অভিবাসীদের মৃত্যুকূপ গ্র্যান্ড রিভার

টেক্সাসের লারেডো সীমান্তে সর্বশেষ ১৭ মে আটজন বাংলাদেশি আটক হয়েছেন। এর আগে ২৯ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত আরও ১৫ জন আটক হন। আর গত পাঁচ মাসে আটক ব্যক্তিদের মধ্যে ২৩০ জনই বাংলাদেশি নাগরিক। অবৈধ অভিবাসীদের সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার অনেক স্থানের মধ্যে এই লারেডো সীমান্ত অন্যতম। গত বছর এই জায়গায় আটক ব্যক্তিদের মধ্যে শীর্ষে আছেন বাংলাদেশিরাই। আমেরিকার বর্ডার পেট্রল দপ্তর সূত্রে জানা গেছে এই তথ্য। কিন্তু সবাই কি দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আমেরিকার সীমান্তে আসতে পারছেন?
১১ ও ১৪ মে এই লারেডো সীমান্তের গ্র্যান্ড রিভার (স্প্যানিশ ভাষায় রিও গ্র্যান্ডে) থেকে দুই তরুণের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এরা দুজনই বাংলাদেশি। একজন নোয়াখালীর নাইমুল ইসলাম হৃদয় (২২)।ফেসবুকে সুপারম্যানের গেঞ্জি পরা একটা ছবির নিচে লিখে রেখেছিলেন, ‘আমি যদি সুপারম্যান হতে পারতাম’!

আরেকজন একই জেলার অল্প দূরত্বের শাহাদত নাঈম। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার দেউটি ইউনিয়নে বাড়ি। বয়স ১৮ পেরিয়ে ১৯-এ পা রেখেছেন মাত্র। গ্র্যান্ড নদীতে তলিয়ে যাওয়ার ১০ দিন আগে ৪ মে সর্বশেষ তাঁর একটি ছবি তিনি ফেসবুকে পোস্ট করেন, সেখানে লেখা ছিল ‘ওয়েটিং’। একটি নদী সামনে, সেই নদীর দিতে তাকিয়ে নাঈম লিখেছিলেন, ‘অপেক্ষা করছি”! সেই অপেক্ষা ছিল স্বপ্নের দেশ আমেরিকা ঢোকার। কিন্তু এর আগেই তাঁর মৃত্যুতে ভেঙে গেছে একটি পরিবারের স্বপ্ন। মেক্সিকো পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় ঢুকতে গিয়ে নদীতে ভেসে গেছে বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হৃদয়। তার লাশ পাওয়া গেছে ১৪ মে। হৃদয়ের খালাতো ভাই বোরহান উদ্দিন থাকেন ব্রুকলিনে।
বোরহান উদ্দীন বলছিলেন, ‘হৃদয়কে এভাবে আমেরিকায় না আসতে অনেকবার নিষেধ করা হয়েছে। আমি জেনেছিলাম, সে এখানে আসতে পারে। কিন্তু কোনো খোঁজখবর পাচ্ছিলাম না। পরে জানলাম, নদী থেকে তাঁর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।’
ব্রুকলিনের চার্চ ম্যাকডোনাল্ডে গত সপ্তাহে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে অন্তত চার তরুণের কথা হয়। এঁরা প্রত্যেকেই মেক্সিকো-টেক্সাস সীমান্তের রিও গ্র্যান্ড নদী পার হয়ে এ দেশে ঢুকেছেন। এখন তাঁদের কেউ ট্যাক্সি চালাচ্ছেন, কেউ মুদি দোকানে কাজ করছেন, কেউ রেস্তোরাঁর শ্রমিক, আবার কেউ এখনো কর্মহীন। এঁদের একজন জাকারিয়া বলছিলেন, ‘তিনি আমেরিকায় পাড়ি দিতে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন। ৮ মাসে বলিভিয়া হয়ে ব্রাজিল পৌঁছান। সেখানে অপেক্ষা করেছেন সাড়ে ৩ বছর। এরপর ছয়দিনের যাত্রায় ঢুকে পড়েন টেক্সাসে। পরে আটক হন পুলিশের কাছে, নিজেকে শরণার্থী ঘোষণা করেন, এখন বৈধ কাগজপত্র পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন।
জাকারিয়া বলেন, ‘নদী-যাত্রার সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতা হয়েছিল আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে পানামা ঢোকার সময়ে। সে সময় ছোট লম্বা একটি নৌকায় বড় স্পিডবোর্ড ইঞ্জিন লাগানো ছিল। সাগরে জোয়ারের পানির ধাক্কায় নৌকাটি ফেটে যায়। আমি মৃত্যুর প্রহর গুনছিলাম। ভাবিনি জীবিত অবস্থায় ওপারে আসতে পারব। কিন্তু অলৌকিকভাবে আমি এখনো জীবিত।’
আরেকজন মাসুদ হোসেন (ছদ্মনাম) পাশ থেকে বলে ওঠেন, ‘আমি সে সময় চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম। সামনে কি ঘটছে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। কারণ সেটি দেখার মত সাহস আমার ছিল না। আমি একটু গরু মেনেছিলাম। আমার জীবন বাঁচলে আল্লাহর নামে আমি আরেকটি জীবন কোরবানি দেব।
