কার জন্য হার্ভার্ড সম্মেলন!

দর্শক সারিতে ছিল মন্ত্রী উপদেষ্টাসহ সব পরিচিত মুখ
দর্শক সারিতে ছিল মন্ত্রী উপদেষ্টাসহ সব পরিচিত মুখ

১২ মে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লোব হাউসে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘বাংলাদেশ রাইজিং’ সম্মেলন। জন্মলগ্নে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আজ সেই দেশেরই সবচেয়ে অগ্রগণ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংস্থা দিনব্যাপী আলোচনা করে কাটাল বাংলাদেশের উন্নয়ন সামর্থ্য, সাফল্য আর সম্ভাবনা নিয়ে! সংগত কারণেই বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে আমার কাছে যুগপৎ কৌতূহলোদ্দীপক এবং আশা জাগানিয়া প্রসঙ্গ এটি। আরও আগ্রহের বিষয়, এমন আয়োজন কয়েক বছর ধরেই চলছে। কেবল তাই নয়, পেশাগত কারণে ব্যক্তিগতভাবে এবারের এই আয়োজনের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার সুযোগ আসছে জাানর পর সংগত কারণেই এই সম্মেলনের খবর আমার কাছে সত্যিকারের আনন্দবার্তা হয়ে দেখা দিয়েছিল। প্রত্যাশা জেগেছিল এবার আর দূর থেকে দেখা নয়, আবছায়াভাবে জানা নয়, খানিকটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারব এই রকম আয়োজনের তাৎপর্য!
ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে সাহিত্য সীমানার মানুষ। ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থার জটিল হিসাব-নিকাশের খবর সাহিত্যের আতশকাচের মধ্য দিয়েই মূলত দেখতে প্রয়াস পাই! কারও কারও মনে হতে পারে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা অর্থনীতিবিদদের মতো এসব নিয়ে মাথা না ঘামালেও হয়তো সাহিত্যিকের চলতে পারে। কিন্তু এমন একটা যুগে আর এমন একটা দেশে আমরা বাস করছি যেখানে ‘উন্নয়ন’ শব্দটির বজ্রনির্ঘোষ কানের কাছে সারাক্ষণই বাজতে থাকে। কারণ ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের সামগ্রিকতায় আন্তর্জাতিকভাবেও এই শব্দের তাৎপর্য অনুভূত হচ্ছে! ন্যূনতম সংবেদনশীলতা থাকলে এই গর্জনের ধ্বনি না শুনে উপায় নেই! এখন সাহিত্যিককে আর বিবরবাসী হলে বা খালি সংবেদনশীল হলেই চলে না, রাষ্ট্রব্যবস্থার জটিল গ্রন্থিগুলোর মধ্যেও সরাসরি অবস্থান করতে হয়!
সংগত কারণেই পেশাগত সূত্রে ‘বাংলাদেশ রাইজিং ২০১৮’-এর সম্মেলন স্বচক্ষে দেখার সুযোগকে আমি পুরো কাজে লাগাতে চেয়েছি। সেখানে গিয়েছিলাম সব সেশনেই হাজির থাকব এমন মনোভাব নিয়ে। কারণ উন্নয়ন সূত্রে বাংলাদেশের মানুষের চৈতন্যে যেসব রূপান্তর ঘটছে, তার কিছু আভাস হয়তো এই সম্মেলন থেকে পাব এমন একটা আশাও মনে জেগেছিল। ভেবেছিলাম সম্মেলনটি একদিকে বিদ্যায়তনিক, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পটভূমির বলে এর মধ্য থেকে সুদূরপ্রসারী কোনো বার্তা পাওয়া যাবে, যা আমার সাহিত্যিক সত্তায় সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করবে। এমন মনে হয়েছিল, বাংলাদেশ সম্পর্কিত আলোচনায় দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের কৌতূহলী আলোচনায় এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের অভিযাত্রীদের দূরদৃষ্টিপূর্ণ ভাষ্যে দারুণ ঋদ্ধ হয়ে ফিরে আসব। কারণ যৌথভাবে আয়োজনটি করছে ISDI (International Sustainable Development Institute), Center for International Development, The Lakshmi Mittal South Asia Instute-এর মতো হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়েরই তিনটি বিদ্যায়তনিক সংস্থা!
সারা দিন যা শুনলাম, তাতে বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে ছিল অনেক আশাবাদের কথা। বক্তারা মূলত বললেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তাঁরা আহ্বান জানালেন, বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য ভালো জায়গা। কেউ কেউ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণের ভিডিও দেখিয়ে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে প্রতীকীরূপেও উপস্থাপন করলেন। উল্লাস-ধ্বনিও শোনা গেল উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মধ্য থেকে। এ সবই এই সম্মেলনের ভালো দিক! আমাদের উৎসাহিত হওয়ার নিশ্চয়ই কারণ আছে!
