শুদ্ধতম জীবনের জন্য প্রার্থনা

মানব সেবাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মাদার তেরেসা
মানব সেবাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মাদার তেরেসা

সুন্দর ও শান্তিময় জীবন মানুষের প্রত্যাশা। স্বস্তি ও কল্যাণই মানুষের অবিরাম জীবনসাধনা! জীবনের প্রতি ভালোবাসা মানুষের স্বভাবজাত প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় সে জীবনের সৌন্দর্যবোধকে সবার ওপরে স্থান দিয়ে থাকে। একটি সফল ও সার্থক জীবন সবারই কাম্য। পৃথিবী ও প্রকৃতির কোলে জীবনের মহিমা যার যত বেশি পরিস্ফুটিত হবে, সে-ই তত বেশি একজন সফল মানুষ হিসেবে পরিচিত হবে।
অনেকে মনে করেন, জীবনটা ব্যক্তিগত ব্যাপার এবং যার যার ইচ্ছায় চলে। আসলে তা নয়। আমার মতে, এ রকম ভাবনা ঠিক নয়। জীবনকে নিয়মের মাধ্যমে চালাতে হয়। তবে নিয়মটি কী হবে (?), তা ঠিক করে নিতে হবে। এখানে দার্শনিক পিথাগোরাসের একটি উক্তি উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন, আমাদের জীবন আমাদের ইচ্ছার ওপর চলে না, জীবন মূলত আমাদের কর্মের ওপর দণ্ডায়মান। আবার বাট্রান্ড রাসেল বলেছেন, একটি ভালো জীবন বলতে যা বোঝায়, এমন জীবন যা ভালোবাসা দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং জ্ঞানের দ্বারা পরিচালিত হয়। আর রোমাঁ রোলাঁ বলেছেন, জীবনের যদি অগ্রগতি না থাকে, তাহলে সে জীবন তো অবাঞ্ছিত।
এ ক্ষেত্রে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বাণী হচ্ছে, মানুষের স্বার্থে তথা মানবতার সেবায় যিনি জীবনকে বিলিয়ে দিতে পারেন, তিনিই মহামানব। অর্থাৎ উন্নত কাজের দ্বারা একজন মহৎ মানুষের বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে। উত্তম কর্মের মধ্য দিয়েই জীবনের আসল সার্থকতা প্রকাশ পায়।
জীবন অর্থ শুদ্ধ ও নির্মল জীবন। উন্নত ও উত্তম জীবন। জীবনের সর্বোত্তম কাজগুলোর দ্বারাই মূলত জীবনের পরিশুদ্ধি আসে। অতএব আমাদের মধ্যে সে রকম শুদ্ধ জীবন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন থাকা উচিত।
উত্তম কাজ ও গুণগত বৈশিষ্ট্যের আলোকে উন্নত জীবনই সার্থক। উন্নত জীবনের জন্য সততা ও নিষ্ঠার প্রয়োজন। জীবনের অগ্রগতির মাধ্যমে মানুষের যে সব শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ পায়, তাই পৃথিবীতে অনুকরণীয় হয়ে থাকে। জীবনের উন্নতির জন্য চেষ্টা ও সাধনা থাকতে হয়। ডা. লুৎফর রহমান বলেছেন, যে ব্যক্তি মনে-প্রাণে চেষ্টা করে, তার উন্নতি হবেই।
মহামনীষীরা আপন মানুষের প্রতি ভালোবাসার কথা ও উত্তম কাজের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। কেননা, এর মধ্য দিয়ে জীবন উন্নত হয়। মহিমান্বিত হয়।
আঠারো শতকের কবি শেখ ফজলুল করিম বলেছেন, প্রীতি-প্রেমের পুণ্য-বাঁধনে যবে মিলি পরস্পরে/স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদেরই কুঁড়ে ঘরে।
জীবনকে সফল-সার্থক করে তুলতে হবে। মানুষ আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহযোগিতাও সহমর্মিতার মাধ্যমেই একজন মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ মেলে। মহান আল্লাহর চিরন্তন আহ্বানই হলো, মানুষ ও মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমেই জীবনকে সার্থক করো।
আমাদের চারপাশে অসংখ্য দুঃখী মানুষ আছে। সেই সব সহায়-সম্বলহীন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। বিশ্বনবী (সা.)-এর অমর বাণী হচ্ছে, দুঃখী মানুষ ও ক্ষুধার্তের অন্নদানই হচ্ছে সর্বোত্তম কাজ। মানুষের প্রতি মহানুভবতা প্রকাশের মাধ্যমে এবং মানবসেবায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েই তিনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে লীন হয়ে গিয়ে পরিণত হয়েছিলেন অসাধারণ মহামানবে।
