রাজনৈতিক মেরুকরণে হারাচ্ছে পেশাগত নিরপেক্ষতা

‘নিরপেক্ষতা’ শব্দটিকে বাংলাদেশের অভিধান থেকে যেন ছেঁটে ফেলা হয়েছে। নিরপেক্ষ থাকার মৌলিক নাগরিক অধিকার আর কারও নেই। বিশেষত রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে কেউই নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না যেন। হয় এ পক্ষ নয়তো ও পক্ষের অনুসারী হতেই হবে। নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করলে বরং দু’পক্ষেরই রোষানলে পড়তে হবে; বুদ্ধিজীবীদের দৃষ্টিতে সুবিধাবাদী এমনকি ভণ্ড বলেও পরিগণিত হতে পারে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক মেরুকরণের প্রচলন স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হয়েছে। এ কথা সর্বজনবিদিত যে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে সে আন্দোলনে ও মুক্তিযুদ্ধে জামায়াত ইসলামী ব্যতীত সে সময়ের অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু স্বাধীন দেশে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায়নের কারণে বীতশ্রদ্ধ হয়ে এসব রাজনৈতিক দল মিলে আওয়ামী-বিরোধী একটি পক্ষের জন্ম দেয়, যেখানে সমাজতান্ত্রিক দল ন্যাপসহ অনেক দলই অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ আওয়ামী-বিরোধী আবেগকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদী দলের উন্মেষ ঘটে, যারা তাদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে এমনকি স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকেও পুনর্বাসন করে। এভাবেই দেশে মেরুকরণের প্রক্রিয়া চলছে। দু’পক্ষই রাজনৈতিক লড়াইয়ে টিকে থাকার প্রয়োজনে কিছু স্পর্শকাতর বিষয়কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। আওয়ামী ঘরানার অস্ত্র হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ, যারাই তাদের বিরুদ্ধাচরণ করবে তাদেরকেই রাজাকার ঘোষণা করা হবে। অন্যদিকে বিএনপি ঘরানার অস্ত্র হচ্ছে ধর্ম, যারাই বিরুদ্ধাচরণ করবে তারাই হবে নাস্তিক। আবার এ দুই মেরু আবর্তিত হচ্ছে দুই পরিবারকে কেন্দ্র করে। ফলে মেরুকরণের মূল ভিত্তি প্রকৃতপক্ষে কোনো আদর্শ নয়, বরং দু’টি পরিবারের স্বার্থের দ্বন্দ্ব।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রতিটি মানুষই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো না কোনো মতাদর্শের অনুসারী। অতএব বিশ্বাসের ভিত্তিতে কারও নিরপেক্ষ থাকা প্রায় অসম্ভব। প্রশ্ন হচ্ছে সামাজিক ও বিশেষত পেশাগত জীবনে নিরপেক্ষ থাকা নিয়ে। পেশাগত কাজে প্রয়োজন মেধা, দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠা। পেশাগত দায়িত্ব পালনে কেন রাজনৈতিক মেরুকরণ প্রভাব ফেলবে? অথচ সরকারি ও বেসরকারি সব ক্ষেত্রে নিয়োগ, পদোন্নতি থেকে শুরু করে পেশার সর্বস্তরে মেরুকরণই বর্তমানে প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি বিচার বিভাগ, পুলিশ ও সামরিক বাহিনীও এ মেরুকরণের ভয়াল প্রভাব থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। আশঙ্কার কথা হচ্ছে, এ মেরুকরণ বিস্তৃত হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও। কোমলমতি শিশুরাও রক্ষা পাচ্ছে না দু’মেরুর হানাহানি থেকে। শিক্ষা গ্রহণের সঙ্গে দেশপ্রেমের সম্পর্ক রয়েছে জানি, কিন্তু রাজনৈতিক মেরুকরণের কী সম্পর্ক?
