মানুষ-সম্পদ কে কাকে কিনে!

নিউইয়র্ক শহরে বসবাসরত ইতালীয় বংশোদ্ভূত পিটার কোলের সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় ১৭ বছর আগে। হাড় কাঁপানো শীত, চামড়া ঝলসে পড়া গরম, বৃষ্টি, তুষারপাত—যাই হোক না কেন পিটারকে সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত নিয়মিত রাস্তায় দেখা যেত। অনুসন্ধিৎসু মনে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, আমি যে অ্যাভিনিউতে কাজ করি পিটার সেই পুরো অ্যাভিনিউর মালিক।
সম্পদের প্রলোভনে নেশাগ্রস্ত পিটারকে তাঁর সম্পদের দেখাশোনা করার জন্যই রাতদিন রাস্তায়, ঘরের বাইরে পড়ে থাকতে হয়। বাড়িভাড়া, দোকানভাড়া সংগ্রহ করা, ভাড়াটিয়াদের কোথায় কোনো সমস্যা হলো তার সমাধান করা—এসব নানাবিধ বৈষয়িক চিন্তা, কাজেই তাঁর ব্যস্ত জীবন কাটে। পিটার জীবনভর সম্পদ আহরণ করেছেন এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি—এটাই তাঁর নেশা। জগতের প্রায় সব মানুষ-ই নেশাগ্রস্ত। হরেক রকম মানুষের হরেক রকম নেশা। পিটারের ব্যাংক হিসেবে কত টাকা আছে—তাঁর নিজেরও জানা নেই।
অনেক দিন পর গত বছর পিটারকে হঠাৎ দেখলাম তাঁর বাড়ির সামনে চেয়ারে একাকী বসে আছেন। আমাকে রাস্তা পার হতে দেখে নাম ধরে কাছে ডাকলেন। কাছে যাওয়ার পর অনুরোধ করলেন, আমি যেন তাঁকে এক কাপ কফি এনে দিই পাশের দোকান থেকে। পিটার এখন আর হাঁটতে পারেন না। কথা বলে জানলাম সকাল হলেই ছেলে কিংবা নাতিপুতিরা রাস্তার ওপরে চেয়ারে বসিয়ে রেখে চলে যায়। মাঝেমধ্যে এসে দেখে যায়। নশ্বর দুনিয়ার মোহে নেশাগ্রস্ত পিটারের দুচোখের শান্ত জলের ঢেউয়ে হাহাকারের করুণ দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে খুব দ্রুত তাঁর হাতে কফি এনে দিয়ে আমি স্থান ত্যাগ করি।
গত সপ্তাহে পিটারের বউয়ের কাছে জানলাম, তিনি এখন শয্যাশায়ী। তাঁর ছেলেরা বাড়ি, দোকান সব ভাগাভাগি করে নিয়ে গেছে। ছেলে, নাতিপুতি কেউ তাঁকে দেখতেও আসে না। সবাই নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত। কারও বিন্দু পরিমাণ সময় নেই তাঁকে দেখার। মৃত্যুর পর্দা সরার অপেক্ষায় পিটারের নিঃসঙ্গ জীবন কাটছে অন্ধকার রুমের ছোট্ট কোণে।
পিটারের বিশাল সাম্রাজ্য আজ তাঁর নিয়ন্ত্রণে নেই। কিন্তু এই সাম্রাজ্যই একদিন তাঁর জীবন, যৌবন, সুখ, শান্তি, হাসি সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করেছিল পূর্ণ দাপটে। সম্পদ পিটারকে কিনে নিয়েছিল; কিন্তু তাঁর নিজের প্রয়োজনে আজ আর সম্পদকে কাজে লাগাতে পারছেন না। পিটারের শরীর আজ অসাড় হয়ে পড়লেও সম্পদের প্রতারণায় ভ্রান্ত জীবনযাপনকারী অস্থির মন তাঁকে শান্তিতে শেষ নিশ্বাসও ত্যাগ করতে দেবে না।
বেঁচে থাকার জন্য যে অর্থের দরকার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সবকিছুর সীমা থাকা প্রয়োজন। অর্থের পেছনে রাতদিন ছুটে চলা মানুষ একসময় নিজের অজান্তেই মনুষ্যত্ববোধ, মমত্ববোধ, ভালোবাসা, মমতা, স্নেহ সব হারিয়ে অমানুষ, লোভী মানুষে রূপান্তরিত হয়। এতটাই নির্বোধ হয়ে পড়ে যে, তাঁরা নিজেদের ভুলও ধরতে পারে না। সম্পদের চূড়ায় উঠতে চাওয়া নেশাগ্রস্ত মানুষগুলো দরকার (Needs) ও প্রয়োজন (Necessity)—এই দুটো জিনিসের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে না পেরে নিজের জীবন এবং তাঁর চারপাশে বসবাসকারী মানুষের জীবন অশান্তিতে ভরিয়ে তোলে।
মানুষের জীবন আর মরণের মাঝের ব্যবধানটুকু চোখের পলক ফেলার মতন। মৃত্যু কখন কোনো দরজায় কাকে নিতে আসবে কেউ জানে না। সম্পদ মানুষকে অক্টোপাসের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে মোহগ্রস্ত করে তোলে। মানুষ বোকার মতো সম্পদের পেছনে ছুটতে ছুটতে সুন্দর জীবনটাকে অর্থহীন, অযৌক্তিক জটিল করে তোলে।
সৃষ্টিকর্তা মানুষের হৃদয়ে ভালোবাসা, মমতা, স্নেহ অনুভব করার জ্ঞান দিয়েছেন। সম্পদ মানুষকে শান্তি দিতে পারে না। মানুষের প্রতি মানুষের মায়া, মমতা, স্নেহ এগুলোই জীবনে শান্তি আনে।
সম্মান ও ভালোবাসা জীবনের অমূল্য সম্পদ। মানুষ মরে যাওয়ার পর কেউ তাঁর সম্পদের দিকে তাকিয়ে তাঁকে মনে করে না। মনে রাখে তাঁর রেখে যাওয়া প্রেম, ভালোবাসা, মায়া, মমতা, সুখস্মৃতির কথা মনে করে।
সম্পদ নয়, ছোট্ট এই জীবনে প্রতিটি মানুষের উচিত নিজেদের ভালোবাসাকে আরও বেশি ভালোবাসা, ভালোলাগায় আঁকড়ে ধরা।