দুই রুমের বাসা ভাড়া মাত্র ২৮ ডলার!

বই পড়তে ভালোবাসতেন প্যাট্রিসিয়া
বই পড়তে ভালোবাসতেন প্যাট্রিসিয়া

ভীষণ ব্যয়বহুল শহর নিউইয়র্ক। কিন্তু এই শহরেই মাত্র ২৮ ডলার মাসিক ভাড়ায় দুই কক্ষের একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন হলিউড অভিনেত্রী প্যাট্রিসিয়া ও’গ্র্যাডি। থাকতেন মানে বেশি আগের কথা নয়। না, কোনো মুদ্রণ প্রমাদ নয়। সত্যিই তাই। প্যাট্রিসিয়াকে ভীষণ ভাগ্যবতী বলতে হবে। নগরের অন্যতম কাঙ্ক্ষিত এলাকা গ্রিনউইচ ভিলেজের এক চারতলা বাড়িতে দুই রুমের একটি বাসা মাসিক ২৮ ডলার ৪৩ সেন্ট ভাড়ায় থাকতেন তিনি।
প্যাট্রিসিয়া নিউইয়র্কে এসেছিলেন ১৯৫৫ সালে। সঙ্গে ছিলেন আরও তিন বান্ধবী। স্বপ্ন অভিনেত্রী হবেন। স্বপ্নটি সত্যিও হয়েছিল। বেশ কয়েকটি টিভি ধারাবাহিক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। সেই সময় গ্রিনউইচ ভিলেজের এই চারতলা ভবনটিতে ঘাঁটি গাড়েন তাঁরা। আধা বাণিজ্যিক এই ভবনের চতুর্থ তলায় দুই কক্ষের একটি ছিমছাম বাসা ভাড়া নেন মাসে ১৬ ডলারে। বছর চলে যায়, চলে যান তাঁর বন্ধুরাও। থেকে যান শুধু প্যাট্রিসিয়া। প্রায় ৬০ বছর পেরিয়ে গেলেও ওই অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়ায় তেমন কোনো উল্লম্ফন হয়নি। সর্বশেষ গত মার্চেও তিনি বাসা ভাড়া বাবদ ২৮ ডলার ৪৩ সেন্ট পরিশোধ করেছেন। তারপর আর করতে হচ্ছে না।
মার্চের একদিন প্যাট্রিসিয়া ও’গ্র্যাডি বেরিয়েছিলেন হাঁটতে। বাসার সামনেই হাঁটার সময় এক গাড়ি দুর্ঘটনায় ৮৪ বছর বয়সে মারা যান এই অভিনেত্রী। প্যাট্রিসিয়ার এই মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তাঁর বাসার অবিশ্বাস্য ভাড়ার বিষয়টি প্রথম সামনে আসে।
এ বিষয়ে আবাসন ব্যবসায়ী ও ম্যানহাটন বিশেষজ্ঞ গ্যারি নুরেনবার্গ সিএনএনকে বলেন, ‘আমি এ সম্পর্কিত নথি দেখতে চাই। এটা এক কথায় অসম্ভব। কিছুদিন আগেই আমি এই ধরনের একটি বাসা মাসিক পাঁচ হাজার ডলারে ভাড়া করেছি। বেডরুমের আকারের ওপর নির্ভর করে ওই এলাকায় এ ধরনের বাসা ভাড়া এমনকি সাত হাজার ডলার পর্যন্ত হতে পারে।’
প্যাট্রিসিয়ার সর্বশেষ বাড়িওয়ালা ছিলেন অ্যাডাম পোমরেনাৎজ। ২০০২ সালে তিনি ওই বাড়িটি কেনেন। সে সময় এক ভাড়াটিয়ার এত কম ভাড়া দেওয়ার তথ্য পেয়ে পোমরেনাৎজ বেশ অবাক হয়েছিলেন বলে জানান সিএনএনকে। বাড়িটির এর আগের মালিক ততদিনে মারা গেছেন। এ বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে আবাসন কর্তৃপক্ষ তাঁকে জানায়, আগের মালিক ও প্যাট্রিসিয়া খুব ভালো বন্ধু ছিলেন। এবং এই বন্ধুত্বের কারণেই তিনি প্যাট্রিসিয়ার বাসা ভাড়া কখনো বাড়াননি। আর পোমরেনাৎজ যখন বাড়িটি কেনেন, তখন প্যাট্রিসিয়া মাসে ২৬ ডলার ৪৫ সেন্ট করে ভাড়া দিচ্ছিলেন।
পরে পোমরেনাৎজ এ বিষয়ে তাঁর আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেন। উদ্দেশ্য বাসা ভাড়া বাড়াতে কোনো বাধা আছে কিনা, তা জানা। তাঁর আইনজীবী তাঁকে জানান, এ ক্ষেত্রে আইনি কিছু বাধা আছে। স্থিতিশীল ভাড়া আইন এ ক্ষেত্রে বাধা। তবে বাড়াতে চাইলে পোমরেনাৎজ প্যাট্রিসিয়ার মাসিক ভাড়া ১ ডলার ৯৮ সেন্ট বাড়াতে পারেন।
এ অবস্থায় পোমরেনাৎজ প্যাট্রিসিয়াকে বাসা ছাড়ার অনুরোধ করলে, তিনি জানান, ‘না আমি বাসা ছাড়ব না। এ বিষয়ে দয়া করে আর কখনো কথা বলবেন না।’
এরপর পোমরেনাৎজ এ নিয়ে প্যাট্রিসিয়ার সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। তবে প্রথমবার আইনজীবীর পরামর্শ মতো ১ ডলার ৯৮ সেন্ট ভাড়া বাড়িয়েছিলেন। এর পর প্রতি বছর এই হারে ভাড়া বাড়ানোর সুযোগ থাকলেও পোমরেনাৎজ আর তা করেননি। কারণ তত দিনে পোমরেনাৎজ ও প্যাট্রিসিয়া ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন।

