রোজার সেই দিনগুলো...

প্রতীকী ছবি। প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রতীকী ছবি। প্রথম আলো ফাইল ছবি

নিউইয়র্কে রমজানের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে শবে বরাতের দিন থেকে। শবে বরাতের ইবাদত বন্দেগি একদিনে পালন করবার পর জোরেশোরে শুরু হয়ে যায় রমজানের প্রস্তুতি। পরিবারের গিন্নির সারা মাসের বাজারের তালিকা তৈরি দিয়ে প্রস্তুতির শুরু। যারা দেশে পরিবারের জন্য নিয়মিত টাকা পাঠান এই মাসে তাদের পাঠানো টাকায় আরও কিছু যোগ করতে হবে রোজার বাড়তি খরচের জন্য।
এদিকে নিজ মহল্লার মসজিদে জুমার নামাজে গিয়ে শোনা গেল ইমামের বয়ান। তিনি বলছেন, এ মাস বড়ই বরকতের মাস, ফজিলতের মাস। আল্লাহর রাস্তায় এ মাসে বেশি বেশি করে ব্যয় করলে সওয়াবও বেশি পাওয়া যাবে, যা হবে আখেরাতের একমাত্র সম্বল। সঙ্গে এও বলছেন, মসজিদ পরিচালনায় অন্য মাসের চেয়ে রমজান মাসে দ্বিগুণ খরচ। তারাবির নামাজের আলাদা ব্যবস্থাসহ প্রতিদিন মসজিদে ইফতারের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় হয়। সেসব ফজিলতের কাজে অংশ নিয়ে সওয়াব কামানোর ইচ্ছা নিজেরও হয়। তারপরও সবকিছু ছাপিয়ে মনের কোণে ভেসে উঠল দেশে থাকাকালীন রোজা রাখার সেসব দিনের কথা। কী সুন্দরই না কাটতো সেই ফেলে আসা দিনগুলো! স্বাগতম রমজানুল মোবারক, জল জোছনার শহর সুনামগঞ্জে। দেশের আরও আট-দশটি শহরের সমান চালচিত্র ছিল ছোট এই শহরে। বাজারের এক পাশে নদীর পাড়ে কসাইখানার মালিক মাহমুদ আলীর এই শহরে বাস ২/৩ যুগের বেশি কাল ধরে। কসাই মাহমুদ আলীর ব্যস্ত সময় থাকত রমজান শুরুর আগের দিনটায়। পশু নিয়ে শহরময় প্রচারের এক ফাঁকে আমাদের দোকানে এসে জেনে নিত প্রয়োজনীয় মাংসের পরিমাণ। পশু জবেহ করার সঙ্গে সঙ্গে দোকানে চলে আসত মাংসভর্তি ব্যাগ। বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্যাগভর্তি করা হতো পশুর শরীরের লোভনীয় অংশ দিয়েই।
আব্বা বাজারে গিয়ে ভালো জাতের মাছ যাকে রান্নাঘরের ভাষায় বলা হতো ‘ছুলফা ছালফা’ (কাঁটা বিহীন) নিয়ে আসতেন। এর মধ্যে থাকত বড় পাবদা, ফলি মাছসহ আইর জাতীয় মাছ। ভালো জাতের সুস্বাদু মাছ সাহরিতে ছিল একেবারে নিয়মিত। রোজার প্রথম দিন থেকে বাজারের তালিকায় আরও একটি আইটেম ছিল—চাঁপা কলা। শহরের পুরোনো জেলের উত্তরের প্রাচীর ঘেঁষে রাস্তার উত্তর পাশ বরাবর মিউনিসিপ্যাল মার্কেটের এক দোকানে বাজারের ভালো জাতের কলা বিক্রি হতো। দোকানি হাস্যোজ্জ্বল তরুণ বয়সী। মালিকের পান খাওয়া মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকত। সামনে যাওয়া মাত্র চাকু হাতে কলার কাঁদি থেকে বিশেষ কায়দায় কলা কেটে নিয়ে বলত ভাইসাব, দেড় কুড়ি ( ৩০টি) আছে। আরও কি লাগবে?
