ডোন্ট ট্রাই সো হার্ড

তখন সবে মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করেছি। ছোটখাটো একটা কেরানি গোছের কাজও বাগিয়ে নিয়েছি। খুব অল্প মাইনে। এতই অল্প যে, কোনো রকম শখ-আহ্লাদ তো দূরের কথা, জীবনের প্রয়োজনীয় বস্তু অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র জোগাড় করতেই ত্রাহি দশা। থাকি কুইন্সের দরিদ্র এলাকা হিসেবে পরিচিত গ্র্যান্ড অ্যাভিনিউ আর নিলেন্ড অ্যাভিনিউর ঠিক মাঝখানের রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচ তলা পুরোনো ভবনের একটা ফ্ল্যাটে। খুব ছোট একটা ঘর। আমেরিকায় এ ধরনের ঘরকে বলে স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট। অর্থাৎ একটা মাত্র কক্ষের ভেতরেই রয়েছে একটা ছোট রান্না ঘর, খাবার-দাবারের জন্য ছোট একটা টেবিল পাতার মতো জায়গা, এক পাশে একটা ডবল ম্যাট্রেস (কারণ খাট পাতলে আমাদের রুমে আর কোনো জায়গা অবশিষ্ট থাকে না), খাটের পাশে রয়েছে একটা আলনা আর তার সামনেই একটা কাঠের ট্রলির ওপর ২৬ ইঞ্চি সাইজের একটা টিভি।
ছোট্ট ফ্ল্যাটে এই আমাদের মোটামুটি আসবাবপত্রের একটা চিত্র। আমার দুটো শখ। বই পড়ি আর সিনেমা দেখি। তাই প্রতি শুক্রবার কাজ থেকে বাসায় ফেরার পর নেটফ্লিক্সের কল্যাণে সিনেমা দেখি। এটাই আমার প্রতি সপ্তাহের রুটিন। বাসায় যেহেতু ডবল বেডের ম্যাট্রেস আছে, তাহলে আমি যে বিবাহিত সেটা মোটামুটি বোঝা যাচ্ছে। আমার স্ত্রী অর্থাৎ সাহানারও সিনেমার নেশা আছে। শুক্রবার আর শনিবার রাতে আমরা সিনেমা দেখবই। সপ্তাহে দুটো সিনেমা। মোটামুটিভাবে এই সিনেমাকে ঘিরেই আমাদের একমাত্র বিনোদন। সাহানা সম্পর্কে একটু বলি। সাহানা বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করেছে। খুব সাদামাটা কিন্তু রুচিসম্মত মেয়ে। প্রথম দেখাতেই আমার ওকে খুব ভালো লেগেছিল। সেও আমাকে পছন্দ করেছিল। কেন আমাকে পছন্দ করেছিল, তা আমি আজ পর্যন্ত আবিষ্কার করতে পারিনি। কারণ আমার না আছে তেমন টাকা-পয়সা, আর না আমি দেখতে শুনতে খুব ভালো। তবে আমি খুব রোমান্টিক ধরনের একজন পুরুষ। বেশ মনে আছে, কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় সৈয়দ মুজতবা আলীর উপন্যাস শবনম পড়ে মনে মনে সারাক্ষণ শবনমকেই খুঁজে বেড়াতাম। আগেই বলেছি, আমার আরেকটা শখ হলো সিনেমা দেখা। খাই না-খাই, সপ্তাহান্তে সিনেমা না দেখলে আমার মনটা যেন ডুকরে কেঁদে ওঠে।
যাই হোক, সাহানার সঙ্গে বিয়ে হয়ে আমার সম্ভবত খুব ভালোই হয়েছে। আমার সবকিছুই সে মেনে নিয়েছে। সব দেখেশুনে সাহানাও আমার এই পাখির বাসার মতো ছোট ঘর আর সেই সঙ্গে সব রকম দারিদ্র্যকে মেনে নিয়েছে। তারপরও আমি তাকে মাঝে মাঝেই আশার কথা শোনাই। ‘এইতো আর কয়েকটা দিন মাত্র। এবার ভালো একটা চাকরি নিশ্চয়ই পেয়ে যাব। ভালো চাকরি হওয়ার সঙ্গেই সঙ্গেই আমরা বড় একটা বাসা নেব। সেই বাসায় বড় একটা বসার ঘর থাকবে। সেই ঘরের মাঝখানে থাকবে মেরুন রঙের সুন্দর কাজ করা ইরানি কার্পেট। আর সেই কার্পেটের ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে সুন্দর নরম তুলতুলে ইতালিয়ান সোফা। সোফার ঠিক ওপরেই দেয়ালে আটকানো থাকবে ৫৬ ইঞ্চি সাইজের বিশাল স্যামসাং টিভি। রাতের খাবার পর সোফায় হেলান দিয়ে সেই টিভি পর্দায় আমরা দুজন গায়ে গা ঘেঁষে সিনেমা দেখব। তারপর একটা গাড়িও কিনব। খুব বেশি দামি গাড়ি হতে হবে না। সেই গাড়িতে চড়ে সপ্তাহান্তে আমরা টোনাটুনি লং ড্রাইভে ঘুরতে যাব।’ আহা! কতই না স্বপ্ন!
