স্কুলের ক্যাম্পিং এবং হিরা খনন

ভ্যাংকার উইক মিডল স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী এমা রবার্ট। জুনিয়র স্কুলের শেষ বর্ষে তারা তাই সিনিয়র বা জ্যেষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত। এই জ্যেষ্ঠদের ক্যাম্প হচ্ছে নিউইয়র্ক আপস্ট্যাট ‘হারকিমের ডায়মন্ড কোয়া রিসোর্টে’। ব্যাপারটা নিয়ে সে বেশ উত্তেজিতই বলা যায়। তাদের এই ভ্রমণের সময়কাল হচ্ছে তিন দিন, সোমবার থেকে বুধবার। ক্যাম্পিংয়ের আয়োজক বিজ্ঞানের শিক্ষকেরা, এটা আমাদের শিক্ষা সফরের মতো, যার মূল উদ্দেশ্য ভ্রমণের মাধ্যমে বাচ্চাদের শেখানো। মিস্টার মিডলিন ২৫ জন শিক্ষার্থীর পুরো দলের নেতৃত্বে আছেন। অন্য শিক্ষকসহ দলে মোট সদস্য ৪০ জন।
১৪ মে ভোরবেলায় ওরা স্কুল থেকে যাত্রা করে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রিসোর্টে পৌঁছে গেল। তাদের রুমে চারজন মেয়ে ও একজন পরিণত বয়স্ক নারী শিক্ষক শাপরোন (অবিবাহিত মেয়েদের অভিবাবকের মতো দেখাশোনা করেন) আছেন। অন্য মেয়েদেরও একইভাবে দেওয়া হলো। ছেলেদের সঙ্গে পুরুষ শিক্ষক দুপুরের খাবার খেয়েই হিরের ক্রিস্টালের পাহাড়ে খননের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল।
হারকিমের জায়গাটা মূলত পাথুরে পাহাড়, তেমন উঁচু নয় কিন্তু বিস্তৃত। খনিজ দ্রব্য বিশেষ করে হিরা, ক্রিস্টাল এগুলোর জন্য বিখ্যাত। হারকিমের নিউইয়র্ক এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার মধ্যে পাওয়া যায় দ্বিগুণ কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল বা অন্য সব মূল্যবান খনিজ যার নাম ‘হারকিমের হিরা’, প্রকৃতপক্ষে সেই জায়গা আজ থেকে প্রায় ৫০ কোটি বছর আগে কোয়ার্টজ স্ফটিক ও পাথরে ভরা ছিল। মিস্টার মিডলিনের ব্যাগে হাতুড়ি থেকে শুরু করে খননের অন্যান্য সব সরঞ্জামই আছে। তাদের কাজ হচ্ছে হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙে ক্রিস্টাল বা হিরা সংগ্রহ। এই হিরা কিন্তু আসল হিরা নয়, মূলত এগুলো জুয়েলারি দুনিয়ায় এডি পাথর বা আমেরিকান ডায়মন্ড নামে পরিচিত।
প্রথম দিন খনন করে তেমন কিছু পাওয়া গেল না। শেষ বিকেলে পাথর বেয়ে নেমে এল একটা সাপ! যার নাম ইংরেজিতে গার্টার সাপ। ছোটখাটো শোরগোল শুরু হলেও মিস্টার মিডলিন আশ্বস্ত করলেন, ভয়ের কিছু নেই। এ সাপের বিষ নেই। তিনি সাপটিকে ধরলেন, হাতে তুলে নিলেন, যার ভিডিও এমা নিয়ে এসেছে। সে এবং তার বন্ধুরাও সাপটি হাতে নিয়ে ছবি তুলেছে, আমাকে সেই ভিডিও দেখাল। এমা তার মাকে এটা দেখালে তিনি রীতিমতো কেঁপে উঠেছিলেন। বাংলাদেশে সম্ভবত এগুলো দোড়া সাপ নামে পরিচিত। অবশেষে সাপটিকে ছেড়ে দেওয়া হলো; কারণ প্রাণী সংহারের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। এমার ভাষায়, ‘লেট ইট গো’। বোঝা গেল এটি একটি মডেল সাপ, এসেছিল ফটো ও ভিডিও সেশনের জন্য।