মানবতার মা মাদার তেরেসা মানবসেবার মধ্য দিয়েই শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে পৃথিবীতে খ্যাতিমান হয়েছিলেন। তিনি বলেছেন To able to love the poor and know the poor we must be poor ourselves (গরিবদের ভালোবাসতে হলে ও তাদের জানতে হলে অবশ্যই আমাদের নিজেদের গরিব হতে হবে)। নিজের অহংবোধকে বর্জন করে গরিব মানুষ তথা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। ধন-সম্পদের চেয়ে এখানে মানুষের মর্যাদাই মুখ্য ও সবার ওপরে। মানুষকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই সমাজের উত্তম কাজের পরিপূর্ণতা আসে। উত্তম কাজের প্রতিদানও কিন্তু সর্বোত্তম পুরস্কার। কল্যাণের মধ্য দিয়েই শুদ্ধ জীবনের পথ তৈরি হয়।
অতএব, মাটি ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ ও ভালোবাসার মাধ্যমে সঠিক এবং সর্বোত্তম প্রতিদানের সন্ধান করতে হবে। কবি কামিনী রায়ের একটি বিখ্যাত উক্তি আছে—‘আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনি পরে/সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।’ এসব বিখ্যাত উক্তির প্রতিপাদ্য হচ্ছে মানুষ। সত্যিকার অর্থে খাঁটি মানুষ।
উল্লিখিত উদ্ধৃতিগুলোর মূলে রয়েছে শুদ্ধতম পরিপূর্ণ জীবন। জীবন শুদ্ধিকরণের ব্যবস্থা না থাকলে কিংবা তার গুণাগুণ সম্পর্কে ধারণা না থাকলে পরিশুদ্ধির পথে এগোনো যায় না। জীবনের পরিশুদ্ধি ও উৎকর্ষ সাধনের সঠিক নির্দেশনা মেনে চলতে পারলেই প্রকৃত সাফল্য আসবে।
আসল ব্যাপার হচ্ছে মানুষের সদিচ্ছাবোধ ও আন্তরিকতা। মনের ইচ্ছা না থাকলে শত চেষ্টা করেও উত্তম কাজটি করা সম্ভব নয়। পৃথিবীতে মানবকল্যাণের যত রকম বিধি-ব্যবস্থা আছে, সে সব পালন করেই মূলত শুদ্ধ জীবনের দিকে মানুষকে এগোতে হয়। পৃথিবীতে মানবধর্মের উৎকর্ষমূলক সে সব বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
শুদ্ধ জীবন প্রতিষ্ঠার জন্য যত রকম ধর্মের বিধি আছে তার মধ্যে ইসলাম ধর্মের বিধি-বিধান তাৎপর্যপূর্ণ। জীবনকে নির্মল ও বিশুদ্ধকরণের জন্য ইসলামের একটি অত্যাবশ্যকীয় বিধান হচ্ছে সিয়াম (রোজা)। পবিত্র রমজানের মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে জীবনকে সর্বতোভাবে পরিশুদ্ধ করার ব্যবস্থা আছে।
সিয়াম (রোজা) ইসলামের একটি অত্যাবশ্যকীয় নির্দেশনা, যার মাধ্যমে একজন মুসলমান প্রকৃত শুদ্ধতা ও নির্মল জীবনের সন্ধান পেয়ে থাকেন। একজন সত্যিকার মানুষের নির্মল ও বিশুদ্ধ জীবনের জন্য রোজা পালন একটা কার্যকরী ভূমিকা রাখে। রোজার মধ্য দিয়ে সমাজের অসহায়, হত-দরিদ্র ক্ষুধার্ত ও দুঃখী মানুষের কষ্টটা কেমন তা অনুভবের শিক্ষা পাওয়া যায়। রোজা পালনের মধ্য দিয়ে নিরন্ন মানুষের সেবায় নিজেকে সম্পৃক্ত করার প্রেরণা পাওয়া যায়। কাম, ক্রোধ, হিংসা-বিদ্বেষসহ সব ধরনের অনাচারী কর্ম থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার শিক্ষা পাওয়া যায়। আমি সবার চেয়ে বড়—এমন উগ্রচণ্ডী মানসিকতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বীয় অহংবোধের বিলোপ ঘটিয়ে একটি সুশৃঙ্খল, সুন্দর স্বাভাবিক জীবনের সন্ধান পাওয়া যায়। ধৈর্য হচ্ছে মহত্ত্বের একটি বড় গুণ। মানুষকে উন্নতির শিখরে ওঠার ব্যবস্থা। রোজার মাধ্যমে সেটি ভালোভাবে করা অর্জন করা যায়।
জীবনের প্রতি মায়া থাকলে অবশ্যই নিজের জীবনকে এবং অন্যকে ভালোবাসতে হবে। জীবনকে সঠিক ও সুন্দরভাবে পরিচালিত করতে হবে। ফ্রাঙ্কলিন বলেছেন, জীবনকে যদি ভালোবাসো তাহলে সময়ের অপচয় করো না। কারণ জীবনটা সময়ের সমষ্টি দ্বারা সৃষ্ট। এন ওস্ত্রোভস্কি বলেছেন, মানুষের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে তার জীবন এবং জীবন তাকে একবারই ধারণ করতে দেওয়া হয়। তাই তাকে এমনভাবে বাঁচতে হবে, যেন বছরের পর বছর অনর্থক কষ্ট ভোগ করতে না হয়। যেন মৃত্যুর সময় তাকে অনুতাপ করতে না হয়।
অতএব আমাদের প্রার্থনা শুদ্ধতম জীবন। সুন্দর ও উন্নত জীবন।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।