নিউইয়র্কে আমার বন্ধুবান্ধব নেহাত কম নেই। অনেকের সঙ্গেই রাস্তায় দেখা হয়। কখনো কখনো ডানকিন ডোনাট বা কোনো কফি শপে কফিতে চুমুক দিতে দিতে আড্ডাও হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কোনো বন্ধুকেই আমার বাসায় দাওয়াত দিই না। কীভাবে দেব? তাদের বাসায় ডেকে কোথায় বসতে দেব? আমার বাসায় তো কোনো সোফা নেই। বসতে হবে হয় একটা কাঠের চেয়ারে, নয়তো ছোট প্লাস্টিকের টুলে। খাবার খেতে হবে মাটিতে মাদুর বিছিয়ে। আপনিই বলুন, ওরা আমার এই ছোট বাসায় এসে বসবে কোথায়? আর বসে খাবেই বা কোথায়? আর তারাই বা আমাকে নিয়ে কী ভাববে? তারা নিশ্চয়ই বলবে ‘দাওয়াত দিয়ে অপমান করার কী দরকার ছিল!’ সে কারণে আমি নিজেও কারও বাসায় সহজে দাওয়াতে যাই না, আর কাউকে আমাদের বাসায় আসতেও বলি না। তবে সাহানা সব সময় আমাকে বলে অন্য কথা! ও আমার এই বিষয়টা মানতে রাজি নয়। তার সোজা সাপটা কথা। ‘আমাদের যাই আছে তা নিয়েই তো আমরা গর্ব করতে পারি। কত মানুষ শরণার্থী হয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের অন্তত মাথা গোঁজার একটা ছাদতো আছে! ঘরে আসবাবপত্রই কি সব কথা? আমাদের আন্তরিকতা, আতিথেয়তার কি কোনো মূল্য নেই?”
আমি সাহানার কথা শুনেও না শোনার ভান করি। আমার একটাই কথা। যখন ভালো একটা চাকরি হবে, বড় একটা বাসা নিতে পারব, তখন বন্ধুদেরকে বাড়িতে এনে হইচই করে দাওয়াত করে খাওয়াবো, আড্ডা দেব। তার আগে নয়। কিন্তু একবার আমার সেই ইস্পাত কঠিন দৃঢ় পরিকল্পনা থেকে দূরে সরতে হয়েছিল। সেই ঘটনাটা বলি। ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার সদ্য পরিচয় হয়েছিল জ্যাকসন হাইটসের কোনো এক সাহিত্য আসরে। তাঁর সঙ্গে কথা বলেই অনুমান করেছিলাম, উনি বিদ্যার সাগর। কিছুদিন পর উনার সঙ্গে আমার বেশ গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়, ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। একদিন এক বিকেলে তিনি আমাকে কল দিলেন। বললেন, ‘ভাবিসহ সন্ধ্যায় আমার বাসায় চইলা আসেন’। আমিতো আগে থেকেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যাব না। কারণ ওখানে গেলে একদিন তাদেরও আমার এই ছোট্ট খুপরির মতো বাসায় দাওয়াত করতে হবে। কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। সন্ধ্যায় তাঁর বাসায় দুটো ডাল-ভাত খেতে হবেই। আমি ফোনে কথা বলতে বলতেই সাহানা চোখ দিয়ে ইশারা করছিল, আমি যেন রাজি হয়ে যাই। তারপর কী যেন কী হলো। আমি বললাম ‘ওকে আসছি তাহলে। দেখা হবে।’
