ট্রাম্প-কিম শীর্ষ বৈঠক হবে কি হবে না

ডোনাল্ড ট্রাম্প
ডোনাল্ড ট্রাম্প

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের ভয়ের কিছু নেই, যুক্তরাষ্ট্র তাঁর ‘নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করবে। বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসে তিনি সাংবাদিকদের জানান, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি সম্পাদিত হলে কিমের প্রশাসন সুরক্ষার নিশ্চয়তা পাবে। ‘তিনি (অর্থাৎ কিম) খুব ভালো রকম নিরাপত্তা লাভ করবেন।’
এর এক দিন আগে উত্তর কোরিয়া শীর্ষ বৈঠক বাতিলের হুমকি দিয়েছিল। তারা জানিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে যে সামরিক মহড়া চলছে, তা বাতিল না করলে কিম জং-উন শীর্ষ বৈঠকে অংশ নেবেন না। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার নিশ্চিহ্ন করার পূর্বশর্ত আরোপ করা হলে তারা বৈঠকে যাবে না, এমন কথাও পিয়ংইয়ং থেকে জানানো হয়েছিল।
একনায়ক হিসেবে সমালোচিত একজন নেতা, যিনি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজনকে হত্যায় পিছপা নন, তাঁকে ট্রাম্প যেভাবে পূর্ণ ‘নিরাপত্তা’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাতে অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। গত বছর সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রথম ভাষণে ট্রাম্প বলেছিলেন, প্রয়োজন পড়লে তিনি উত্তর কোরিয়াকে ‘সম্পূর্ণ ধ্বংস’ করতে প্রস্তুত। সেই ভাষণে তিনি উত্তর কোরিয়ার নেতাকে ‘রকেট ম্যান’ বলে উপহাস করেছিলেন। কিমের পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকির জবাবে ট্রাম্প বলেছিলেন, তাঁর পারমাণবিক বোমা কিমের বোমার চেয়ে অনেক শক্তিশালী। 