কবির আহমেদ (ছদ্মনাম) নামের আরেকজন পাশে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন এঁদের কথা। পাশ থেকে একটু বড় দম নিয়ে বলে ওঠেন, ‘আমিও একইভাবে এসেছি। আমি রিও নদী একাই পার হয়েছি। আপনারা তো একটি গ্রুপে এসেছেন। আমি ভেবেছিলাম মারা যাব, হয়তো আর বাবা মাকে দেখতে পাব না।’
জাকারিয়া বলেন, ওই সময় তাঁদের ২৭ জনের একটি দল এক সঙ্গে ঢুকে পড়ে নদীতে। প্রকৃত পক্ষে দলে ছিলেন ২৮ জন। একজন পানামার একটি পাহাড়ে ওঠার পর পথে মারা যান। তাঁকে রেখেই দালাল বাকিদের নিয়ে সামনে এগোতে থাকেন। সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার কাজ চলতে রাতে। কয়েকটি জঙ্গল পাড়ি দিতে হয়েছে, যেখানে পদে পদে মৃত্যুর ভয় ছিল। এরপর ছিল খরস্রোতা রিও গ্র্যান্ড রিভার যা আমেরিকায় ঢোকার শেষ ধাপ।
রিও গ্র্যান্ড নদী মৃত্যু উপত্যকা?
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, রিও গ্র্যান্ড নদী দক্ষিণ আমেরিকা অভিবাসীদের আমেরিকায় শেষ বাঁধা। গন্তব্য নাগালে বলে উত্তেজনায় অনেক অভিবাসী কোনো কিছুই পরোয়া না করেই নেমে পড়েন। স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া অনেককে জীবিত উদ্ধার করে ইউএস বর্ডার পেট্রলের বিশেষ দল।
রিও গ্র্যান্ডে নদীটি আমেরিকার ইতিহাসের অংশ। ১৯৯৭ সালে এটিকে আমেরিকার ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এটা আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্তকে আলাদা করেছে। আমেরিকার চতুর্থ দীর্ঘতম এই নদী (১ হাজার ৮৯৬ মাইল) খুব চওড়া নয়। ইউএস বর্ডার পেট্রলের এক হিসেবে দেখা গেছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অন্তত ৭ হাজার ২১৬ জন সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে মারা গেছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের কোনো তালিকা নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, রিও গ্র্যান্ড নদী পাশে ছোট হলেও কোথাও বৃষ্টি হলে এতে হঠাৎ পানির চাপ বেড়ে যায়। তিন হাজার কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ এই নদীতে দুই পাশ থেকে অন্তত ১৮টি নদী আর খাঁড়ি এসে মিশেছে। ওপর থেকে দেখতে শান্ত এই নদীর নিচের দিকে স্রোতের টান বেশি।
কেন এই মৃত্যু ঝুঁকি?
ব্রুকলিনের চার্চ ম্যাকডোনাল্ড এলাকাটি মূলত চট্টগ্রাম, নোয়াখালী মানুষের মিলনস্থল। সেখানে সন্ধ্যার পর শত শত মানুষ আড্ডায় জড়ো হন। অভিবাসন অধিকার কর্মী হিসেবে কর্মরত সাংবাদিক সোহেল মাহমুদ বলছিলেন, এখানে যাঁরা আছেন তাদের অর্ধেকই অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় এসেছেন। আগতরা সবাই যে আইনি বৈধতা পেয়েছেন এমন নয়। ২০১৫ সালে টেক্সাসের এল পাসো কারাগার থেকে এমন অনেক বাংলাদেশিকে বাধ্যতামূলক দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। কারণ তাঁরা শরণার্থী হিসেবে নিজেদের প্রমাণে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য কারণ দেখাতে পারেননি।
সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘পঙ্গপালের মতো ছুটছে মানুষ, বিশেষ করে তরুণেরা। অবৈধভাবে এভাবে আমেরিকায় পাড়ি দেওয়ার পেছনে সক্রিয় মানবপাচার গোষ্ঠী। গড়ে উঠেছে বিশাল দালালচক্র।
বাংলাদেশিদের আটক ও মৃত্যুর তথ্যাদি নিয়ে নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল শামীম আহসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, লারেডো এলাকাটি আমাদের কনস্যুলেটের নয়, লস অ্যাঞ্জেলেসের আওতাধীন। মোটা দাগে এটা ওয়াশিংটন ডিসিরও আওতাধীন। এই প্রশ্নটি এখন আসছে, কীভাবে সেখানে অবৈধ বাংলাদেশিদের স্রোত বন্ধ করা যায়।
ছবি: সংগৃহীত