুঃখ করে বলেছেন, মাতৃত্বে শিশুর জন্ম প্রক্রিয়া নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। তবে মাতৃত্বের মানসিক ও আবেগময় অবস্থা নিয়ে গবেষণার পরিমাণ অনেক কম। বেশির ভাগ মায়ের জন্যই গর্ভবতী হওয়া এবং মাতৃত্বের স্বাদ নেওয়া একটি আনন্দঘন বিষয়। কিন্তু এই মাতৃত্ব অর্জনের পথে কোন এক সময়ে বেশির ভাগ মা-ই শঙ্কা, হতাশা, অপরাধবোধে ভোগেন। কোন কোন সময় সন্তান জন্মাবার পরও মায়ের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়। ডা. স্ট্রেন আরও বলেছেন, মা হওয়ার অর্থ একজন নারীর অতি গুরুত্বপূর্ণ শারীরিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হওয়া। মা হওয়া মানে শুধু একটি শিশুর জন্ম দেওয়া নয়, এর মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় একটি পরিবারের। মায়ের সঙ্গে তার সঙ্গীর সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে। দেখা যায় অধিক আন্তরিকতা।
পৃথিবীর মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয় শব্দটি হল ‘মা’। মাকে নিয়ে একটি গল্প নেই এমন মানুষ কেউ আছে বলে আমার জানা নেই। কারও মা চিরদিন বেঁচে থাকেন না। মায়েরা চলে যায়, রেখে যায় অসংখ্য স্মৃতি। পৃথিবীতে সবচেয়ে দুঃখী সেই, যার মা নেই। আমি সেই দুঃখীদের দলে। আর তাই যাদের মা এখনো বেঁচে আছেন, তাদের জন্যই আমার এই লেখা।
এপ্রিলের শেষে যখন এ দেশে বসন্ত শুরু হয় তখন থেকেই প্রকৃতি অপরূপ সাজে সাজতে থাকে। শীতের জীর্ণ বৃক্ষে আসে নবীন পল্লব। গাছে গাছে ফোটে নানা রঙের ফুল আর মঞ্জরি। মৃদু বাতাসে এরা দুলে দুলে মনে করিয়ে দেয় ‘সামার’ (গ্রীষ্ম) আসছে। ঠিক এই সময়ে মে মাসের দ্বিতীয় রোববার বাংলাদেশ ও আমেরিকাসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই পালিত হয় মায়েদের জন্য বিশেষভাবে উৎসর্গীকৃত একটি দিন ‘মা দিবস’। মায়েদের জন্য উপহারের তালিকা নিয়ে পত্রিকার পাতায় অসংখ্য বিজ্ঞাপন ছাপা হয় ইন্টারনেট, টেলিভিশন আর বেতারে। কিন্তু এই বিজ্ঞাপনগুলো আমাকে কেমন যেন বিমর্ষ করে দেয় কারণ আমার মা নেই। ওই বিজ্ঞাপনগুলো দেখলে কেবলই মনে হয়, মা বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁকে কিছু পাঠাতে পারতাম।
আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল বালিকা বয়সে, যখন তাঁর বেণি দুলিয়ে ফ্রক পরে স্কুলে যাওয়ার কথা। অনেকটা সে রকম বয়সে তাঁকে যেতে হয়েছে শ্বশুর বাড়ি। স্বাভাবিকভাবেই আমার জন্মও হয়েছে আমার মায়ের সদ্য যুবতী বয়সে। আর তাই আমার সুযোগ হয়েছিল সংসারের অনেক সুখে-দুঃখে মায়ের সঙ্গী হওয়ার। আমাদের সংসারটা তিলে তিলে গড়ে তুলে ছিলেন তিনি। আমার বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। এরশাদ ক্ষমতা দখল করার পরপরই প্রায় ৫০০ সরকারি কর্মকর্তাকে নানা অজুহাতে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। দুঃখজনকভাবে আমার বাবা সেই তালিকায় ছিলেন। যদিও পরে তদন্তে তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে চাকরি ফিরে পেয়েছিলেন। তখন প্রায় এক বছর আব্বার বেতন বন্ধ থাকে। আমাদের সীমাহীন অর্থ কষ্টে পড়তে হয়। সেই দুঃসময়ে দেখেছি আমার মা কী দৃঢ়তার সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন। নিজের সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে, সব গয়না বিক্রি করে সংসার আগলে রেখেছেন। আমার ইউনিভার্সিটির পড়ার খরচ দিয়েছেন। কাউকে কিছু বুঝতে দেননি।