সেই কিমকে ট্রাম্প এখন কেবল নিরাপত্তার নিশ্চয়তাই দিচ্ছেন না, অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন। ‘আমরা যদি চুক্তি স্বাক্ষর করি, তাহলে আমার বিশ্বাস কিম জং-উন খুব, খুব খুশি হবেন,’ তিনি বলেন।
কেউ কেউ বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি করতে ট্রাম্প এতটা মরিয়া যে তিনি কিমকে যেকোনো প্রতিশ্রুতি দিতে প্রস্তুত। সকল বিরুদ্ধ সমালোচনা উপেক্ষা করে কিমের সঙ্গে বৈঠকের সিদ্ধান্ত তিনি একাই নিয়েছেন। নিজের এই উদ্যোগের সাফল্যে প্রীত হয়ে তিনি এরই মধ্যে নিজেকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারের যোগ্য বলে প্রকাশ্য প্রচারণা শুরু করেছেন। তবে কিছুটা বিনয়ের সঙ্গে বলেছেন, ‘আমি নই, সবাই এ কথা বলছে।’ তিনি এমন কথাও বলেছেন, নোবেল পুরস্কারের জন্য নয়, বিশ্বশান্তির জন্য এই চুক্তি চাই। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, এই পুরস্কার তাঁর বিশেষভাবে প্রয়োজন বারাক ওবামাকে টেক্কা দিতে। উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে ওবামা শান্তির জন্য নোবেল পেয়েছিলেন। রিপাবলিকান নেতারা বলা শুরু করেছেন, ওবামার তুলনায় শান্তির জন্য ট্রাম্পের অবদান অনেক বেশি। কংগ্রেসের ১৮ জন রিপাবলিকান সদস্য ইতিমধ্যে নোবেল কমিটির কাছে চিঠি লিখে ট্রাম্পের জন্য এই পুরস্কার দাবি করেছেন।
শীর্ষ বৈঠকের ব্যাপারে উত্তর কোরিয়ার দোনোমনায় হোয়াইট হাউস যে উদ্বিগ্ন, তাতে সন্দেহ নেই। পিয়ংইয়ংয়ের এই আপাত অনীহার বড় কারণ ট্রাম্পের নব নিযুক্ত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনের একটি বেফাঁস মন্তব্য। রোববার এক টিভি সাক্ষাৎকারে বোল্টন বলেছিলেন, উত্তর কোরিয়ার বি-পারমাণবিকরণ প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ‘লিবিয়ার মডেল’ অনুসরণ করবে। ২০০৩ সালে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির অধীনে লিবিয়ার একনায়ক মুয়াম্মার গাদ্দাফি নিজের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ রহিত করতে সম্মত হয়েছিলেন। সেই ঘটনার আট বছরের মাথায় ২০১১ সালে মার্কিন সমর্থিত এক গণ-অভ্যুত্থানে গাদ্দাফি নিহত হন। উত্তর কোরিয়া ধরে নিয়েছিল বোল্টন কিম জং-উনকে গাদ্দাফির পরিণতির প্রতিই ইঙ্গিত করছিলেন। উত্তর কোরিয়ার উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী কিম গি গোয়ান এক বিবৃতিতে বোল্টনের কথার প্রতিবাদ করে বলেন, এই লোকটার (অর্থাৎ বোল্টনের) ব্যাপারে আমাদের ঘৃণা কোনো গোপন ব্যাপার নয়।
ভাবা হচ্ছে, কিমকে আশ্বস্ত করতেই ট্রাম্প তাঁকে ‘নিরাপত্তার’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তবে সে কথা বলতে গিয়ে পুরো ব্যাপারটাকে তিনি আরও গুলিয়ে ফেলেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, লিবিয়া মডেল অনুসরণের কথা ভাবা হচ্ছে না। গাদ্দাফিকে আমরা সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিইনি, উল্টো তাঁর দেশকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলাম। ‘আমরা কখনো গাদ্দাফিকে বলিনি, তোমাকে নিরাপত্তা দেব, তোমাকে সামরিক প্রতিরোধ শক্তি দেব। বরং আমরা সেখানে গিয়ে তাঁকে খতম করে দিই।’
এই পর্যন্ত বলে থেমে গেলে কোনো বিতর্ক হতো না। কিন্তু নিজের অবস্থান পরিষ্কার করার জন্য ট্রাম্প কিছুটা হুমকির সুরেই বলেন, উত্তর কোরিয়া যদি শান্তিচুক্তি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আমরা ওই লিবীয় মডেলই অনুসরণ করব। উল্লেখযোগ্য, বোল্টন শুধু গাদ্দাফির সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তির কথাই বলতে চেয়েছিলেন, তাঁর চূড়ান্ত পরিণতির কথা বলেননি। কিন্তু ট্রাম্প কোনো রাখঢাক ছাড়া জানালেন, হয় চুক্তি কর, নয়তো তোমাকেও গাদ্দাফির মতো গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।
অধিকাংশ পর্যবেক্ষক একমত, পিয়ংইয়ং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে এই কথা- চালাচালি আসলে শীর্ষ বৈঠকের আগে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার লক্ষ্যে এক ধরনের কূটচাল। কিম ও ট্রাম্প উভয়েরই প্রয়োজন এই চুক্তি। মাত্র দুই মাস আগে যে উত্তর কোরীয় নেতা বিশ্বের চোখে ছিলেন যুদ্ধবাজ এক নায়ক, শান্তি প্রক্রিয়ায় সম্মতির ফলে তিনি রাতারাতি শান্তি কপোতে পরিণত হয়েছেন। অন্যদিকে, ইরান চুক্তি বাতিলের জন্য ঘরে-বাইরে সমালোচিত হওয়ার পর ট্রাম্পের প্রয়োজন একটি কূটনৈতিক বিজয়। তা ছাড়া নোবেল পুরস্কারের হাতছানি তো রয়েছেই।
এই অবস্থায় শীর্ষ বৈঠক হবে, হয়তো একটি চুক্তিও হবে। তবে এর ফলে উত্তর কোরিয়ার বি-পারমাণবিকরণ নিশ্চিত হবে কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহ রয়েছে। আটলান্টিক পত্রিকায় ভাষ্যকার ডেভিড ফ্রাম লিখেছেন, বাস্তবে যা-ই হোক, আমাদের সবাইকেই হয়তো এখন এক কাল্পনিক শান্তিচুক্তি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।