সবার বক্তব্য শুনতে শুনতে, এ রকম উপস্থাপনা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল সামনে দর্শকসারিতে বসে আছেন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী সংস্থার প্রতিনিধিরা, বসে আছেন হার্ভার্ডে অধ্যয়নরত সেসব ছাত্র-ছাত্রী যাঁরা হবেন ভবিষ্যতের বিনিয়োগকারী! কিন্তু চারপাশে তাকিয়ে আমার নির্বোধ মনে এই প্রশ্ন জাগল, কোথায় তাঁরা? ঊনদৃষ্টির আমি যে কেবল দর্শকের আসনে তাঁদেরই দেখতে পাচ্ছিলাম, বাংলাদেশের উন্নয়ন বিষয়ক আলোচনায় যেসব চেনামুখ সচরাচর দেখা যায়! বিভিন্ন দেশ থেকে পড়তে আসা হার্ভার্ডের তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদের তো তেমন দেখা গেল না! এমনকি বাংলাদেশি তরুণ জ্ঞানার্থীদেরও প্রশ্ন করতে দেখা গেল না তেমন একটা। তবু ভালো যে সর্বশেষ সেশনে অনাবাসী কৌতূহলী বাংলাদেশিদের খানিকটা পাওয়া গিয়েছিল!
এ ধরনের সম্মেলনে ‘উন্নয়ন’ ধারণার সঙ্গে ‘যথার্থ রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা’ বা ‘গভর্ন্যান্স’ প্রসঙ্গটার সম্পর্ক যে ওতপ্রোত, তা বলে দেওয়ার জন্য বিশেষ জ্ঞানী হওয়া লাগে না। কিন্তু কই, এখানে তো সেভাবে ‘গভর্ন্যান্স’ প্রসঙ্গই উঠল না তেমন করে! কথা তো হলো না জ্বালানি খাতে আরও কম ব্যয়ে ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত কিনা তা নিয়ে! কিংবা আগে যা হওয়ার হয়েছে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের প্রকৃতিকে কম ধ্বংস করে উন্নয়নের রূপরেখা কী হতে পারে সে রকম কোনো বিদ্যায়তনিক প্রস্তাবনা তো কোনো বিশেষজ্ঞ বা অভিজ্ঞজন উপস্থাপন করলেন না! কেউ তো বললেন না আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যে জনশক্তি গড়ে তুলছে, তা দিয়ে উন্নয়ন স্তর ওপরে তোলা কতটা সম্ভব? এমন তথ্য-উপাত্ত তো কেউ উপস্থাপন করলেন না তৈরি পোশাক খাতে যে পরিমাণ সরকারি প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে তার বিনিময়ে আমাদের উন্নয়নে এই খাত কতটা অবদান রাখতে পেরেছে? কেউ বললেন না তো, অদক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করে বাংলাদেশ যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করছে তার তুলনায় দক্ষ জনশক্তি সংগ্রহ করার জন্য কতটা ব্যয় করছে? এত রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থাকা সত্ত্বেও অনেক বেশি মূল্য দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে আমাদের দক্ষ জনশক্তি সংগ্রহ করতে হচ্ছে কেন? দেশের বিদ্যায়তনের ডিগ্রির ওপর আস্থা রাখতে না পারলে এই বিদ্যায়তন থেকে পাওয়া জনশক্তি দিয়ে উন্নয়নের যাত্রা কতটা সুগম রাখা যাবে এই প্রশ্ন তো কেউ তুললেন না? যে কৃষি খাত আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ না করলে আমাদের জিডিপির বর্তমান হার নিয়মিত থাকতে পারত না, আমাদের উত্থানের ভবিষ্যতের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক তো খুঁজে দেখলেন না কেউ! কই, কেউ বললেন না তো, বাংলাদেশের উন্নয়নে বিদেশে গড়ে-ওঠা অভিজ্ঞ জনশক্তিকে কী করে কাজে লাগানো যায়! তেমনটাই যদি না হবে, তাহলে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশি কিছু চেনামুখের মাঝখানে এ রকম গুরুগম্ভীর আলোচনা করে কী লাভ কিছু তাৎপর্যহীন অর্থব্যয় ছাড়া!
না, এসব প্রশ্ন শোনার প্রায় কেউ নেই চারপাশে! সবাই কেবল উন্নয়ন-উদ্‌যাপনের আনন্দই উপভোগ করতে চান। কারণ এত উন্নয়ন বাংলাদেশের মানুষ আগে চোখে দেখিনি! কিন্তু এ কথাও কি মনে রাখতে হবে না, উন্নয়নানন্দ উদ্‌যাপন শেষে আমরা যখন সত্যিকারের কাজ করতে বসব, তখন এসব নিয়ে না ভাবলে আমাদের চলবে না! সেই ভাবনার সময় যা নিয়ে আমাদের নাড়াচাড়া করতে হবে, তা কোথায় পাব সেই প্রশ্নও কি উঁকি দেয় না আমাদের মনে? আমার অদূর দৃষ্ট, অবিদ্যান মন যে এর বাইরে বেশি যেতে পারল না, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নত বিদ্যায়তনিক আবহ থেকে তা কি শুধু আমার অক্ষম সাহিত্যিকতারই দোষ শুধু? এ নিয়ে বিদ্যানেরা কী ভাবেন তা জানতে ইচ্ছে করে! এ রকম জানতে চাওয়া কি কোনো অসংগত ব্যাপার? এই প্রশ্নের সঙ্গে পাঠকদের সহযাত্রী করা ঠিক হলো কিনা, পাঠকেরাই তা ঠিক করুন! হার্ভার্ডের দিনব্যাপী আলোচনায় উপস্থিত থেকে এমন প্রশ্নও মনে জেগেছে।