মেরুকরণের এত বিস্তৃতির পেছনে কাজ করছে ক্ষমতার অপব্যবহার। রাজনৈতিক ক্ষমতা অত্যন্ত ভয়াবহ। কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা এমনকি রাজনৈতিক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ছাড়াই একজন শুধুমাত্র রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে রাতারাতি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যাচ্ছে। এই ক্ষমতা তাকে সম্মান, শক্তি ও অর্থ সবই দিচ্ছে। এই ক্ষমতা দিয়ে সমাজের যেকোনো ক্ষেত্রে অন্যায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে একজন নেতা। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ক্ষমতার (প্রকারান্তরে সন্ত্রাসের) দৌরাত্ম্য ছড়িয়ে দিয়েছে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে। ফলে যে যেই পেশাতেই থাকুক না কেন, অস্তিত্বের প্রয়োজনে ছুটতে হচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পেছনে। পেশাগত উৎকর্ষ সাধন তো দূরের কথা, ন্যূনতম দায়িত্ব পালনও সেখানে গৌণ হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষক শিক্ষা ও গবেষণা কর্ম ছেড়ে ছুটছেন রাজনৈতিক দলের পেছনে, চিকিৎসক সেবাদান রেখে করছেন নেতার সঙ্গে সমঝোতা, প্রকৌশলী দলের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে বিক্রি করছেন নিজের মূল্যবোধ, ব্যাংক কর্মকর্তা দলের লোকের হাতে কোটি কোটি টাকা তুলে দিচ্ছেন অন্যায়ভাবে। এ মেরুকরণ থেকে বাদ পড়েননি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক জগতের লোকজনও। সাহিত্যিক সাহিত্য আসরে প্রকাশ্যে নেতার পদলেহন করছেন। সাংস্কৃতিক কর্মী সাংস্কৃতিক পরিবেশনা বাদ দিয়ে মঞ্চে স্লোগান দিচ্ছেন। বুদ্ধিজীবীরা দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে নোংরা বিতর্ক ও নেতার তোষামোদীতে রয়েছেন নিয়োজিত; আর পর্দার পেছনে করছেন নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি।
দুঃখজনকভাবে এ মেরুকরণের প্রভাব দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রবাসেও বিস্তার লাভ করেছে। প্রবাসে জীবন ও জীবিকার কঠিন সংগ্রামে যখন প্রাণ ওষ্ঠাগত, তখন মেরুকরণের বাগ্‌বিতণ্ডা, এমনকি সংঘর্ষ পর্যন্ত হচ্ছে, যা খুবই দুঃখজনক। অন্য ভাষাভাষীরা যেখানে এক জোট হয়ে কাজ করছে নিজেদের জন্য, সমাজের জন্য, ও তাদের মাতৃভূমির জন্য, সেখানে আমরা কখনোই এক হতে পারছি না। ফলে নিজের, সমাজের এবং মাতৃভূমির কোনো উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারছি না আমরা। বিদেশের মাটিতে শুধুমাত্র অগণিত সমিতি গঠন ব্যতীত বাংলাদেশি বাঙালিদের কোনো সক্রিয় ভূমিকা দৃষ্টিগোচর হয় না। এসব সমিতির প্রতিটিতেই আবার দুই মেরুর সংঘর্ষ নিত্যদিনের ঘটনা।
কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং সমাজে ও পেশায় রাজনৈতিক মেরুকরণের ঊর্ধ্বে উঠে শুধুমাত্র দেশের প্রয়োজনে কাজ করার পক্ষে যৌক্তিক অবস্থান তুলে ধরাই এর লক্ষ্য। রাজনীতি নিজেই একটি পেশা। তাই যারা রাজনীতিতে সক্রিয় হতে চান, তারা দয়া করে বর্তমান পেশা ছেড়ে দিয়ে আপনার পছন্দের দলে যোগ দিন। এমন অনেক রাজনীতিবিদ রয়েছেন যারা চাকরি, ব্যবসা, এমনকি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড থেকে অবসর নিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন। দেশের উন্নয়নে যেমন সৎ ও নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদের প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সৎ, নিষ্ঠাবান, মেধাবী ও দক্ষ পেশাজীবী, যারা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে শুধুমাত্র দেশকে ভালোবেসে কাজ করে যাবেন। রাজনীতিকে সমাজের অন্য সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে তা দেশের জন্য কেবল অকল্যাণই বয়ে আনবে।
পরিশেষে আবারও বলছি, ‘নিরপেক্ষ’ থাকার অর্থ রাজনীতিকে বিসর্জন দেওয়া নয়, বরং রাজনৈতিক মেরুকরণের ঊর্ধ্বে থেকে শুধুমাত্র দেশকে ভালোবেসে পেশাগত দায়িত্ব পালন করা।

লেখক: অধ্যাপক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক, ফার্মিংডেল, আমেরিকা