রমজান আসে ভ্রাতৃত্ব ও সমতার বাণী নিয়ে

সিয়াম সাধনার মাস রমজান এসেছে। এই রমজান প্রকৃত পক্ষে কবে থেকে শুরু হচ্ছে এ নিয়ে শুরুতে কিছুটা বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে উত্তর আমেরিকার মুসলিম সম্প্রদায়ে। বাংলাদেশি কমিউনিটি ছাড়া প্রায় সব মুসলমান সম্প্রদায় রোজা শুরু করেছেন ১৬ মে থেকেই। আগে বলা হচ্ছিল, ১৭ মে অথবা ১৮ মে থেকে শুরু হবে রোজা। তবে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি এলাকা থেকে চাঁদ দেখা গেছে-এই তথ্যের ভিত্তিতে আমেরিকায় রোজা শুরু হয়েছে সৌদি আরবের একদিন আগে। সেই চাঁদ দেখা তথ্য মেনে নিয়ে রোজা রাখা হবে নাকি, নিজেরা চাঁদ দেখার পর রোজা শুরু হবে এ নিয়ে দ্বিধায় কেটেছে অনেক মুসল্লির।
রোজার দিনক্ষণ নিয়ে গড় হিসেব দেখা গেলেও, এই পুরো মাসটি যে প্রবাসের মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে ব্যয় করবেন, স্রষ্টার সন্তুষ্টি লাভের পাশাপাশি নিজেদের প্রবাসে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে নতুন করে চেনাবার কাজে ব্যবহার করবেন, সে হিসেবে কোনো ঘাটতি নেই।
জ্যামাইকা-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডস সোসাইটি নামের একটি সংগঠনের উদ্যোক্তা ফকরুল ইসলাম দেলোয়ার। তিনি বলেন, ‘জ্যামাইকাতে প্রতি রমজানে কুইন্স বরো প্রেসিডেন্ট মেলিন্ডা কাটর্জ মুসলমানদের সম্মানে ইফতারের আয়োজন করেন। ওই অনুষ্ঠানে গিয়ে আমরা আমাদের নিজেদের ভ্রাতৃত্বের বাণী পৌঁছে দিতে পারি। এবারও তিনি ইফতারির দাওয়াত দিয়েছেন আমাদের। অন্য রাজনীতিবিদরাও এ কাজ করেন। এই মাসটি আমাদের জন্য অন্য সম্মান বয়ে আনে নিউইয়র্কে।
‘এর মাধ্যমে সারা বছরে আমরা আমাদের শান্তির বাণী প্রচার করার একটি সুযোগ পাই। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই, এবার আমরা হাজারো লোকের ইফতারের আয়োজন করব। যাদের সঙ্গে আমাদের ওঠাবসা তাদের নিয়ে ইফতার করতে চাই। রমজান ছাড়া এ কাজের জন্য আর ভালো সময় কখনো হয় না।’ বলছিলেন ফকরুল ইসলাম দেলোয়ার।
ব্রঙ্কসে বাংলাদেশ ব্রঙ্কস কমিউনিটি কাউন্সিল বিএসিসি নামের একটি সংগঠন এবারে চতুর্থবারের মতো আন্তঃধর্মীয় ইফতারের আয়োজন করেছে। ২১ মে জাস্টিস সোনিয়া সটোমায়ার কমিউনিটি সেন্টারে এই ইফতার অনুষ্ঠান হবে। সেখানে ব্রঙ্কস থেকে নির্বাচিত সিনেটর, কাউন্সিলম্যান এবং অন্যান্য ধর্মের মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। অনেকেই আসবেন বলে এরই মধ্যে সম্মতি দিয়েছেন।
মানবাধিকার আইনজীবী মোহাম্মদ এন মজুমদার বলেন, অনেক ভিন্ন ধর্মীরা মনে করেন, ইসলাম অনেক রক্ষণশীল ধর্ম এবং সেখানে অন্যদের প্রবেশাধিকার নেই। এই ভুল ধারণা আমরা ভাঙাতে পারি এই রমজানেই। আমরা এক সঙ্গে এক টেবিলে বসে সব ধর্ম বর্ণের মানুষেরা মিলে ইফতার করি, আর সমতার কথা পুনর্ব্যক্ত করি। এর মাধ্যমে আমরা ইসলামের সবচেয়ে উজ্জ্বল দিক ‘সকল মানুষ এক এবং অভিন্ন’ তুলে ধরার সুযোগ পাই।
একই রকম উদ্যোগ নেওয়া হয় প্রায় সব সমিতি আর সংগঠন থেকেই। এই রমজানের প্রতিটি সন্ধ্যাই হয়ে উঠে একেকটি মিলন মেলা। সেটা রাজনীতিবিদদের জন্যই হোক আর ধর্ম প্রচারকারীদের জন্যই হোক।
ইসলামিক টিভি ইউএসএ নামক একটি গণমাধ্যমের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষায় কাজ করছেন মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি জানিয়েছেন, সারা বছর প্রতিটি মসজিদে এবং অন্যান্য স্থানে অন্য ধর্মের মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কাজ করেন তিনি। ইসলামি নানা অনুষ্ঠানে ভিন্ন ধর্মের শীর্ষ স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করার কাজও করেন তিনি। এই রমজানে সব ভিন্ন ধর্মের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে, আবারও ইসলামের ভ্রাতৃত্বের বাণী প্রচার করবেন তিনি তার প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে।