আমি বুঝলাম একজন মা হতে হলে তাঁকে কত রকম পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। আগুনে পুড়ে যেমন সোনা খাঁটি হয়, জীবনের ঘাত প্রতি ঘাতে মায়েরাও তেমনি খাঁটি হন। শুধু দুঃখের স্মৃতি নয়, মায়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অসংখ্য সুখের স্মৃতি। আমি চাকরি পেলাম, বাবার চাকরিরও অনেক উন্নতি হলো। ছোট ভাইয়েরা ব্যবসা শুরু করল। আম্মা সময় পেলেই ঢাকায় আমার বাসায় এসে থাকেন। প্রায়ই ডাক্তার দেখাতেও আসেন। আম্মা কয়েকদিন ধরেই দাঁতের ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন। নিয়ে গেলাম এক ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার আম্মাকে দেখে মুখ কালো করলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখে বললেন ক্যানসার। আমরা অসহায়ের মতো চিকিৎসার নানা চেষ্টা করলাম। সকালে এই ডাক্তারের কাছে যাই তো বিকেলে আরেকজনের কাছে। বিদেশে নেওয়ার জন্য টাকা পয়সা জোগাড়ের চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমাদের খুব একটা কিছু করার সুযোগ না দিয়েই আম্মা পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন।
মায়ের মৃত্যু যে কী গভীর ব্যথা তা যার মা নেই, শুধু তিনি বুঝতে পারবেন। মায়ের মৃত্যুর পর কোন রকম দুঃসংবাদকে আর দুঃসংবাদ বলে মনে হয় না। আমার মা থাকবে না, এ কথা কোনো দিন কল্পনাও করতে পারিনি।
আজকে যাদের মা বেঁচে আছেন তাদের বলি, তিনি যেখানেই থাকুন আপনার ফোনটি হাতে নিয়ে তাকে কল করুন। মায়ের কথা শুনুন, প্রাণ ভরে বলুন ‘মাগো তোমায় ভালোবাসি’। আর যারা খুব ব্যস্ত, যারা সময়ের অভাবে এখনো মা যে কথাটি বলতে চাচ্ছিলেন কিন্তু শোনা হয়নি তাদের জন্য সুব্রত রুদ্রের ‘হিমঘর’ কবিতা দিয়ে লেখাটি শেষ করছি—
—-খোকা, তোর সঙ্গে কটা কথা ছিল/মা চলে যাওয়ার পর থেকে/ এই কথাটা আমাকে তাড়া করে বেড়ায়/ আমার সময় ছিল না—-মা-র কটা কথা শোনার/ বড়ো ব্যস্ত আমি, কত কাজ আমার/সঙ্গহীনা সারা দিনরাত একা একা থাকত/আপনমনে বক বক করে যেত/ জীবনের হিসাব না মেলা খাতা খুলে/কে কে তার প্রাপ্য দেয়নি/কারা কারা ঠকিয়েছে/সংসার কেমন করে ব্যবহার করে গেছে তাকে/এই সব হিসাব নিকাশ চলত আপন মনে/তারপরেও কটা কথা বাকি থেকে যেত/কাউকে কাউকে শোনাতে চাইত/ভাবতুম একদিন ঠিক শুনে নেব। —-একদিন এসে দেখবি মা মরে পড়ে আছে/বলতো প্রায়ই। ভাবতুম ওরকম তো কতই বলে।/বাবার বাড়িতে মা একাই থাকত—-একদম একা/প্রতিজ্ঞা করতুম এবার বাড়ি গিয়ে কটা কথা শুনব—-তারপর আর সব।
বাড়িতে এলুম যখন/মা পিস হ্যাভেনে বরফের ওপর একা একা শুয়ে আছে/না-বলা কটা কথা বুকে নিয়ে/ আর কোনো প্রতীক্ষা নেই কারও কাছে বলার।

লেখক: গল্পকার, ইমেইল: [email protected]