সব সম্পর্কই ফাঁকা!

প্রথম যখন আমেরিকায় আসি আমার ধারণা ছিল, এ দেশের সবাই একেবারে প্রাণহীন। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলে না, কেউ কারও সঙ্গে মেশে না—সব যেন কেমন মেকি!
আমার পাশে ফ্ল্যাটে ছিলেন অস্ট্রেলীয় এক বয়স্ক মহিলা। একদিন অনেক গল্পের পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কি করো তুমি? বললাম কিছুই না। আমার কথা শুনে ভদ্র মহিলা খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। এতটুকুন বাচ্চা মেয়ে, স্কুলে যাও না। সারা দিন বোনের শিশু দেখাশোনা করছ, শুধু এসব করলেই হবে? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বোন কে? আমার মেয়েকে দেখিয়ে বললেন, ও তোমার বোন না? আমি হেসে বললাম, না এটা আমার মেয়ে।
বৃদ্ধা কিছুটা শক্‌ড হয়ে বললেন, তুমি নিজেই বাচ্চা! তোমার আবার কিসের বাচ্চা! আমি মিষ্টি হেসে সেদিন তাঁকে এড়িয়ে যাই। কিন্তু তিনি এড়াননি। উল্টো তিনি আমার পেছনে লেগে গেলেন। পাশাপাশি অ্যাপার্টমেন্টে হওয়ার কারণে তিনি চোখ রাখতেন, আমার ঘরে কে কখন আসে যায়। অপেক্ষায় থাকতেন ঘর থেকে কখন বের হবেন আমার স্বামী। ভদ্র মহিলাকে নিয়ে আমি রীতিমতো মহা মুসিবতে পড়ে যাই। তিনি আমার পেছনে লেগে পড়লেন কীভাবে আমাকে স্কুলে পাঠাবেন।
আমি তাঁকে বললাম, স্কুলে গিয়ে কি করব? তার চেয়ে বরং আমি ইংরেজি ভাষা শিখব; শিখে কাজ করব। যে কথা সেই কাজ। অনেক আগ্রহ নিয়ে তিনি আমাকে লাইব্রেরিতে নিয়ে গেলেন। ভর্তিও করে এলেন। বাসায় ফেরার পথে মন খারাপ করে বললাম, ক্লাসে তো ভর্তি করলে কিন্তু ছোট্ট মেয়েকে বাসায় ফেলে যাব কি করে? বললেন, মেয়ে আমার কাছে থাকবে। সেদিনের পর পুরো তিন মাস আমার মেয়েকে তিনি রেখেছিলেন। তাঁর কাছে মেয়ে দিয়ে আমি দিব্যি ইএসএল ক্লাস করেছিলাম।
তিন মাস ক্লাস শেষ করে ভদ্র মহিলাকে কিছু টাকা দিতে চাইলে তিনি নিতে চাইলেন না। বরং খুব কষ্ট পেয়ে বললেন, আজ থেকে আঠারো বছর আগে আমি আমার ছোট মেয়েকে তার বায়োলজিকাল বাবার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় ফেলে এসেছি। কাগজপত্র না থাকার কারণে আমি এখনো অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যেতে পারিনি। আমার মেয়েটি যদি আজ আমার সঙ্গে থাকত হয়তো তার জন্যও আমার এতটুকু দায়িত্ব পালন করতে হতো। আমার সন্তান হলে তুমি কি আমাকে টাকা সাধতে পারতে? আমি লজ্জা পেয়ে যাই। সেদিন সেই বৃদ্ধা মায়ের মমতার কাছে হেরে যাই।
চাঁদকে আড়াল করে ভেসে যায় সাদা কালো মেঘ। সুখের পাখিরাও সব উড়ে চলে যায়। দিন শেষে আকাশের গায়ে চাঁদ যেমন পিছলে যায় ঠিক তেমনি তিনিও একদিন কাউকে না জানিয়ে চলে গেলেন। একদিন সকালে তাঁর ঘরে নক করলে বিল্ডিং সুপার জানায় কাগজপত্র না থাকায় তাঁকে না বলেই চলে যেতে হয়েছে। আর খবরটা আমাকে যেন সে জানায়, সে কথাও তিনি বলে গেছেন। নিজেকে না সামলাতে পেরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম সেদিন। জীবনস্রোতের দিকে হা হয়ে তাকিয়ে ভাবছিলাম—সাঙ্গ হলো খেলা, ওলো সই, এবার যে যার বাড়ি ফেরার পালা।
সন্ধ্যা নেমেছে। আমার লিভিং রুমের জানালার পাশে বসে আছি। হঠাৎ পাশের বাসার জানালায় চোখ পড়তেই মনে পড়ল সেই বুড়ো মাকে। কেন যেন তাঁর কথা মনে পড়ল; হয়তো তিনিও আমাকে মনে করছেন কোথাও বসে! চোখ বন্ধ করে তাঁকে খোঁজার চেষ্টা করছি! না কোথাও তিনি নেই! বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। সেই ঘর, সেই জানালা! তবুও আর কখনো গড়ে ওঠেনি কারও সঙ্গে সেই মধুর সম্পর্ক!
মা তুমি কোথায়! তুমি জানো তো একালের সব সম্পর্কই ফাঁকা!