‘আমি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, যারা এবারের রমজানে রাস্তায় এবং আশপাশের লোকালয়ে প্রতিদিন কয়েক শ প্যাকেট করে ইফতার বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে। দারুল উলুম নিউইয়র্ক নামের ওই প্রতিষ্ঠানটি ইসলামিক শিক্ষা প্রসারে কাজ করছে। এই একই সঙ্গে জ্যামাইকায় ভিন্ন ভিন্ন কমিউনিটির মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন জোরালো করতে এই মাসটি তারা বেছে নেয়, কিছু আলাদা কাজের জন্য। খাদ্য বিতরণ, মসজিদে আন্তঃধর্মীয় কাউন্সেলিং এগুলো বাড়িয়ে দেন তারা। সেই কাজে সম্পৃক্ত থেকেই শান্তির বাণী প্রচার করার সুযোগ নেব আমি’-বলছিলেন দারুল উলুম এর গণসংযোগ কর্মী ও ইসলামিক টিভির প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।

রোজা শুরু নিয়ে অসন্তুষ্টি
এদিকে, হঠাৎ করেই ১৬ মে থেকে রোজা চলে আসার ঘোষণায় বেশ অস্বস্তিতে পড়েছিলেন মুসল্লিরা। নিউইয়র্ক ঈদগাহর ঘোষণা অনুযায়ী ১৫ মে, গভীর রাতে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে চাঁদ দেখার একটি নির্ভরযোগ্য সংবাদ পাওয়া গিয়েছিল। সে কারণে, উত্তর আমেরিকায় ১৬ মে প্রথম রমজান বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। এমনকি, যারা রোজা রাখেননি, তাদের তাৎক্ষণিক সময় বেঁধে দিয়েই পানাহার বন্ধ এবং বাকি দিন রোজা রেখে কাটানোর পরামর্শ দেওয়া হয়।
কিন্তু সেদিনই আবার ক্যালিফোর্নিয়া থেকে চাঁদ দেখার সংবাদটি নির্ভরযোগ্য নয় বলে দাবি করে ইউনাইটেড ইমাম অ্যান্ড উলামা কাউন্সিল ইউএসএ নেতৃবৃন্দ বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ১৭ মে থেকেই পবিত্র রমজান শুরু হবে। এসব দোটানায় অনেকেই রোজা রেখেছেন, আবার অনেকেই ১৭ মের জন্য অপেক্ষা করেছেন। এ নিয়ে প্রবাসীদের অস্বস্তি লক্ষ্য করা গেছে।
কানাডা প্রবাসী সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর লিখেছেন, ‘রোজা তো এক ধর্মেরই বিধান। তা হলে ভিন্ন ভিন্ন দিনে রোজা শুরু করতে হবে কেন? ধর্মের এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে মুসলমানরা ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেন না কেন?’
নিউইয়র্ক প্রবাসী চিকিৎসক সজল আশফাক লিখেছেন, ‘আমেরিকায় কোনো কোনো ঘরে ১৬ মে রোজা, কোনো কোনো ঘরে ১৭ মে থেকে রোজা। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই রোজা ও ঈদ, কোরবানির দিন পালন নিয়ে বিভ্রান্তি প্রচলিত আছে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি এই বিভ্রান্তি। বিজ্ঞান এখন অনেক এগিয়েছে। যতটুকু জানি চাঁদের অবস্থান জানা এখন আর কঠিন কিছু নয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত ইসলামিক কোনো প্রতিষ্ঠান পেলাম না যারা সারা বিশ্বে এই বিষয়টির একটা স্থায়ী সমাধান দিতে পারে। এরা সবাই নিজেদের নিয়ে ওয়াজে ব্যস্ত। অথচ গুগলে বেশ কিছু ওয়েব সাইট আছে যেখানে চাঁদের অবস্থান নিয়ে অনেক তথ্য থাকে। এগুলো নিয়ে কি কেউ কাজ করছেন? সবাই শুধু হারাম, হালাল নিয়ে ব্যস্ত। সর্বজন গ্রহণযোগ্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে একটা ঘোষণা দেখলাম না। এটি কি একধরনের পশ্চাৎপদতা নয়?