রাজনীতিতে বাংলাদেশিরা

বাংলাদেশে বর্ষার আগমন ধ্বনি এখনই বেজে উঠেছে। বৃষ্টি হচ্ছে হরদম। আসছে নতুন পানি। এই নতুন পানি পুরোনো স্রোতের সঙ্গে মিশে গিয়ে প্রাণসঞ্চার করবে বিদ্যমান জলাধারগুলোয়। কিন্তু যদি তা না হয়, যদি না মেশে বা মেশার সুযোগ না পায়, তবেই হয় অনর্থ; এখানে–ওখানে জলাবদ্ধতা। আর এর বিড়ম্বনা কতটা, তা রাজধানী ঢাকাবাসীমাত্রই জানে।
মানুষের জীবন প্রকৃতি থেকে আলাদা নয়। বহমান পানির মতো মানুষও গতিকে সত্য মানে। সে স্থানান্তর হয় নিজের জীবন–জীবিকার টানে। এই স্থানান্তর তাকে অভিজ্ঞতার রসদ জোগায়। নতুন দেশে নতুন আবহে সে যখন ফেলে আসা দেশের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগায়, তখনই ধরা দেয় সাফল্য। কিন্তু নতুন দেশে ফেলে আসা মাটির স্মৃতিচারণাই সার হলে কারোই কোনো লাভ হয় না। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমেরিকায় বাংলাদেশি অভিবাসীদের বড় অংশের মধ্যেই এই স্মৃতিচারণার লক্ষণ প্রবল। অভিজ্ঞতার প্রয়োগের বদলে রবিঠাকুরের অমলের মতো কল্পনা ও স্মৃতির মিশেল এক জগতে বাস করেন অধিকাংশ। এমনকি রাজনীতি করতে ইচ্ছুক অংশটিও দেশে রেখে যাওয়া দলগুলোর ইউনিট খুলে বসে, যার সূত্র ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিরোধের সঞ্চার ঘটে সেখানেও। এই বাস্তবতায় এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ড. নিনা আহমেদ।
এটা সত্য যে ১৫ মে আমাদের হয়নি। ওই দিন পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের লেফটেন্যান্ট গভর্নর পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাথমিক বাছাইয়ে জয়ী হতে পারেননি তিনি। কিন্তু নিনার এই লড়াই প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য অনেক বড় বার্তা নিয়ে এসেছে। এই লড়াই মার্কিন রাজনীতির মূল স্রোতে বাংলাদেশি-আমেরিকানদের সম্ভাবনার জানান দিচ্ছে।
মূলধারার রাজনীতিতে নিনার অবস্থান বুঝতে হলে পেনসিলভানিয়ার স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের দিকে তাকাতে হবে। ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাথমিক বাছাইয়ে জন ফাটারম্যানের বিজয়কে তারা ‘অঘটন’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। অর্থাৎ নির্বাচনে নিনার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। নিনা নিজেও জানেন, বোঝেন রাজনীতির জটিল-কঠিন হিসাব-নিকাশ। আর তা বোঝেন বলেই তিনি হাল না ছাড়ার কথা বলেছেন।
নিনা আহমেদ একা নন; রয়েছেন মিজান চৌধুরী, অ্যাটর্নি মঈন চৌধুরীর মতো মানুষেরাও, যাঁরা আমেরিকার মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশিদের উপস্থিতির জানান দিচ্ছেন জোরেশোরে। কিন্তু আমেরিকায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের সংখ্যার বিচারে এই প্রতিনিধিত্ব অনেক কম। অথচ ভারত, চীনসহ অন্য দেশগুলোর অভিবাসীরা এরই মধ্যে মার্কিন রাজনীতির মূলধারায় নিজেদের ভিত পোক্ত করে ফেলেছেন। আর এটা সম্ভব হয়েছে মূল স্রোতটিতে মিশে যাওয়ার কারণে। বিপরীতে বাংলাদেশিরা অনেকটাই যেন গুটিয়ে আছেন। নিজেদের তৈরি বৃত্তে আটকে থেকে বলছেন, ‘মূলধারা আমাদের নিচ্ছে না।’ অথচ কে না জানে, দাবি উত্থাপন না করলে কেউ কাউকে নেয় না। এ জন্য চাই নিজের এগিয়ে আসা।
‘সময় বয়ে যাচ্ছে’ কিংবা ‘সময় হয়নি’ এই অনিঃশেষ তর্কে না ঢুকে রবীন্দ্রনাথের অমলের প্রশ্নটির দিকে তাকালেই করণীয় স্পষ্ট হয়। কারণ, সত্য হচ্ছে ‘আমি ঘণ্টা বাজালেই সময় হবে।’ এই সত্যকে উপলব্ধিতে নিয়ে যত দ্রুত আমাদের অভিবাসীরা মূল স্রোতে মিশে নিজ নিজ ঘণ্টা বাজাবেন, তত দ্রুত আমরা জায়গা করে নেব মার্কিন মূলধারার রাজনীতিতে। সামনে তো রয়েছেই নিনা আহমেদ, মিজান চৌধুরী ও মঈন চৌধুরীর উদাহরণ। তাঁদের দেখানো পথ অনুসরণ করে স্মৃতির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আরও আরও বাংলাদেশি-আমেরিকান মূলধারার রাজনীতিতে সংযুক্ত হবেন—এটাই প্রত্যাশা।