সাহানা খুব খুশি। আর খুশি কেন হবে না! সেতো সারা দিন এই ছোট ঘরেই বন্দী। বন্ধুর দেওয়া ঠিকানাটা খুঁজে পেতে অসুবিধা হলো না। ‘আর’ ট্রেনে জ্যাকসন হাইটস, তারপর এক ব্লক হাঁটলেই বাসা। কলিং বেল টিপতেই দেখি আরেকজন অপরিচিত বাঙালি দরজা খুলে দিলেন। বন্ধুটি আর তাঁর স্ত্রী দুজনেই আরেকটা রুম থেকে আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন। ঘরে ঢুকতেই টের পেয়েছিলাম, তাঁরা বাড়িটার একটা রুম ভাড়া করে থাকেন। মূল তিন বেড রুমের বাড়িটার একটা রুম ভাড়া নিয়েছেন। তার ছোট রুমে ঢুকতেই উনার স্ত্রী আমাকে আর সাহানাকে জোর করে টেনে ধরে তাদের বিছানায় বসিয়ে দিলেন। লক্ষ্য করলাম আমরা বিছানায় বসার পর তাঁরা দুজনই দাঁড়িয়ে রইলেন। কারণ তাঁদের অন্য কোথাও বসার জায়গা ছিল না। রুমের ভেতরই একটা ইলেকট্রিক চুলায় বন্ধু স্ত্রী আলুর চপ আর বেগুনি ভাজায় ব্যস্ত হয়ে গেলেন। কী আশ্চর্য! কিছুক্ষণ পর দেখি আমার স্ত্রীও সেই বেগুন ভাজায় যোগ দিয়েছেন। ঘরে তখন হালকা রবীন্দ্র সংগীত বাজছিল আর সেই সঙ্গে আমাদের আড্ডাও বেশ জমে উঠেছিল।
আমরা দুই বন্ধু তখন মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে আলুর চপ আর বেগুনিসহ সেখানেই খোশ গল্পে মেতে উঠলাম। কিছুক্ষণ পর এল রাতের খাবারের পর্ব। সেই একই রকম অবস্থা। ছোট ঘরটায় মাদুরে বসে আমরা চারটা প্রাণী কত আনন্দ আর ভালোবাসায় না রাতের খাবার খেলাম! তাঁদের আন্তরিকতা আর ভালোবাসার কাছে এই ছোটখাটো আসবাবপত্রহীন রুম কি কোনো বিষয় হতে পারে? কোনো বিষয়ই নয়। আমি মনে মনে আমার নিজের এই দৈন্যের কথা ভেবে লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। হায়! আমার সোফা দিয়ে কী হবে? বড় দালান দিয়েই বা কী হবে? যদি সেখানে ভালোবাসা না থাকে? আর আমি কিনা আমার বাসায় ভালো একটা সোফা নেই অথবা বসার ঘরে ভালো কোনো আসবাবপত্র নেই—এই লজ্জায় বাসায় কাউকে আমন্ত্রণই করি না!
অনেক রাত পর্যন্ত বন্ধু এবং বন্ধুর স্ত্রীর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আমি আর সাহানা গভীর রাতে বাড়ি দিকে পা বাড়ালাম। ওরা দুজন আমাদের সাবওয়ে পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আমাদের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করলেন। আহা সত্যি! মনের মধ্যে কী সাংঘাতিক মরচেটাই না ধরেছিল, ওদের ওখানে না এলে তা কখনো আবিষ্কারই করতে পারতাম না! তখন মনের অজান্তেই কুইনের একটা গান বারবার মনে পড়ছিল।
“If you’re searching out for something
Don’t try so hard
I you’re feeling kind of nothing
Don’t try so hard
When your problems seem like mountains
Feel the need to find some answers
You can leave it for another day
Don’t try so hard”

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)