রাতে ফিরে সবাই পরিচ্ছন্ন হয়ে খাবার খেয়ে যার যার রুমে ঘুমিয়ে পড়ল। এমাদের কক্ষে এক বিছানায় সুপারভাইজার, এক বিছানায় দুটি মেয়ে, ওর এক বান্ধবী পৃথক স্লিপিং ব্যাগে মাটিতে ঘুমাল। যথেষ্ট ঠান্ডা ছিল, তাপমাত্রা ৫°ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রাথমিক অবস্থায়, তার সমস্যা হলেও এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ল। বিছানায় যারা শুয়ে ছিল তাদের নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটাল ‘বেড বাগ’। নিচের দুজন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন কিন্তু ওপরে যারা শুয়েছে তারা আতঙ্কিত। পরে ওষুধ দিয়ে পরিষ্কার করে তারা অন্য একটি কক্ষে চলে গেল। এমন হইচই রাত দুটা পর্যন্ত চলল।
পরদিন সকালে এমা সবার আগে প্রাতরাশ করল, কারণ আগের রাতে এমা থালাবাসন সব ধুয়ে পরিষ্কার করেছে, তাই এটা তার জন্য পুরস্কার। সবচেয়ে সুখের খবর, সকালে তারা ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড পেয়েছে এবং সবার মতো এমা মাকে ভিডিও কলে ও বার্তায় যোগাযোগ করেছে। রাতে পোকার আক্রমণ যাতে না হয়, সে জন্য সবকিছু লন্ড্রি মেশিনে পরিষ্কার করতে হলো।
দ্বিতীয় দিনের খননে শিক্ষার্থীরা বেশ কিছু কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল পেল এবং পেল খুব সামান্য হিরা পাথর। এই ক্রিস্টাল তাদের হোস্ট শিলার সঙ্গে খুব সামান্য লেগে থাকে। এ ধরনের দ্বিগুণ আকারের ক্রিস্টাল খুব বিরল। এই হেরিকাইমর হিরা প্রকৃতির আশ্চর্য এক সৃষ্টি। এগুলো মূলত খনিজ সংগ্রহকারীদের কাছে খুব জনপ্রিয়। এর ওপর ভিত্তি করেই এখানে আপস্ট্যাট নিউইয়র্কের বৃহত্তম জুয়েলারি দোকান, জাদুঘর, একটি জীবাশ্ম এবং রত্নপাথর পরিষ্কারক এলাকা গড়ে উঠেছে। এখানে একটি সংরক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। তারা যে সামান্য খনিজ পেল তা স্কুলের বিজ্ঞানাগারের জন্য সংরক্ষণ করা হলো।
তৃতীয় দিন সকালের নাশতা সেরে শিক্ষার্থীরা সবকিছু নিয়ে হাউই গুহার দিকে রওনা হলো। এই গুহা সমতল ভূমি থেকে দুশো ফুট পর্যন্ত গভীর। সেখানে কোনো ফোন, হইচই নিষিদ্ধ। গুহার সুড়ঙ্গপথে নামার আগে গুহা কর্তৃপক্ষ সব নিয়ম কানুন জানিয়ে দিলেন। সবকিছু শুনে এমাদের কাছে বিষয়টি বেশ ভয়ংকর এবং চাঞ্চল্যকর মনে হয়েছিল।
ভেতরের বেশির ভাগ পাথর জীবন্ত, জীবন্ত পাথর স্পর্শের কারণে বড় ধরনের ক্ষতি, ভূগর্ভে পরিবর্তন সাধিত হতে পারে। কোনো অবস্থায় তা ছোঁয়া যাবে না। গুহার ভেতরে কৃত্রিম আলো রয়েছে, যা গুহার পাথরের গায়ে পড়ে অপরূপ এক স্বপ্নপুরীর বিচ্ছুরণ তৈরি করছে। কোনো পাথর লাল, কোনোটা বেগুনি বা নীলচে বা হলুদাভ। সে এক হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য। ভেতরে