প্যাট্রিসিয়া ও’গ্র্যাডি
প্যাট্রিসিয়া ও’গ্র্যাডি

পোমরেনাৎজের ভাষ্য, ‘খুবই দয়ালু নারী ছিলেন প্যাট্রিসিয়া। তিনি ছিলেন দারুণ এক ভাড়াটে। তাঁর বাসাটি খুব একটা গোছানো নয়। এ নিয়ে অস্বস্তি ছিল তাঁর। আর অস্বস্তি ছিল, কম ভাড়া দেওয়ার কারণে।’
এ সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, প্যাট্রিসিয়া অভিনয়শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে নিউইয়র্কে এসেছিলেন। সেটা সত্যও হয়েছিল। অফ-ব্রডওয়ের মঞ্চে তিনি ৫০ বছরের বেশি সময় কাজ করেছেন। বহু টিভি সিরিয়ালে কাজ করেছেন ছোটখাটো চরিত্রে। আর ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’, ‘নেক্সট স্টপ গ্রিনউইচ ভিলেজ’সহ কিছু চলচ্চিত্রেও সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। তবে খুব বেশি ওপরে উঠতে পারেননি তিনি। অভিনয় তাঁর নেশা ও একমাত্র পেশা হলেও এ থেকে তাঁর আয় খুব বেশি ছিল না। বেশি আয়ের তেমন প্রয়োজনও ছিল না তাঁর। বই পড়ার নেশা ছাড়া আর কোনো নেশা ছিল না তাঁর। অভিনয়ের প্রতি দরদ নিয়ে উচ্চাভিলাষহীন এক জীবন কাটিয়েছেন তিনি।
নিজের এই দারিদ্র্য কখনো কাউকে দেখতে দেননি প্যাট্রিসিয়া। এমনকি পোমরেনাৎজের সঙ্গে বন্ধুত্বের পরও তিনি তাঁকে তাঁর বাসায় ঢুকতে দেননি। নিজে সবার জন্য অবারিত হলেও, তাঁর ঘরের দরজাটি ঠিক বিপরীতভাবে ছিল বন্ধ। ২০০৫ সালে একটি দুর্ঘটনার পর বাধ্য হয়ে পোমরেনাৎজের জন্য দরজাটি খোলেন তিনি। আর তাতেই অবাক হয়ে যান পোমরেনাৎজ। দেখেন, ঘর উষ্ণ করার কোনো ব্যবস্থা নেই সেখানে। নেই কোনো গরম জলের ব্যবস্থা। পরে অনেকটা জোর করেই ওই বাসায় একটি ঘর উষ্ণ করার যন্ত্র বসিয়ে দেন তিনি। ব্যয় হয় ১২ হাজার ডলার, যা প্যাট্রিসিয়ার ৩৫ বছরের বাসা ভাড়ার সমান। কিন্তু আত্মসম্মানবোধ এতটাই বেশি ছিল যে, সেই যন্ত্র কখনো ব্যবহার করেননি প্যাট্রিসিয়া। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতি শীতে তিনি ফায়ারপ্লেস ও স্টোভ দিয়েই শীত তাড়িয়েছেন।
প্যাট্রিসিয়া চলে গেছেন। রয়ে গেছে তাঁর একমাত্র সম্পত্তি বই, যা সংখ্যায় বিপুল। এই সব সরিয়ে পোমরেনাৎজ অ্যাপার্টমেন্টটিকে সংস্কার করবেন। বাসা ভাড়াও বাড়বে নিশ্চিতভাবে। কত হবে? পোমরেনাৎজ বলেন, ‘নিদেনপক্ষে পাঁচ হাজার ডলার। তবে আমার কোনো তাড়াহুড়ো নেই। ১৬ বছর ধরে আমি ২৮ ডলার ৪৩ সেন্ট পেয়েই অভ্যস্ত।’