বাসায় চলছে সাহরির মূল আকর্ষণ দুধভাত খাওয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি। দিনভর জ্বাল দেওয়া দুধের ওপর জমা দুধের সর বড় কাঁসার বাটিতে নিয়ে আম্মা ফ্রিজে রেখে দিতেন। বাসায় নিজস্ব গোয়াল ঘরে পালিত হতো সব সময় দুটি গাই গরু, শুধু নির্ভেজাল খাঁটি দুধ খাওয়ার জন্য। দুধ দিয়ে কালো রঙের মাটির পাতিলে বসানো হতো সাদা দই। রমজান শুরুর রাতে প্রথম তারাবির নামাজ আদায় হতো ঘটা করে। সন্ধ্যায় গোসল সেরে নতুন পাঞ্জাবি পরে তারাবির নামাজে যাওয়ার একটি অলিখিত চল ছিল। প্রয়াত এক বন্ধু বলত, প্রথম দিন আর শেষ দিন তারাবির নামাজ আদায় করে পুরো মাসের নামাজকে আটকে ফেলতে পারলা তো আর কোনো সমস্যা নেই! বলত ঠিকই কিন্তু সে নিয়মিত পুরো মাসের সব কটি তারাবির নামাজ আদায় করত, সঙ্গে আমরাও। এটা এমনিতে বলা হতো আড্ডার ছলে। নামাজের পর ঘণ্টাখানেক আড্ডা হতো আমার দোকানে। রাতে বাসায় গিয়ে দেখতাম আব্বা-আম্মা সবাই ঘুমে। আমার ঘুম না আসাতে সেই সময়ের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন বিচিত্রা, রোববার বা সচিত্র সন্ধানী নিয়ে বিছানায় যেতাম। রাতের জেগে থাকা সময়টুকুতে চলতো সেই সব ম্যাগাজিনে চোখ বোলানো।
সাহরি শুরুর প্রথমে ঘুম থেকে উঠত করিম নামের আমাদের কাজের ছেলেটা। ওর প্রথম কাজ সন্ধ্যায় রান্না করে রাখা তরকারি চুলায় গরমে বসানো। সঙ্গে আব্বা-আম্মার জন্য চায়ের আয়োজন। সবাই উঠে গেলে দেখতাম আব্বা-আম্মা দুজনেই চা পান করে পান চিবুচ্ছেন। করিম খাবার টেবিল খাবার সাজিয়ে ডাক দিত। আব্বা-আম্মা কুলি করে হাত মুখ ধুয়ে খাবার টেবিলে যোগ দিতেন। রাতের খাবারে মাছ মাংস দিয়ে খেয়ে সাহরির বিশেষ আইটেম দুধ-ভাতের পর্ব শুরু। আম্মা কাঁসার বাটিতে জমিয়ে রাখা দুধের সর সমানভাবে ভাগ করে দিতেন। সেই সর দেওয়া ভাতে সাদা দই ও দুধ নিয়ে নেওয়া হতো চাঁপা কলা। সব মাখিয়ে আয়েশে চলতো খাওয়া-দাওয়া। যেন রাজকীয় ভোগ। মফস্বল শহর কিংবা গ্রাম অঞ্চলে তা ছিল সাহরির বিশেষ খাবার। আল্লাহর নিয়ামতরূপী এই বিশেষ খাবার খাওয়ার সৌভাগ্য প্রতি বছর পেতাম।
তবে ডাক্তারের নির্দেশে এখন সেই নিয়ামত খাওয়া নিষেধ। আল্লাহ সেই বরকত তুলে নিয়েছেন। তবে অনুতাপ করি না। কারণ আল্লাহের অপরিসীম বরকতে সারা জীবনই ছিল সুখে পরিপূর্ণ ।
ইফতারের মেন্যুতে থাকত পিঁয়াজি, ছোলা ভাজাসহ ফল ও মিষ্টি জাতীয় নানান পদ। ইফতার শুরু হতো ল্যাটকা খিচুড়ি দিয়ে। ঘরে তোলা খাঁটি ঘি দিয়ে তৈরি খিচুড়িতে প্রচুর ঘি থাকত। খুবই তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়ার প্রচলন ছিল প্রতিদিন। অনেক আইটেমের সঙ্গে আম্মার হাতে বানানো বিশেষ একটি পদ। বেশি করে মিষ্টি নারিকেল ভেতরে দিয়ে লম্বাটে এক ধরনের পিঠা বানাতেন তিনি, যার শুদ্ধ নাম সম্ভবত পুলী। আমরা ডাকতাম পব। লাল করে ভেজে চিনির সিরা লাগিয়ে রাখা হতো। মচমচে এই পব নামের পিঠার স্বাদ আজও আমি দেশ-বিদেশে খুঁজে ফিরি। ইফতার করে মাগরিবের নামাজ আদায় করে চলতো হালকা ভাতের পর্ব। ২/৩ পদের মধ্যে পোড়া ভেটকি মাছের সঙ্গে তাজা ধনেপাতা মিশিয়ে মাছের চাটনি। ছোট মাছের ঝাল চরচরি। নয়তো শোল বা গজার মাছের ঝুরি টাইপের মাছ ভুনা। খাবার শেষ করে অপেক্ষা বাসার কাজের ছেলে করিমের। তারাবির নামাজে যাওয়ার আগে করিমের হাতের বানানো ঘন দুধের চায়ের কাপের থালা আব্বার বিছানার পাশের টেবিলে রাখা হতো সবার জন্য। ৬ বছর বয়স হতে আম্মার স্নেহে লালিত শহরতলিতে জন্ম নেওয়া এক ছাতামিস্ত্রির পাঁচ সন্তানের এক সন্তান করিমের ডাক ‘সব আউক্কা, চা বানাইয়া লইয়া আইছি।’ (সবাই আসেন। চা বানিয়ে এনেছি) তাজা চা পাতার সুগন্ধে লালচে হলুদ রঙের চায়ের কাপ হাতে নিয়ে দেখতাম।
আম্মার সামনে বড় আকারের পানের থালায় সবুজ রশিদপুরী পানের উঁচু ভাঁজ। পাশে চৌকোনা করে কাটা কাঁচা সুপারি ভর্তি পিতলের চকচকে মাঝারি আকারের বাটি। পাশে কম করে হলেও ২/৩ জাতের সুগন্ধি জর্দার বাহারি কৌটা। প্রথমে আব্বা তারপর আমরা যখন তারাবির নামাজের নিয়তে স্থানীয় টাউন জামে মসজিদের দিকে রওনা দিতাম তখন শুনতাম আম্মা বাসায় বোনদের নামাজ পড়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন। উঁচু স্বরে ডাকছেন, কোথায় তোমরা? অজু করে তাড়াতাড়ি তারাবির নামাজ আদায় করতে তৈয়ার হও। নামাজের পর্ব শেষ কর! রহমতের মাসে বরকতের মাসে আল্লাহর কাছে মাফ চাও, দোয়া চাও, তওবা করো। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা দয়ালু ও ক্ষমাশীল।