দুটি বিশাল মৃত পাথর আছে, সেই দুটিতে হাত দেওয়ার অনুমতি আছে, তারা স্পর্শ করে দেখেছেও। সুড়ঙ্গ পথে যেতে যেতে এক সময় ছড়ার মতো একটা জলাশয় পাওয়া যায়। সেটি নৌকা দিয়ে সোজা পথে ঘুরে দেখা যায়। নৌকার প্রতিটি প্রান্তে তিনজন করে বসতে পারবে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই নৌকায় কোনো ইঞ্জিন বা বইঠার ব্যবস্থা নেই, দুপাশে বড় বড় দড়ি দেওয়া, দুপাশ থেকে চারজন লোক সেই দড়ি ধরে টেনে নিয়ে যান। এটা ছিল এমার কাছে বেশ লোমহর্ষক ভ্রমণ। সুড়ঙ্গপথে পানিতে সে এক অদ্ভুত দৃশ্য ।
এই গুহার পাথরে মূলত অ্যামিথেস্ট, নীলার মতো দামি দামি সব পাথরের জন্ম। ফেইরিটেল বা কল্পকাহিনীর মণিমাণিক্যপূর্ণ পাতালপুরী সম্ভবত একেই বলে। কোনো ধরনের অঘটন ছাড়া ওরা গুহার ভেতর থেকে ফিরে এসেছিল বিকেল চারটার দিকে।
এসব ভ্রমণে বাচ্চাদের এত বেশি ব্যস্ত রাখা হয় যে, এরা নিজের মতো কথা বলার সময় পায় না। খাবার তৈরির কাটা ধোয়া সব কাজ বাচ্চাদের দিয়ে করানো হয়। শেষ দিন পথে পিৎজা দিয়ে সেদিন দুপুরের খাবার শেষ করেছিল। সব খাবারই রান্না করা হয়েছিল। শিক্ষকেরা মা-বাবার মতোই লক্ষ্য রাখেন, সবাইকে একত্রে হাঁটার পরামর্শ দেন। একজন শিক্ষকও একজন মা-বাবা। এ দেশে পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য শিক্ষাব্যস্থার কারিকুলাম হিসেবে যেমন তাদের শারীরিক সম্পর্কের প্রতিরোধের ব্যাপারে শিক্ষিত করা হয়, তেমন এর খারাপ দিকগুলোও তুলে ধরা হয়। তারা এটাও বলেন, ‘নো ড্রাগস, নো অ্যালকোহল, নো সেক্স’। মূল শিক্ষাটা কিন্তু পরিবার থেকে আসে। অসংগতিগুলো দৈনিক স্বাভাবিক চালচলন থেকেই তৈরি হয়। আমার মতে পারিবারিক মূল্যবোধ এসব অসংগতির জন্য দায়ী। ভার্জিনিটি বা কুমারীত্ব যে খুব মূল্যবান, সেটা এ দেশের মেয়েরাও জানে। বিদেশিদের মধ্যেও এমন মূল্যবোধ বজায় রাখার প্রবণতা আছে।
পরিশেষ: এমার ক্যাম্পিং কাহিনি লেখার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। নিউইয়র্কে বা অন্য স্থানেও স্কুল-কলেজে ক্যাম্পিং অনেক সাধারণ ব্যাপার, তেমন কিছুই নয়। কিন্তু এ শহরে আমি অনেক বাঙালি মা-বাবা দেখেছি যারা তাদের ছেলেকে পর্যন্ত ক্যাম্পিংয়ে যেতে দেন না। তাঁরা মূলত ছেলেমেয়েদের খোলামেলা মেলামেশাকে ভয় পান। সত্যিকার অর্থে ভয় শুধু হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা নিয়ে। এমারা ফিরে আসার পর দিনই একটি স্কুল ট্রিপ বাস দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। পরদিন নেমে এল টেক্সাসে শোকের ছায়া। তাই সন্তানদের জন্য আমাদের দোয়া থাকা উচিত যেন এমন অঘটন থেকে সৃষ্টিকর্তা তাদের সুরক্ষা দেন, তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে অবরুদ্ধ করা মোটেও উচিত নয়। তাদের ছেড়ে দিন জীবনের অন্যপিঠ দেখার জন্য।